হেফাজতি আদর্শের বিলুপ্তি চাই । প্রভাষ আমিন
‘হেফাজতে ইসলাম’-এর নামের মধ্যেই একটা বিভ্রম আছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান। আবহমানকাল ধরেই এ অঞ্চলের মানুষ পাস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বসবাস করে আসছে। সব ধর্মের মানুষ নির্বিঘ্নে তাদের ধর্ম পালন করতে পারবে, এটাই এ অঞ্চলের মানুষের অন্তর্নিহিত বিশ্বাস ও শক্তি। হেফাজত সেই শক্তিতেই আঘাত হানতে চেয়েছিল। তাদের নাম শুনলে যে কারো মনে হতে পারে, বাংলাদেশে বুঝি ইসলাম অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল!
হেফাজতে ইসলামের কমিটির বিলুপ্তিতে যারা উল্লসিত, আমি তাদের দলে নই। নিজেদের অবিমৃশ্যকারিতা এবং তার ফলশ্রুতিতে সরকারের চতুর্মুখী চাপে আপাতত একটু কোণঠাসা হলেও তাদের যা চরিত্র, সুযোগ পেলেই আবার ছোবল হানবে হেফাজত। তবে তাদের কোণঠাসা থাকার সময়েই তাদের আদর্শিক বিলুপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেটা করতে হবে ইসলামের স্বার্থে, বাংলাদেশের স্বার্থে, মানুষের মানবিক মর্যাদার স্বার্থে।
২০১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম হলেও হেফাজতে ইসলামের উত্থান ২০১৩ সালের ৫ মে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নারীনীতি, শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে আসছিল হেফাজতে ইসলাম। ২০১৩ সালে আলোচনায় আসে তাদের ভয়ংকর ১৩ দফা। ১৩ সংখ্যাটি এমনিতেই অশুভ। কিন্তু হেফাজতের ১৩ দফা দেখার পর আমি বুঝেছি অশুভ কাকে বলে কত প্রকার ও কী কী! এই ১৩ দফা আসলে ছিল বাংলাদেশকে অন্ধকারে নিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে। আর হেফাজতে ইসলামের অস্তিত্বটাই সাম্প্রদায়িক। হেফাজতে ইসলাম সংগঠনটিই তাই বাংলাদেশের মূল চেতনাবিরোধী।
‘হেফাজতে ইসলাম’-এর নামের মধ্যেই একটা বিভ্রম আছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান। আবহমানকাল ধরেই এ অঞ্চলের মানুষ পাস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বসবাস করে আসছে। সব ধর্মের মানুষ নির্বিঘ্নে তাদের ধর্ম পালন করতে পারবে, এটাই এ অঞ্চলের মানুষের অন্তর্নিহিত বিশ্বাস ও শক্তি। হেফাজত সেই শক্তিতেই আঘাত হানতে চেয়েছিল। তাদের নাম শুনলে যে কারো মনে হতে পারে, বাংলাদেশে বুঝি ইসলাম অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল! তাই ইসলামকে হেফাজত করার ‘মহান’ ব্রত নিয়েই তারা মাঠে নেমেছে। কিন্তু ঘটনা একদমই উলটো। বরং হেফাজত আবির্ভূত হয়েছে ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে।
ইসলামের যে শান্ত, সৌম্য ভাবমূর্তি তা হেফাজত অল্প কয়েক বছরেই ধূলিস্যাৎ করে দিতে পেরেছে। হেফাজত মানেই সংঘাত, তাণ্ডব, ঘৃণা, উস্কানি; হেফাজত মানেই পরমতবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ। কিন্তু ইসলাম মানেই শান্তি, ভালোবাসা, পরমতসহিষ্ণুতা, নারীর অধিকার সমুন্নত রাখার চেষ্টা। তাই বাংলাদেশের মানুষ বুঝে গেছে, হেফাজত মানেই ইসলাম নয়, বরং হেফাজত হলো ইসলামের শত্রু। গত কয়েকবছরে বাংলাদেশে ইসলামের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করেছে হেফাজত। এ দেশে ইসলামের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা অবশ্য করেছে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ। একাত্তরে তারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। ধর্মের নামে হত্যা, ধর্ষণ, লুট করেছে। স্বাধীনতার পর ইসলামের সেই ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে অনেক সময় লেগেছে।
মোটামুটি যখন ইসলাম তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল, তখনই সেই স্বাধীনতাবিরোধীদেরই উত্তরসূরি হেফাজতে ইসলাম এসে আবার ইসলামের নামে দেশকে পিছিয়ে নিতে চায়। তাই বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার স্বার্থে, ইাসলামের স্বার্থেই হেফাজতকে রুখতে হবে।
ইসলামের নামে তালেবানরা আলোকিত আফগানিস্তানকে অন্ধকার আফগানিস্তান বানিয়ে ফেলেছে। হেফাজত বাংলাদেশকেও তেমন অন্ধকারের দিকে ঠেলে নিতে চাইছে। হেফাজত সাধারণ মানুষের জন্য ইসলামকে কঠিন করে তুলতে চাইছে। এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না; এসব বলে বলে তারা ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে চাইছে। নারী সম্পর্কে হেফাজদের ভাবনাটাই ভয়য়ংকর। নারী তাদের কাছে নিছক ভোগের বস্তু। স্বামীর মনোরঞ্জন আর সন্তান পালন ছাড়া হেফাজতের চোখে নারীদের আর কোনো উপযোগিতা নেই। হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা শফি নারীদের তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তাদের ফোর-ফাইভের বেশি না পড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। নারীদের গার্মেন্টসে কাজ করাকে তুলনা করেছিলেন জেনার সঙ্গে। আল্লামা শফি তবু মুখে বলেছিলেন, আর তার উত্তরসূরি মামুনুল হক তো নারীদের ভোগের বস্তুতেই পরিণত করেছিলেন। কী ভয়ংকর কথা। হেফাজত থাকলে বাংলাদেশ থাকবে না। নারীদের এই অবমাননা কোনোভাবেই ইসলামসম্মত হতে পারে না।
শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বই ক্রমশ জ্ঞান-বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পুণ্যভূমি সৌদি আরবেও এখন বইছে প্রগতির হাওয়া। নারীরা গাড়ি চালাতে পারছে, স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখতে পারছে। এমনকি সৌদি আরবের পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত হচ্ছে রামায়ণ-মহাভারত। আর হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়েছে। হেফাজত শুধু প্রগতির শত্রু নয়, ইসলামের শত্রু নয়; হেফাজত শিক্ষার শত্রু, সংস্কৃতির শত্রু, বিজ্ঞানের শত্রু, শিল্পের শত্রু।
আমাদেরই কিছু মানুষের ভুলে হেফাজতের উত্থান ঘটেছিল। একসময় বাংলাদেশের নাটক-সিনেমায় খারাপ মানুষের চরিত্র বলতেই ছিল দাড়ি-টুপিওয়ালা মানুষ। এটা হয়েছিল, ধর্মের নামে স্বাধীনতাবিরোধিতার কারণে। আবার বাংলাদেশের কিছু তথাকথিত প্রগতিশীলদের মূল টার্গেট ছিল ইসলাম। ইসলামকে গালি দেয়া মানেই যেন ছিল আধুনিকতা।
অল্পকিছু মানুষের এই ইসলামবিদ্বেষের ফাঁক গলেই দেশে হেফাজতের উত্থান। কিন্তু ২০১৩ সালের পর হেফাজতের সঙ্গে সরকারের ‘আঁতাতের’ সুবাদে দাড়ি-টুপি থাকলেই একধরনের ছাড় পাওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। ইসলামি লেবাসধারীদের যা ইচ্ছা তাই করার, যা ইচ্ছা তাই বলার স্বাধীনতা তৈরি হয়। ওয়াজের নামে এই হেফাজতিরা দেশে ঘৃণা আর অশ্লীলতার বিস্তার ঘটান। তাদের জন্য যেন কোনো আইন ছিল না। দেশে লোকজ-সংস্কৃতির পথ ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে আসে, তার জায়গা নেয় অশ্লীল ওয়াজ। ইসলামের নামে এই ওয়াজই হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের বিনোদন। যাত্রার চর্চা নেই, লোকজ গান-সংস্কৃতির বিকাশ নেই। শিশু-কিশোর সংগঠনগুলোও যেন অসহায় আত্মসমর্পণ করে। এখন সময় এসেছে, আবার আবহমান বাংলার সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানোর। শিশুদের মানবিক বিকাশ ঘটানোর।
হেফাজতের নেতারা নিজেরা সব অপকর্ম করেন। আর মাদ্রাসা ছাত্রদের শেখান এই দুদিনের দুনিয়া কিছু নয়। কিছু মাদ্রাসা পরিণত হয় বিকৃত যৌনতার আখড়ায়। শিশুরা দিনের পর দিন অসহায়ভাবে শিক্ষকদের হাতে নির্যাতিত হতে থাকে। এখন সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। মাদ্রাসার শিশুদের বোঝাতে হবে, অবশ্যই আখেরাতের জন্য ভালো কাজ করতে হবে। কিন্তু আল্লাহ যে কারণে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাও করতে হবে। শুধু পরকালের জন্য অপেক্ষা নয়, এই পৃথিবীর জন্যও সবার কিছু না কিছু করার আছে। সবাই নিজ দায়িত্ব পালন করে পৃথিবীকে আরও মানবিক ও বাসযোগ্য করে তুলতে হবে সব ধর্মের, সব মানুষের জন্য।
হেফাজতের কমিটি বিলুপ্তির পাশাপাশি তাদের আদর্শিক বিলুপ্তিও নিশ্চিত করতে হবে। এই কাজটা শুধু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নয়। শুধু হেফাজতের নেতাদের ধরলে হবে না, তারা যাতে আর কখনও ইসলামের নামে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে মানবতা, অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা দিতে হবে। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা বাড়াতে হবে। ইসলামের শান্তির বাণী পৌঁছে দিতে হবে সবার মাঝে, তাদের দেখাতে হবে ইসলামের আসল পথ, ইসলামের সৌন্দর্য।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক