যুদ্ধ-১ । রাজিউদ্দীন আহমাদ
এক মেরুর ঐতিহাসিকদের মতে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়েছিল একটা বিবর্তনের মাধ্যমে। তার আগে তাদের পূর্বপুরুষরা বাস করত গাছের ডালে । ক্রমে তারা মানুষে রূপান্তরিত হয় ও গাছ থেকে নেমে এসে মর্তে বসবাস শুরু করে। শুরুর দিকে তারা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারত না; ধীরে ধীরে তারা সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখে; ঐ ঐতিহাসিকরা এদের নাম দিলেন হোমো-ইরেকটাস। হোমো একটা লাতিন শব্দ যার অর্থ মানুষ (জাতি বা জেনাস)। বর্তমানের মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স। হোমো ইরেকটাসদের পরে আসে হোমোর (জেনাস) বহু প্রজাতি (স্পেসিস) যেমন, হোমো নিয়ানডারথালেনসিস, হোমো হ্যাবিলিস ইত্যাদি। এই বিষয়ের বিষদ আলোচনায় যাব না, শুধু এটুকু বলি, হোমো হ্যাবিলিসরা প্রথম গোষ্ঠিযুদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করে। এদের সামাজিক সম্পর্কের নাম দেয়া হয় আদি সাম্যবাদী সমাজ, কারণ এই সমাজে কোনো শ্রেণী ছিল না, খাবার যা সংগ্রহ করত তা তারা সকলে ভাগ করে খেত। এদের সবচেয়ে বড় কাজ ছিল খাদ্য সংগ্রহ করা। গাছের ফল-ফুল-লতা-পাতা আর শিকার করা কিছু পশুর মাংস ছিল এদের খাদ্য। মাছ এরা খেতে শিখেছে অনেক দেরিতে, আগুনের ব্যবহার আয়ত্বে আসার পরে। সভাবতই এদের খাদ্য সংগ্রহ করাটাই ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা। ফলে খাদ্যের সাবধানে ঘুরতে ঘুরতে যদি একটা গোষ্ঠির অন্য আরেকটা গোষ্ঠির সক্সেগ দেখা হত তবে তাদের মধ্যে বাধত মারামারি (আদি যুদ্ধ), এবং সেই মারামারি ততক্ষণ পর্যন্ত চলত যতক্ষণ একটা গোষ্ঠি সম্পূর্ণভাবে পরাজিত না হচ্ছে। পরাজিত গোষ্ঠির বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে জয়ী গোষ্ঠির মানুষগণ মেরে ফেলত কারণ তাকে বাঁচিয়ে রাখলে তাকেও খেতে দিতে হবে, সে সময়ে সেটারই ছিল অভাব। এ নিয়ম অব্যহত থাকে যতদিন তারা কৃষি কাজ করতে না শিখেছে। কৃষি কাজ করতে শিখলে তারা মারামারিতে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোকে আর মেরে ফেলত না, তাদেরকে ধরে নিয়ে এসে কৃষি মজুর হিসেবে কাজে লাগাত। সমাজে শ্রেণী বিভাগ দেখা দিল। এক শ্রেণী প্রভু ও অন্যটি কৃষি মজুর। এই সমাজের নাম সার্ফডম বা ভূমিদাস প্রথা।
কথাগুলো এত সহজে একটা প্যারাতে বলে ফেললাম ঠিকই কিন্তু প্রকৃত বিষয়টা অত সহজ ছিল না, এ প্রকৃয়ায় কেটে যায় লক্ষ লক্ষ বছর। আমরা যে ইতিহাস এখানে বলতে যাচ্ছি তাএখন থেকে শুরু এবং তার বয়স এখন থেকে প্রায় দুই লক্ষ বছর। আগেই বলেছি, এখন সমাজে দুটো শ্রেণী, মূল গোষ্ঠিটি প্রভু ও অন্যটি ভূমিদাস বা কৃষি মজুর। কিন্তু এভাবেও খুব একটা দীর্ঘ সময় চলতে পারে নি। গোষ্ঠির জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পেশা ভিত্তিক কাজে বিভক্ত হতে শুরু করল। কেউ ঘর বানাতে ভাল পারে তো কেউ শিকার করতে। কেউ মাছ ধরতে পটু তো কেউ মারামারিতে ওস্তাদ। এমনি করে মানুষ নানান পেশায় বিভক্ত হতে থাকল, তবে গোষ্ঠির নিয়ম-শৃঙ্খলার ভার থাকল কৃষিকাজে পারদর্শী এবং সন্তান উৎপাদন ও তাদের বড় করে তোলাতে সামর্থ নারীরা। এই সমাজকে তাই মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বলে। এ সমাজের মানুষরা মাকে চিনত কিন্তু বাবাকে চিনত না।
শারীরিক শক্তিতে বলবান পুরুষগণ এ ব্যবস্থা খুব বেশি দিন টিকতে দেয় নি। তারা কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেয় ও বিয়ের প্রচলন শুরু করে। এখন থেকে প্রত্যেকে তার বাবাকেও চেনে এবং তারা তাদের পিতার সহায়-সম্পদের উত্তরাধিকার হয়। নারী সাম্রাজ্ঞী থেকে নেমে আসে কেবল ভোগের সামগ্রীতে। এই সময়ে আরেকটি পেশার জন্ম হয়, তা হল বেশ্যাবৃত্তি। এই অবস্থাতে সামন্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় ও রাষ্ট্রের জন্ম হয়। একেকটা দলপতি রাজা বনে যায়। লেনিনের ভাষায়, যখন এবং যেখানেই সমাজে শ্রেণী বিভাগ দেখা গেছে, তখন ও সেখানেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র এমন একটা যন্ত্র যা সমাজের একটা শ্রেণীর দেখভাল করে ও অন্য শ্রেণীকে দমিয়ে রাখতে সাহায্য করে। প্রকৃতপক্ষে, অর্থনীতির দৃষ্টিতে সমাজে দুটো শ্রেণীই থাকে। পেশাগত ভিন্নতা অর্থনীতির চোখে কোনো শ্রেণী নয়। এখন প্রত্যেকের নিজস্ব জমিজমা আছে, অর্থাৎ উৎপাদন যন্ত্রের উপর ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হল। (তখন উৎপাদন যন্ত্র বলতে প্রধানত জমি-জমা; এখন কল-কারখানা, পশু-পাখির খামার এসে গেছে তার মধ্যে।) দলপতিগণ আঞ্চলিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে যার নাম রাজতন্ত্র। রাজা শাসিত একটা রাজ্যও একটা রাষ্ট্র। মানব সমাজ ছোট ছোট ভূখন্ডে (রাজ্যে) বিভক্ত হয়ে পড়ল, আর সেই ভূখণ্ডকে আগলিয়ে রাখার জন্য বা তাকে সম্প্রসারিত করার জন্য বল প্রয়োগ বা প্রকৃত যুদ্ধের প্রচলন শুরু হল। এই যুদ্ধের জন্য সে যুগে লেঠেল বাহিনী তৈরি হয়, অর্থাৎ মামুষ মানুষকে কিনে নিয়ে বা ভাড়া করে রাখে প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়ে প্রভুদের রক্ষার জন্য; অন্য কথায়, মানুষের জীবনও পণ্যে রূপান্তরিত হয়ে গেল। কোথাও পড়েছিলাম একজনের কথা, রাজা মাইডাস যা কিছু ছুয়েছিল তাই সোনা হয়ে গেছিল, আর পুঁজিবাদ যা কিছু ছুঁয়েছে তাই পণ্য হয়ে গেছে। রাজাদের অর্থনীতিও পুঁজিবাদি অর্থনীতি।
হোমো হ্যাবিলিস থেকেই ক্রমান্নয়ে হোমো সেপিয়েন্সদের জন্ম; আর, হোমো সেপিয়েন্সরাই যখন একটা বিশেষ পরিমান মস্তিকের অধিকারি হল তখন তাদেরকে আমরা বলি হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স। এরাই সব চাইতে যুদ্ধবিধ সম্পন্ন মানুষ সে মানুষগুলোই আমরা।
আমরা কালে কালে অঢেল জ্ঞান অর্জন করতে থাকলাম;এবং, প্রযুক্তিগতভাবে যতই উন্নত হতে থাকলাম আমাদের বর্বরতা ততোই বাড়তে থাকল। জ্ঞানের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামাজিক রূপেরও পরিবর্তন হতে থাকল; রাজতন্ত্র থেকে আমরা হলাম পুঁজিবাদি বা সাংবিধানিক রাজতন্ত্র, তা থেকে সাম্রাজ্যবাদি ও শেষে আধুনিক সাম্যবাদি (সমাজতন্ত্র), কিন্তু আমাদের সেই আদি অভ্যাস ত্যাগ করতে পারলাম না, যুদ্ধ আমাদের বিশস্ত সঙ্গি হয়েই থেকে গেল সামান্য কিছু রঙ-ঢঙ আর ফ্লেভারে পরিবর্তন আসল মাত্র।
অবশ্য, এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, এই যুদ্ধের কারণেই আজ আমরা প্রযুক্তিগতভাবে এতটা উন্নত। তা না হলে হয়ত আমরা এখনও লৌহ বা তাম্র যুগে বাস করতাম। আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে লিওনার্দো দা ভিনসির (১৪৫২-১৫১৯) মত একটি মেধাকেও যুদ্ধধাস্ত্র ও রণকৌশলের জন্য রাজা কাজ করতে বাধ্য করেছিল।আর, এখন থেকে মাত্র সাতাত্তর বছর আগে যুগান্তকারী বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টেইনের আবিষ্কৃত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আনবিক বোমা বানিয়ে তা দিয়ে নাগাসাকি ও হিরোসিমা শহর দুটিকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল (যদিও তাঁকে তাঁর এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবে নোবেল পুরস্কারটি দেওয়া হয় নি। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি আইনস্টেইনের দুবার নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিৎ ছিল।)।
আমি যুদ্ধবাজদের বরবর বলছি কারণ তারা গরু-ছাগলের মত মানুষকে মরবার জন্য ভাড়া করে রাখে; এটা আর যা-ই হোক সভ্যতা নয়। কিন্তু বাস্তবে যারা যত বেশি মানুষ হত্যা করতে পেরেছে তারা তত বেশি সভ্য। ইউরোপকে সভ্যতার শিখরে স্থান দেওয়া হয়েছে কারণ তারা সব চেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করেছে। তাদের মধ্যে আবার ব্রিটেননকে বেশি সভ্য ধরা হয় কারণ তারা ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে মানুষ হত্যাতে চ্যামপিয়ন। তারা কেবল অস্ট্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো এবং আমেরিকাতে যে পরিমান মানুষ হত্যা করেছে অন্যেরা সবাই মিলে সর্বকালেও তা করতে পারে নি।
আজকের বিশ্বে মরার জন্য মানুষ ভাড়া করে রাখা নিতান্তই একটা অভদ্র কাজ। এটা সভ্যতার কোনো সংজ্ঞাতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ব্রিটেনে এবং আরও অনেক দেশে একজন খুনিকেও মৃত্যুদ- দেওয়া যায় না, সেখানে তারা মরার জন্য মানুষ ভাড়া করে রাখে কী ভাবে? এটা কি ভণ্ডামি নয়? আমার মনে হয়, সমস্ত পৃথিবী হতে যুদ্ধ ও এতদসংক্রান্ত যাবতীয় কাজ নিষিদ্ধ করা উচিত। অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি সব বন্ধ করা উচিত, এবং যুদ্ধ জাহাজ, সাবমেরিন, ফাইটার প্লেন সমস্তকে পুড়িয়ে ফেলা দরকার বা সম্ভব হলে তাদেরকে মানুষের প্রয়োজনীয় কোনো কিছুতে রূপান্তর করা বাঞ্ছনীয়। আর সমস্ত প্রকার বোমা ও মিসাইলকে উপযুক্ত উপায়ে ধ্বংশ করা অতিব জরুরি। মানুষকে সত্যিকারের সভ্য মানুষ হিসেবে বাঁচার সুযোগ দেয়া সমস্ত সভ্য মানুষের একান্ত কর্তব্য। মানুষ যদি তাদেরকে সভ্য বলে দাবি করে তবে অসভ্যদের অনুকরণে যুদ্ধ তাদের বন্ধ করতেই হবে। যুদ্ধে সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হয় না।
পারিবারিক গণ্ডি যেখানে মৃত্যু অবাঞ্ছিত একটা প্রাকৃতিক প্রকৃয়া, সেখানে জেনেশুনে আমরা মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না; অথচ, আমরা তাই করে চলেছি। ছোটখাটো যুদ্ধের কথা যদি আমরা বাদও দিই, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (জুলাই ১৯১৪-নভেম্বর ১৯১৮) চার বছরের কিছু বেশি সময়ে ৯০ লক্ষ যোদ্ধা (ভাড়া করা মানুষ) ও অন্তত ৫০ লক্ষ সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান, তার সক্সেগ হাজার হাজার জনপদ ধ্বংশ হয়ে যায়; এবং, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (সেপ্টেম্বর ১৯৩৯-সেপ্টেম্বর ১৯৪৫) ৬ বছরে উভয় পক্ষের ২ কোটি ৪০ লক্ষেরও বেশি সামরিক বাহিনীর ভাড়া করা মানুষ ও ৫ কোটি সাধারণ মানুষ প্রাণ দেন ও লক্ষাধিক শহর-নগর ও ছোট ছোট জনপদ ধ্বংশ হয়ে যায়। এই পরিসংখ্যান থেকে অনুমান করা যায় যে মাত্র এই দুটো যুদ্ধে বিশ্বের অন্তত ১০ কোটি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছে বা বাসস্থান হারিয়েছে আর বিশ্বের সমস্ত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানসিকভাবে, লক্ষ লক্ষ মানুষ পঙ্গু হয়ে গেছে। বিশ্ব আর্থিকভাবে বিদ্ধস্ত হয়ে গেছে। যুদ্ধের পরে সমস্ত বিশ্বকে নতুন করে গড়তে হয়েছে, কেবল ধনিক শ্রেণীর কিছু মানুষ আরও ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।
যদিও বেদনাদায়ক তারপরেও সত্য যে আজ তেমনি আরেকটি যুদ্ধর দামামা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সত্যিই লেগে যায় তবে তা হবে বর্তমানের তথাকথিত সভ্য মানুষের জন্য লজ্জাজনক একটা ঘটনা। এ যুদ্ধে মৃত্যু হবে শত কোটি মানুষের, আর পঙ্গু হয়ে যাবে সমস্ত মানবকূল । তারপরে শুরু করতে হবে আমাদের আবার হোমো হ্যাবিলিসদের অবস্থা থেকে। এক প্রশ্নের জবাবে আইনস্টেইন নাকি বলেছিলেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কী দিয়ে হবে অনুমান করা কঠিন, তবে তা যদি হয় তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হবে লাঠি-সোটা দিয়ে।
বিশ্বনেতৃত্বের কাছে তাই আমার দাবি: এ দাদামা বন্ধ কর।