স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কুলেখাড়া শাক — ডাঃ কামরুল ইসলাম মনা
কুলেখাড়া শাক মহা উপকারি একটি শাক। এর মধ্যে অসংখ্য রোগ বিনাশের ক্ষমতা রয়েছে। হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদ মতে ব্যাপক প্রচলন মুখে প্রচলিত থাকলেও বাস্তবে তা কম দেয়া। শাক না পাওয়া গেলে হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন হাইগ্রোফিলা রোগীদের কে দিতে পারেন। এটি শাক হিসেবে খেলেও উপকার হয়।
আসুন আমরা ঘরে ঘরে কুলেখাড়া রোপন করি এবং নিম্নোক্ত রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে চেষ্টা করি–
অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা প্রতিরোধ করে – কুলেখাড়া গাছের পাতা ও কাণ্ড অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে। এই গাছের পাতা ও কাণ্ড খেলে বা সেটার রস পান করলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এই বিষয়টি আয়ুর্বেদে উল্লেখ করা থাকলেও আধুনিক জুগেও এটি বহু রোগীর উপর গবেষণা করে দেখা হয়েছে। যারা অ্যানিমিয়া বা রকাল্পতায় ভোগেন দেখা গেছে তাঁরা কুলেখাড়া পাতা খেলে তাঁদের শরীরে হিমোগ্লোবিন ও হোয়াট ব্লাড সেল দুটোই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে গেলে কুলেখাড়া পাতার রস সেদ্ধ করে, ছেঁকে নিয়ে সেই জল খান। এক সপ্তাহের মধ্যে হিমোগ্লোবিনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। অথবা দিনে ২ বার ৪ চা চামচ কুলেখাড়া পাতার রস সামান্য গরম করে খান।
ব্লিডিং আলসার দূর করে – কিছু ধরনের আলসার থাকে, যার ক্ষত বা ঘা এতটাই খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে সেখান থেকে রক্ত বেরোতে শুরু করে। অনেক সময় এই রক্ত ক্ষরণ শরীরের ভিতরে হয় বলে আমরা বুঝতেও পারিনা কিন্তু অজান্তেই শরীরের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। কুলেখাড়া এই রক্তক্ষরণ বন্ধ করে দিতে সক্ষম। তাছাড়া রক্ত বেরনোর জন্য আপনার যেটুকু ব্লাড লস হয়েছে সেটাও পূরণ করে দেয় এই পাতা।
লিভার বা পাকস্থলীর সুরক্ষা দেয় – শুধু শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় না এই পাতা। আপনার লিভারের সুরক্ষাও প্রদান করে। বিশেষ করে খাওয়ার হজম করাতে কুলেখাড়া পাতা কাজে দেয় কারণ এতে আছে বেশ কিছু পাচক বা এনজাইম। এছাড়াও লিভার বা পাকস্থলী যাতে নিজের কাজ ঠিকঠাক করতে পারে সেটাও লক্ষ্য রাখে এই পাতা।
কিডনির পাথর ভেঙে দেয় ও গলিয়ে দেয়- যারা কুলেখাড়া পাতা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না, তাঁদের বলি, রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরেই যদি আর কোনও কারনে এই পাতার ব্যবহার সর্বাধিক হয়ে থাকে তাহলে সেটা হল কিডনির স্টোন বা পাথর দূর করতে।এই উদ্ভিদে যে এনজাইম আছে তা কিডনির ভিতরে জমে থাকা স্টোন বা পাথর ভেঙে প্রথমে ছোট করে দেয়। তারপর সেটা ধীরে ধীরে গলিয়ে দিতে শুরু করে। এটা শরীর থেকে মল বা মূত্র রূপে বেরিয়ে আসে।
শরীরের কোষে পুষ্টি যোগায় – কোষের সঠিক বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য যা প্রয়োজন তা আছে কুলেখাড়া পাতায়। এর মধ্যে আছে প্রয়োজনীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট। এর মধ্যে আছে আরও অনেক ক্ষারীয় উপাদান। এছাড়া আছে এমন কিছু খনিজ নুন যা কোষের বিকাশের জন্য দরকার। তাই এই পাতা মাঝে মাঝে বা নিয়মিত খেলে শরীরের কোষে সঠিক পুষ্টি সরবরাহ হয়।
শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি করে – শরীরের প্রতিটি কোষ যখন পুষ্টি পায় তখন এটা খুবই স্বাভাবিক যে আমাদের শারীরিক শক্তিও তার সঙ্গে বৃদ্ধি পায়। কুলেখাড়া ঠিক সেই কাজটি খুব যত্নের সঙ্গে করে। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে এটি রক্ত পরিশ্রুতও করে। সব মিলিয়ে দেখা গেছে যে এটি নিয়মিত খেলে বা এর রস পান করলে আমাদের এনার্জি অনেকটাই বেড়ে যায়।
জননতন্ত্র গঠনে সাহায্য করে – যেসব মহিলারা সদ্য মা হয়েছেন তাঁদের জন্য এবং আমাদের জননতন্ত্র ও যৌনাঙ্গকে মজবুত ও আরও উন্নত করে এই পাতা। অনেকে বিশ্বাস করেন এই পাতা ও তার কাণ্ড ফুটিয়ে সেদ্ধ করে সেই জল পান করলে মাতৃত্বকালীন যে অতিরিক্ত ঋতুস্রাবের সমস্যা হয় সেটা কমে যায়। আসলে এই পাতার মধ্যে সেই গুণ আছে যা রক্তক্ষরণ রোধ করতে সক্ষম।
এছাড়াও অসংখ্য রোগের উপর এর ক্রিয়া রয়েছে। বিশেষ করে ৫ টি প্রধান রোগে কুলেখারার উপকারিতা অনস্বীকার্য। সেগুলি হলো – ১) পাথুরি রোগে ২) শুক্রহীনতা ৩) নাবা রোগে ৪) অনিদ্রা রোগে ৫) রক্তপাত বন্ধ করতে।
১) পাথুরি রোগে – পিত্তের থলিতে বা মূত্রাশয়ে পাথর হলে কূলে খাড়া বীজের গুঁড়ো ২ গ্রাম , ২৫০ মিলিলিটার জলের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে প্রস্রাব করবার সময় কষ্ট দূর হয়। পাথুরির যন্ত্রনাও লাঘব হয়।
২) শুক্রহীনতা – কুলেখারার বীজ ,আলকুশি ,বড় গোক্ষুর , শতমূলী ও মাসকলাই ১ গ্রাম করে গুঁড়ো করতে হয়। ১০০ মিলিলিটার দুধের সঙ্গে মিশিয়ে রোজ একবার দুপুরের দিকে খেতে হয়। অন্তত একমাস রুগীকে খাওয়াতে হবে। অথবা দীর্ঘ যৌন মিলন করতে, আলকুশি বীজগুঁড়ো ও কুলেখাড়া বীজগুঁড়ো করে গরম দুধের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়মির রাতের বেলা খান।
৩) নাবা রোগে- এর রস খুবই উপকারী। ১ চামুচ করে দিনে ২ বার খাওয়াতে হবে।
৪) অনিদ্রা – ঘুমের সমস্যা হলে সন্ধেবেলা ২-৪ চা চামচ কুলেখাড়ার শিকড়ের রস খান। উপকার পাবেন।
৫) রক্ত বন্ধ করতে – কোনও কারণে কেটে গেলে, রক্তপাত হলে কুলেখাড়া পাতা থেঁতো করে কাটা জায়গায় চেপে বেঁধে দিন। রক্তপাত বন্ধ হয়ে যাবে, ক্ষতও তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে।
এছাড়াও কুলেখাড়াতে ভিটামিনA, ভাল পরিমান আয়রন, উত্সেচক, স্টেরল থাকে। কুলেখাড়া মূত্র বৃদ্ধি করে দেহের শোথ বা ফোলা কমায়। কুলেখাড়া ফিসচুলায় ভাল কাজ দেয়। যৌন শক্তি ও পেশির শক্তি কুলেখাড়া বৃদ্ধি করে। মূত্রনালীর দোষ কুলেখাড়া প্রশমন করে। রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমান স্বাভাবিক রাখে। কোমরের বাতে এই শাক খুব ভাল কাজে দেয়। পেটের অসুখ ও আমাশয় মোকাবিলার মোক্ষম ওষুধ হল কুলেখাড়া শাক। হাড়ের জয়েন্টের ব্যাথা, সর্দি ও ঠান্ডাতে কুলেখাড়া পাত ভালই কাজ দেয়।
হোমিওপ্যাথি মতে, হাইগ্রোফিলা (Hygropyrum) শরীরের বিভিন্ন স্থানে আমবাত বা আমবাতের মত উদ্ভেদ, উদ্ভেদগুলি লাল বর্নের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘামাচির মত হয়ে উঠে। গীস্ম কালে গরমে পীড়ার বৃদ্ধিতে অব্যর্থ।
আয়ুর্বেদ মতে, এই গাছের পাতা ও কাচা হলুদ একসঙ্গে বেটে লাগান। জ্বালা-যন্ত্রণা যেমন কমবে, ক্ষতও শুকিয়ে যাবে।