রেকর্ড অর্ডার গার্মেন্টসে ॥ অর্থনৈতিক ভিত আরও মজবুত হবে
নিজস্ব প্রতিনিধি : বিশ্বকাপ ফুটবলে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ এখনও দূরের স্বপ্ন। তবে মাঠে না থাকলেও ভিন্নভাবে থাকবে বাংলাদেশের নাম। মেড ইন বাংলাদেশ লেখা ফিফার টি-শার্ট পরে অফিসিয়াল কর্মীরা ঘুরবেন সব ভেন্যুতে। পরবেন ফুটবল অনুরাগীরাও। ফিফার ৬ লাখ অফিসিয়াল টি-শার্ট তৈরির অর্ডার পেয়েছে চটগ্রাম নগরীর সনেট টেক্সটাইল। রাতদিন ব্যস্ততায় তা এখন তৈরি হচ্ছে। ইতোমধ্যে চলে গেছে একটি চালান। ঠিক একইভাবে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লাহ এ্যাপারেলস সম্প্রতি স্পেনের একটি বাস্কেটবল দলের অফিসিয়াল ফ্যান জার্সির ক্রয়াদেশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের স্থানীয় কারখানায় উৎপাদিত জার্সির কাপড়ও পছন্দ করেছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি। কারখানা কর্তৃপক্ষের দাবি, এ ধরনের ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে আগে খুব বেশি আসেনি। যেগুলো এসেছে, সেগুলোর কাপড় আমদানি করতে হতো চীন থেকে। সম্প্রতি চীনে নতুন করে লকডাউনের কারণে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থানান্তর হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। শুধু চীন নয়, ক্রয়াদেশ সরে আসছে এমন দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়াও। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারাই ক্রয়াদেশ স্থানান্তর করছেন বেশি। এছাড়া প্রতিযোগী দেশ শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং তীব্র জ্বালানি সঙ্কটের কারণে পোশাকের বৈশ্বিক ক্রেতারা বাংলাদেশে ভিড় করছেন।
সাম্প্রতিক সময়ের রফতানি পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় জানা যায়, বাংলাদেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে নিট। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ৯ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ সময়ে এ খাত থেকে এসেছে ১৭ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী মুদ্রা। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রফতানি বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর ওভেন পোশাক রফতানি করে গত ৯ মাসে আয় হয়েছে ১৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা। একক মাস হিসেবে গত মার্চে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে ৪৭৬ কোটি ২২ লাখ (৪.৭৬ বিলিয়ন) ডলার বিদেশী মুদ্রা এনেছেন বাংলাদেশের রফতানিকারকরা। বর্তমান বিনিময় হার (৮৬ টাকা ২০ পয়সা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৪১ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ মার্চজুড়েই ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে গোটা বিশ্বে। যুদ্ধের দামামায় অন্যান্য সূচকে টান পড়লেও রফতানি আয় ছিল উর্ধমুখী। শুধু মার্চ মাসেই নয়, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসেও পোশাক রফতানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত ছিল।
জানা গেছে, মূলত প্রতিযোগী দেশ মিয়ানমারে রাজনৈতিক অস্থিরতা, গত বছর ভারত ও ভিয়েতনামে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে ক্রয়াদেশ আসতে সহায়ক হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে করোনা সহনীয় হয়ে এলেও ক্রয়াদেশ বাড়ার প্রবাহ কমেনি, বরং প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি আরেক প্রতিযোগী দেশ শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ঘনীভূত হওয়া এবং সেখানে বিদ্যুত ও জ্বালানির সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করায় বিদেশী ক্রেতারা ওই দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এর পরিবর্তে তাঁরা নিরাপদ উৎস হিসেবে বাংলাদেশ কিংবা অন্য প্রতিযোগী দেশের দিকে যাচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানে রাজনৈতিক পালাবদলের পর অর্থনৈতিক সঙ্কটে পোশাকের ক্রেতারা বাংলাদেশমুখী হতে পারেন বলে মনে করেন অনেকেই। এর আগে মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে অনেক ক্রেতা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। তার সুফল ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ভোগ করছে। দেশের অন্যতম শীর্ষ পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি কুতুবউদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা থেকে কী পরিমাণ ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে আসছে, এখনও এর কোন প্রমাণ তৈরি হয়নি। তবে শ্রীলঙ্কার ক্রয়াদেশের একাংশ বাংলাদেশে আসছে-এটা শতভাগ নিশ্চিত। কারণ ক্রেতারা কী করবে? তারা তো অনিশ্চয়তা জেনে কাউকে ক্রয়াদেশ দিয়ে বসে থাকবে না। পরিস্থিতি যদি এ রকম চলতে থাকে, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে অবশ্যই তারা যেখানে নিশ্চয়তা পাবে, সেখানে যাবে।’
রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি তৈরি পোশাক কারখানার উদ্যোক্তারা বলেছেন, এখন এত ক্রয়াদেশ আসছে যে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। সময়মতো পণ্য রফতানি করতে অনেক মালিক সাব-কন্ট্রাক্টেও কাজ করাচ্ছেন। আবার দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি থাকায় অনেক কারখানা দুই শিফটে চলছে। ঢাকার নিট পোশাক কারখানার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের কারখানায় কয়েক শিফটে কাজ হচ্ছে। করোনাসহ নানা কারণে এমনিতেই কর্মীর সঙ্কট আছে। তার মধ্যে সক্ষমতার চেয়ে বেশি অর্ডার আসায় তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিটি কারখানায়ই কমবেশি ১৫-২০ শতাংশ কর্মীর ঘাটতি রয়েছে। আগামী ছয় মাস তাঁরা কোন নতুন অর্ডার নেয়ার মতো অবস্থায় নেই। চট্টগ্রামের এক উদ্যোক্তা জানান, সেখানের কারখানাগুলোতেও ক্রয়াদেশের চাপে কর্মীদের ওভারটাইম দিয়ে দিনরাত কাজ করাতে হচ্ছে। জরুরী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কর্মী নিয়োগের চেষ্টা করা হচ্ছে। কর্মীর সঙ্কট মোকাবেলায় অনেক কারখানায় উন্নত যন্ত্রপাতি সংযোজন করে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা সঙ্কটের কারণে তাঁরা বাড়তি ক্রয়াদেশ পাচ্ছেন বলে জানালেও সময়মতো পণ্য শিপমেন্ট করা নিয়েও উদ্বেগ আছে তাঁদের মধ্যে।
জানা যায়, সারা বিশ্বের করোনার সূচক যখন কার্যত তলানিতে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নতুনভাবে চেনা জীবনের ছন্দ ফিরছে, তখন একেবারে উল্টো চিত্র চীনে। অনেক জায়গায় এখন লকডাউন চলছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতারা সে দেশে গেলে ১৪ দিনের আইসোলেশনে থাকতে হয়। সে কারণে ক্রেতারা ওই দেশে যেতে পারছেন না। পোশাক রফতানির বৃহৎ দেশ চীন। তাই চীনের অনেক অর্ডারও বাংলাদেশে আসছে। পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীন থেকে ক্রয়াদেশ স্থানান্তর হয়ে বাংলাদেশে আসার গতি সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। শুধু চীন নয়, ক্রয়াদেশ সরে আসছে এমন দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়াও। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারাই ক্রয়াদেশ স্থানান্তর করছে বেশি। দেশটির বড় পোশাক ক্রেতাদের মধ্যে আছে ওয়ালমার্ট, ভিএফ (কন্তুর), গ্যাপ, জেসিপেনি, ক্যালভিন ক্লেইন, টমি হিলফিগার। তাদের প্রায় সবাই ক্রয়াদেশ স্থানান্তর করে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি ইউরোপভিত্তিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ক্রয়াদেশ স্থানান্তর হচ্ছে ওভেন ও নিট পোশাক দুই ক্ষেত্রেই। পোশাক শিল্প মালিকদের দাবির সঙ্গে মিলছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনার তথ্যও। নিয়মিতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের এক্সটারনাল ইকোনমিক্স শাখা থেকে প্রকাশ পায় তৈরি পোশাকের প্রান্তিক পর্যালোচনা শীর্ষক প্রতিবেদন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুনে রফতানি বৃদ্ধি পেলেও গতি ছিল মন্থর। সেই গতি বাড়তে শুরু করে সেপ্টেম্বরে। কোভিড মহামারীতেও গত ডিসেম্বরে রফতানি ছিল অনেক বেশি উৎসাহব্যঞ্জক। বৈশ্বিক লকডাউন শিথিল হওয়ার পর ক্রেতারা ক্রমেই ক্রয়াদেশ স্থানান্তর করছেন বাংলাদেশে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বড় জায়ান্ট কোম্পানিগুলো তাদের উপস্থিতির বিকেন্দ্রীকরণ করছে। চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় যে ক্রয়াদেশগুলো যেত, সেগুলো এখন পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে আসছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কারখানাগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ পাচ্ছে। গত জানুয়ারি মাসেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। ইউরোপের ক্রেতারাও ক্রয়াদেশ সরিয়ে নিচ্ছেন, তবে তা বড় আকারে এখনও বাংলাদেশে আসতে শুরু করেনি। স্থানান্তরের যে গতি সেটা মে মাস পর্যন্ত গড়াবে। যদিও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যত নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘আমাদের এখানে বিপুল অর্ডার আসছে। শ্রীলঙ্কা থেকেও অনেক অর্ডার বাংলাদেশে আসছে। আমাদের উদ্যোক্তারা অর্ডার নিয়ে কাজ করছেন। তবে এখানে সমস্যা হলো ‘এজ অব ডুয়িং বিজনেসে’ আমরা পিছিয়ে পড়ছি। অনেক অর্ডার থাকার পরও যদি আমরা তা টেকসই করতে না পারি, এটা আমাদের নিজেদের কারণেই হবে। কারণ আমাদের বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভুগতে হয়। আমরা নতুন করে আবারও পিছিয়েছি। এখন আবার শিল্পকারখানায় গ্যাস রেশনিং করা হচ্ছে। এভাবে হলে অর্ডার সময়মতো কীভাবে শিপমেন্ট হবে? এগুলো সরকারকে ভাবতে হবে।’
এ বিষয়ে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জনকণ্ঠকে বলেন, পোশাক রফতানিতে অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেই সঙ্গে শঙ্কাও। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার থেকে অনেক অর্ডার সরছে, কিন্তু মালিকরা তা গ্রহণ করতে চিন্তিত। কারণ জ্বালানি তেলের পর এবার গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে আলোচনা চলছে। যদি দাম বাড়ানো হয়, তবে পোশাক শিল্প সেই ভার বহন করতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, উপযুক্ত নীতি-সহায়তা দিতে পারলে পোশাক শিল্প অনেক দূরে যেতে পারবে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া স্থগিত রেখে কাস্টমসের জটিলতাগুলো দূর এবং ম্যান মেইড ফাইবারে ইনসেনটিভ দিলে রফতানি আয় বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে শ্রীলঙ্কার যে অবস্থা, সেখানকার অর্ডার বাংলাদেশে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এর আগে মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে অনেক ক্রেতা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। তার সুফল ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ভোগ করছে। তবে যে কোন মূল্যে এই সুফল ধরে রাখতে হবে আমাদের।’