মানসিক হাসপাতালের অভ্যন্তরে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের স্পর্শধন্য ও স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনাসমূহ অজ্ঞাত কারনে ধ্বংস হতে চলছে নেই ভেঙ্গে ফেলার সরকারি আদেশ । সংরক্ষণের নীতগত সিদ্ধান্ত, তবু কেন অরক্ষিত । ভক্তদের আকুল আবেদন সংরক্ষণের – নরেশ মধু
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত মানসিক হাসপাতালের অভ্যন্তরে স্থাপনাসমূহের সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছে ঠাকুরের আদর্শে অনুপ্রাণিত ভক্ত নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণ। প্রায় শতবর্ষী এই স্থাপনাসমূহ ধ্বংস করার পায়তারা চলছে। ইতিমধ্যে স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনাসমূহের মধ্যে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব বিজ্ঞান কেন্দ্ররে ভগ্নপ্রায় স্থাপনা বিলুপ্তির পথে। ইতিমধ্যে ঐতিহ্যমন্ডিত এই ভবনের বেশ কিছু অংশ ভঙ্গে ফেলা হয়েছে। অবশ্য ভাঙ্গার দায় মানসিক হাসপাতালের পরিচালক জনাব ডা: আবুল বাসার অস্বীকার করেন। তিনি বলেন কে বা কারা ভেঙ্গেছে তিনি জাননেন না। তিনি বলেন স্থাপনা ভাঙ্গার কোন নির্দেশনা তার কাছে নেই। অপরদিকে তিনি বলেন, তার কাছে যথেষ্ঠ নিরাপত্তাবিষয়ক জনবল নেই। ফলে কে বা কারা ভেঙ্গেছে তা তিনি জানেন না বলে দায় এড়িয়ে যান।
পাবনা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী পরিচালক ইনঞ্জিনিয়ার আনোয়ারুল আজিম বলেন পাবনা মানসিক হাপাতলের অভ্যন্তরে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনা ভাঙ্গার কোন নির্দেশনা নেই। বরং সংরক্ষনের জন্য একটি নীতগত সিদ্ধান্ত নেয়া হযেছে বলে দিনি জানান।
অপরদিকে এই স্থাপনা ভাঙ্গার খবর ছড়িয়ে পরলে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের ভক্তরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। আকুল আহ্বান জানান যেন ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত স্পর্শধন্য স্থপনা না ভাঙা হয়। বরং এটি সংরক্ষণের জন্য আবেদন জানান।
পাবনা জেলার মাননীয় জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন জানান, এখন তিনি বিষয়টি ভালভাবে জানেন না। বিষয়টি জেনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কথা সাংবাদিকদের জানান।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ১৮৮৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার হিমাইতপুরে জন্মগ্রহণ করেন। অনূকুলচন্দ্র সৎসঙ্গ। পাবনা শহরের অদুরে হিমাইতপুর গ্রামে (বর্তমানে মানসিক হাসপাতাল) ১৮২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন সৎসঙ্গ। সৎসঙ্গ এর মূল উদ্দেশ্য মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। সৎসঙ্গ কখনো সম্প্রদায়ে বিশ্বাস করে না। ধর্ম কখনও বহু হয় না-ধর্ম এক। সপারিপার্শ্বিক জীবন-বৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলাই ধর্মের প্রধান লক্ষ্য। ধর্ম মূর্ত্ত হয় আদর্শে এবং শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র হলেন ধর্মের মূর্ত্ত আদর্শ। তিনি কোন সম্প্রদায়-বিশেষের নন, বরং সব সম্প্রদায়ই তাঁর। শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন-“একজন মানুষের বিনিময়ে আমি একটি সাম্রাজ্য ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু একজন মানুষকে ছাড়তে পারি না। তিনি গড়ে তোলেন সৎসঙ্গ তপোবন বিদ্যালয়,, সৎসঙ্গ মেকানিক্যাল ও ইলেট্রিক্যাল ওয়ার্কসপ, সৎসঙ্গ প্রেস ও পাবলিকেশন হাউস,, সৎসঙ্গ কুঠির বিভাগ, সৎসঙ্গ ব্যাংক, পূর্তকার্য বিভাগ,বিশ্ববিজ্ঞান কেন্দ্র সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
১৯৪৬ সালে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র স্বাস্থ্যগত কারনে বায়ু পরিবর্তনের জন্য স্বপরিবারে ভারতে যান। রেখে যান বিশাল কর্মযজ্ঞ। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হলে নানাবিধ জটিলতার কারনে ঠাকুর আর তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে ফিরে আসেননি। তার ফেলে যাওয়া আশ্রম পূর্বপাকিস্তন সরকার ।
অপরদিকে শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মস্থান, তাঁর বাসগৃহ, মাতৃমন্দির, স্মৃতিমন্দির (শ্রীশ্রীঠাকুরের মাতৃদেবীর সাধনমন্দির), নিভৃত নিবাস (শ্রীশ্রীঠাকুরের সাধনগৃহ) ফিলানথ্রপী অফিস সহ কিছু স্মৃতি বিজড়িত ভবন ও স্থান হিমাইতপুর সৎসঙ্গকে প্রত্যাপর্ণের জন্য ১৯৬১ খ্রি. থেকে সৎসঙ্গ হিমাইতপুর, পাবনা-এর পক্ষ থেকে সদাশয় সরকার প্রধানগণের নিকট আবেদন নিবেদন করা হয়। বহুবার আবেদন নিবেদন করার পর শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মস্থান সহ কিছু স্মৃতি বিজড়িত ভবন ও স্থান হিমাইতপুর সৎসঙ্গকে প্রদানের জন্য পাবনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুপারিশ প্রেরণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
বাংলাদেশ ও ভারতসহ সারা বিশ্বময় প্রায় কয়েককোটি ভক্ত রয়েছে যারা আজও বিনম্র শ্রদ্ধা হিমাইতপুরের পূণ্যভুমির উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করেন। প্রতিবছর দুটি উৎসব হয় যেখানে বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ভক্তরা পূণ্যভুমিতে পূণ্যলাভের আশায় আসেন। এই সব পুরাতন স্মৃতির স্পর্শে তারা যেন তাদের পরমকে স্পর্শ করেন।
মানসিক হাসপাতালের অভ্যন্তরে যেসব স্মৃতি রয়েছে তা মানসিক প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই দাড়িয়ে আছে। এবং এইসব স্থাপনা মানসিক হাসপাতালের কার্যক্রমমকে কোন ধরনের বাধার সৃষ্টি করেনা।
সৎসঙ্গ কর্তৃপক্ষ বহুবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার প্রধানের কাছে আবেদন জানিয়েছেন যাতে করে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র-এর ফেলে যাওয়া ভবনগুলোকে প্রত্নতাত্বিক বিভাগের আওতায় নিয়ে আসা হয়। কিন্তু কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় নি।
বর্তমান মানসিক হাসপাতালের পরিচালক সেই সব স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে যা ধর্মপ্রাণ সকল মানুষের হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। পাবনা জেলার ঐতিহ্য সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র এই সব স্থাপনা। ইতমধ্যে ঠাকুরের অনুসারি ভক্তরা এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পাবনার নাগরিক সমাজ দাবী রাখছেন এই সব স্থাপনা যেন ভাঙ্গা না হয়। পাবনা যে কটি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নিদর্শন বহন করে পাবনাকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সৎসঙ্গ এবং তার রেখে যাওয়া স্মৃতি। দাবী উঠছে স্থপনাগুলোকে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধীনে নেয়া হোক এবং সংস্কার করে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হোক। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে এবং দেশি বিদেশের লাখো ভক্তপ্রাণের আগমন ঘটবে।
লেখক : সাংবাদিক , কলাম লেখক ও উন্নয়ন কর্মী ।