বৈদেশিক ঋণে বর্তমান অবস্থা ধরে রাখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখনো ঝুঁকিসীমার নিচে আছে। ভবিষ্যতে ঋণের বর্তমান অবস্থা ধরে রাখতে হবে। এজন্য তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেন। মঙ্গলবার গণভবনে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে শ্রীলংকা বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তিনি এ নির্দেশ দেন। এর আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেন।
এতে বলা হয়, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের তুলনায় ঋণ ও অর্থ ব্যবস্থাপনায় শক্ত অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। দেশের জনগণের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের যে অঙ্ক তাও তুলনামূলক কম। বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে এ পর্যন্ত যে ঋণ নেওয়া হয়েছে তার গড় সুদ হার বাংলাদেশের চেয়ে শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের বেশি। এক্ষেত্রে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লিখিত দুটি দেশের চেয়ে দ্বিগুণ। কোনো দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি বিপদ বয়ে আনতে পারে যদি তার ঋণ জিডিপির তুলনায় বেশি হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাত বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে কম।
সূত্র জানায়, সকাল সাড়ে ১০টায় বৈঠক শুরু হয়ে চলে টানা তিন ঘণ্টা। এ সময় অর্থনীতির প্রতিটি সূচক প্রধানমন্ত্রী নিজেই পর্যবেক্ষণ করেন। প্রতিটি তথ্য-উপাত্ত তিনি নিজে বিশ্লেষণ করেছেন। বৈঠকে অর্থমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, বাংলাদেশ শ্রীলংকা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান ঋণ ব্যবস্থাপনা আগামীতেও ধরে রাখতে হবে।
তবে অর্থনীতিবিদরা শ্রীলংকা থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কয়েক অর্থনীতিবিদ যুগান্তরকে বলেন, কয়েক বছর আগেও শ্রীলংকার সবকিছু ভালো ছিল। কিন্তু তাদের অর্থনীতিতে খুব দ্রুত বিপর্যয় নেমে এসেছে। এজন্য ভবিষ্যতে ঋণ ও অর্থ ব্যয় ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, শ্রীলংকার তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা নিঃসন্দেহে ভালো। জিডিপির অনুপাতে বিদেশি ঋণ নেওয়ার হার এবং বিদেশি ঋণ পরিশোধে আমাদের সক্ষমতাও আছে। এছাড়া প্রবৃদ্ধিসহ অর্থনীতির সব সূচকে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে। তবে কথা হচ্ছে শ্রীলংকার এই পরিস্থিতি থেকে ভবিষ্যতের জন্য আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। বিশেষ করে বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কম সুদে নিতে হবে। বড় মেগা প্রকল্প নেওয়ার আগে এর অর্থায়ন কোথা থেকে কীভাবে হবে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সর্বশেষ ঋণনির্ভরতা কমাতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এদিনের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করতে শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনা করে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সেখানে দেখানো হয়, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বাংলাদেশের আকার হচ্ছে ৩৫ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা (৪১৬ বিলিয়ন ডলার)। শ্রীলংকার ৭ লাখ ১৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা (৮৩ বিলিয়ন ডলার) এবং পাকিস্তানের আকার ২২ লাখ ৪৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা (২৬১ বিলিয়ন ডলার)। ফলে শ্রীলংকা ও পাকিস্তানে জিডিপি যোগ করে যে অঙ্ক দাঁড়ায় তার চেয়ে বেশি বাংলাদেশের।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতেও বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। উপস্থাপিত প্রতিবেদনে দেখানো ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬.৯ শতাংশ, শ্রীলংকার ৩.৬ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ৩.৯ শতাংশ। এছাড়া গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৬.২ শতাংশ, শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি ১৮.৭০ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ১২.২০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে সেখানে বলা হয়, ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। যে কারণে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে।
বৈঠকে বলা হয়, একটি দেশ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে সংশ্লিষ্ট দেশের জিডিপির তুলনায় ঋণ বেশি নেওয়া হলে। সেক্ষেত্রে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের ঋণের অনুপাত হচ্ছে জিডিপির ৩২.৪ শতাংশ। পাশাপাশি শ্রীলংকার ঋণের অনুপাত তাদের জিডিপির ১১৯ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ৮৯ শতাংশ। এর মধ্যে বিদেশি ঋণের অঙ্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাত ঋণের হার ১১.৯০ শতাংশ, শ্রীলংকার ক্ষেত্রে এ হার ৪ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ৩৯.১ শতাংশ।
সূত্র আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের অনুপাত, চলতি অর্থবছরে ঋণ পরিশোধের অঙ্ক, ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে গড় সুদ হার, রপ্তানির পরিমাণ, ঘাটতি বাজেট ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের তথ্য তুলে ধরা হয়।
সেক্ষেত্রে এই মুহূর্তে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের অঙ্ক বাংলাদেশের হচ্ছে ২৫ হাজার ৩৭০ টাকা (২৯৫ মার্কিন ডলার)। পাশাপাশি শ্রীলংকায় এটি ১ লাখ ৪১ হাজার ৯০০ টাকা (১৬৫০ ডলার) এবং পাকিস্তানের হচ্ছে ৫১ হাজার ৮৪ টাকা (৫৯৪ ডলার)। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান ভালো সেটি তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার বিপরীতে বাংলাদেশকে চলতি অর্থবছরে পরিশোধ করতে হবে ২০ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা (২৪০ কোটি ডলার)। এক্ষেত্রে শ্রীলংকাকে পরিশোধ করতে হবে ৭৩ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা (৮৬০ কোটি ডলার) এবং পাকিস্তানকে পরিশোধ করতে হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা (১২৪০ ডলার)।
ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং সুবিধা হচ্ছে সুদ হার কমে নেওয়া। সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশ যে বিদেশি ঋণ নিয়েছে তাতে সুদের হার গড়ে ১.৩৫ শতাংশ। কিন্তু এটি শ্রীলংকার ক্ষেত্রে গড়ে ৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ৪.৫ শতাংশ। তুলনামূলক রপ্তানির ক্ষেত্রে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের আয় ৩৮৭৫ কোটি মার্কিন ডলার। এক্ষেত্রে শ্রীলংকার আয় ১২২০ কোটি মার্কিন ডলার এবং পাকিস্তানের ২৫৬০ কোটি মার্কিন ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের রিজার্ভের অঙ্ক (মার্চ পর্যন্ত) ৪৪২০ কোটি ডলার। শ্রীলংকার রিজার্ভের অঙ্ক ১৯০ কোটি ডলার এবং পাকিস্তানের ১১৩০ কোটি ডলার। জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে শ্রীলংকার তুলনায় চলে না। একটি অপ্রয়োজনীয় ইস্যু কেন সামনে আসছে জানি না। বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচক সব ভালো আছে। শ্রীলংকার মতো পরিস্থিতি হওয়ার কারণ দেখছি না। তবে ঋণ গ্রহণের ব্যাপারে কম সুদে যেখানে পাওয়া যায় সেটি দেখতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে ঋণের দরকার আছে। কোন প্রকল্পের জন্য, কেন ঋণ নিচ্ছি এগুলো বুঝতে হবে। যেন সমস্যায় পড়তে না হয়।
বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এমকে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, শ্রীলংকার অর্থনীতির তুলনায় বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাত কম। এদিক থেকে শ্রীলংকায় অনেক বেশি। আমাদের ঋণ পরিশোধের অতীত রেকর্ড ভালো। কখনো খেলাপি হয়নি। তবে মনে রাখতে হবে কয়েক বছর আগেও শ্রীলংকা ভালো অবস্থানে ছিল। খুব দ্রুত এর অবনতি হয়েছে। এর থেকে ভবিষ্যতের শিক্ষা হচ্ছে ঋণ ও অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা সঠিক না হলে পরিস্থিতি দ্রুত পালটে যেতে পারে। এজন্য ঋণ ও অন্যান্য ব্যয় ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে দ্রুত পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।