নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিবে

0

হীরেন পণ্ডিত : বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছেন বাঙালীর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালী জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের গৌরবজনক ঘটনা বা অধ্যায় হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ৩০ লাখ শহীদের বুকের তাজা রক্ত, লাখ লাখ মা-বোনের সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে একাত্তরের নয় মাস যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রাম এবং নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেই বিজয় ছিনিয়ে আনা হয়েছে ১৬ ডিসেম্বরে।

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির কাছে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা এবং যতদিন বাঙালী জাতি থাকবে ততদিন এই মুক্তিযুদ্ধই থাকবে শ্রেষ্ঠ গৌরবের অধ্যায় হিসেবে, অবিস্মরণীয় এক গৌরবগাথা হিসেবে। কারণ বাঙালী জাতির জন্ম থেকেই কোনো না কোনো শাসক দ্বারা শোষিত হয়েছে, অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে। কখনো মোঘল-পাঠান, কখনো ব্রিটিশ, কখনো পাকিস্তানীদের দ্বারা। জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছে। বাঙালীর ইতিহাস মানেই শোষণ আর অধিকার থেকে বঞ্চনার ইতিহাস। বাঙালীর ইতিহাস মানে না পাওয়া আর বেদনার ইতিহাস। আজকের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য দরকার মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তাদের সামনে উপস্থাপন করা, তুলে ধরা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লিখিত বই, মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত বিভিন্ন ছবি, নাটক এগুলো আরো বেশি করে প্রচার করা দরকার, আজকের প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা দরকার যে মুক্তযুদ্ধে বাঙালী জাতিকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধারা যে জীবনকে তুচ্ছ করে, নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দেশমাতা ও মাতৃভূমিকে মুক্ত করে, স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেছিলো, তা নতুন প্রজন্ম কে জানতে হবে। নতুন প্রজন্মকে এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। কারা সেই চেতনা ধারণ করছে তা জানতে হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি জাতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিল পাকিস্তানীরা এবং হানাদার বাহিনী। ফলে তারা শ্রমজীবী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকসহ এদেশের সূর্য-সন্তানদের হত্যা করেছিলো। বাঙালী জাতি কিভাবে তাদের পরাজিত করেছিল, তার যথাযথ ইতিহাস নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব ও কর্তব্য সবারই। কিন্তু আমরা সেটি কতটুকু করছি সেই প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে নতুন প্রজন্মের চোখ কান খোলা আছে।

মুক্তিযুদ্ধ হলো বাঙালী জাতির শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো আমাদের বাঙালী জাতির আজন্ম লালিত স্বপ্ন, একটি জাতির চেতনার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন দোলা দিয়েছে আমাদের মনে, আমাদের স্বপ্নকে অনুপ্রাণিত করেছে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। সহায়তা করেছে স্বপ্ন বাস্তবায়নে এবং এই স্বপ্নকে বেগবান করেছে এবং এক নতুন আশা ত্বরান্বিত করেছে। যে চেতনা বাঙালী জাতিকে একতাবদ্ধ করেছিল একটি গণতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায়। এই চেতনা নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে আমাদের আরো কাজ করতে হবে। নতুন প্রজন্মের চেতনাকে আরো শাণিত করতে হবে। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, কিন্তু শুনেছে গল্পের আকারে তাদের পরিবারের কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির কাছে, শিক্ষকের কাছে, কোনো নেতার কাছে, কোনো মুক্তিযোদ্ধার কাছে বা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কারো কাছে বা বইতে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সেই শোনা বা পড়া কতটুকু সঠিক বা তার বিস্তৃতি কতটুকু তা আমরা জানিনা। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান কতটুকু তাও দেখার বিষয়। আমাদের নতুন প্রজন্মের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটি যথাযথভাবে তুলে ধরতে হবে? দেশ যেন উল্টোপথে না চলে তাও ভেবে দেখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটি নতুন প্রজন্মের বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা, স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ ও কোনো মুক্তিযোদ্ধা যিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন বা যিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন ব্যক্তি।

তরুণ সমাজ, তারুণ্য একটি প্রাণশক্তি যা অফুরন্ত সম্ভাবনা ও বর্ণিল স্বপ্ন দ্বারা পরিপূর্ণ বাংলাদেশের স্বপ্ন। তরুণদের ভাবনাগুলো হবে বাংলাদেশের ভাবনা, বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার ভাবনা, তরুণ সমাজের আপাদমস্তক চিন্তভাবনা হবে বাংলাদেশকে নিয়ে। সমস্ত অস্তিত্বে থাকবে বাংলাদেশ। তরুণদের কাজগুলো হবে বাংলাদেশের কাজ। সব স্বপ্ন দেখতে হবে বাংলাদেশকে নিয়ে।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে সে বিষয়টি নতুন প্রজন্ম বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের অনুধাবন করতে হবে। এখন সময় এসেছে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে তা এগিয়ে যেতে হবে। স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ চিহ্নিত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত একটি তরুণ প্রজন্ম গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবী এবং নতুন প্রজন্ম দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। এর মাধ্যমে একটি গতিশীল জাতি গঠিত হবে এবং এগিয়ে যাবে নতুন প্রত্যাশায়। নতুন প্রজন্ম হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি আধুনিক প্রজন্ম যাঁরা বাস্তবায়ন করবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ে তোলা। দেশকে মুক্ত করার চেতনা ছিল বঙ্গবন্ধুর। আজকের প্রজন্মকে সেই চেতনায় দেশ গড়তে হবে। এগিয়ে যেতে হবে। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও কেন দুর্নীতিমুক্ত হতে পারব না। আজও দুর্নীতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে। আমাদের বীরদের রক্তের কথা, স্বপ্নের কথা। তাদের স্বপ্নই আজকের এ বাংলাদেশ। পাশাপাশি এ দেশের স্বাধীনতায় বিরোধিতাকরীদের করেছিল তাদের চেনাতে হবে। আর এর উপায় হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার অঙ্গীকার করা। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা জানাতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে। এ দেশ সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন আমাদের জাতির জনক। তোমরা তাঁর আদর্শ বুকে নিয়ে দেশ গঠনে একত্রিত হও। আমরা আজও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনা তরুণ সমাজের কাছে পৌঁছাতে পারিনি সঠিকভাবে। এটা আমাদের ব্যর্থতা। ৩০ লাখ বাঙালির রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এ স্বাধীনতার সঠিক ব্যবহার আমরা আজও করতে পারিনি অথবা পারছি না।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শুরু থেকেই বিভিন্ন শ্রেণিতে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করে সাজানো হয়েছে। এসব পড়ে ছাত্রছাত্রীরা মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি বিষয়কে কেবল একটি অধ্যায়ে বোঝানো সম্ভব নয়। আবার পাঠ্যবইয়ের সূচিও সীমাবদ্ধ। তছাড়া পাঠ্যবইয়ের ইতিহাসও বহুবার পাল্টানোর চেষ্টা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য ঢেকে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে লাভের লাভ কিছুই হয়নি। সত্যি কখনো চাপা থাকে না। তা ঠিক বেরিয়ে এসেছে। সেসব কথাই তাদের বলতে হবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে বিস্তারিতভাবে জানাতে হবে। সঠিক তথ্যটা তাদের দিতে হবে। কোনো বিভ্রান্তি রাখা যাবে না। সেটা পারিবারিকভাবে না হলে ভিন্ন উদ্যোগে জানাতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ আর যুদ্ধের লক্ষ্য, স্বাধীন দেশের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য এসব বোঝাতে হবে। কোনটা স্বাধীনতার চেতনা আর কোনটা স্বাধীনতার চেতনা নয়, তার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট করে তুলে ধরতে হবে। কারণ আজকের শিশু, তরুণ যুবারাই আগামীর ভবিষ্যৎ। তারাই আমাদের নতুন দিনের পথ দেখাবে। তাদের দেখা পথটা যেন সঠিক হয়, তাদের সিদ্ধান্তের ওপর যেন আমরা ভরসা করতে পারি, সেভাবে গড়ে তুলতে হবে।

শিক্ষক যদি ক্লাসে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনাকে কোমলমতি শিশুদের শোনাতে পারে, এ জাতির বীরত্বের ইতিহাস বলতে পারে, তা হলে সবচেয়ে ভালো হয়। এর ফলে ক্লাসের মনোযোগও বৃদ্ধি পাবে আবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারবে। কারণ ছোট থেকেই যদি তাদের মুক্তিযুদ্ধ চেতনা, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে বড় হয়ে তারা কোনো অন্যায় করতে গেলে অন্তত ক্লাসে বলা শিক্ষকের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা মনে পড়বে। সবার যদি মনে নাও পরে সমস্যা নেই, কয়েকজনেরও যদি মানসিকতায় পরিবর্তন আনা যায়, তা হলেই আমাদের সার্থকতা। পরিবর্তন এক দিনে আনা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল একটা দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়া। অসাম্প্রদায়িক চেতনা গড়া। একটা বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। মুক্তিযোদ্ধারা একটি স্বাধীন দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন একটি সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য। এসব কিছুই তাদের বোঝাতে হবে, জানাতে হবে। বর্বরতম গণহত্যার ধ্বংসাবশেষ থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হওয়ায়, কাউকে যেন দেশের মাটিতে তার ধর্মের কারণে বঞ্চনার শিকার হতে না হয় এটি ছিল প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার গণতন্ত্র ও সাম্যের প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি আরও একটি সংকল্প, সম্ভবত আমরা সেই অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হয়েছি।

বাংলাদেশ গঠনের সময় ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং এটি আমাদের মুক্তি সংগ্রামের গভীরে প্রোথিত একটি বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা- এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা ওপর একটি বড় আকারের আক্রমণ আসে। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে সংবিধানে বিভিন্ন ধরনের সংশোধনী এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে এরকম সাংবিধানিক ধারাগুলোকে ধীরে ধীরে গুরুত্বহীন করে দেওয়া হয়।

আজকের দিনের সবচেয়ে বড় সংকট, বাংলাদেশের সব গৌরবময় অর্জন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের তাৎপর্য গভীরভাবে অনুধাবন করে ১৯৭১ সালকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে হবে। আমরা আমাদের সমাজের একটি মৌলিক সংস্কারের জন্য সংগ্রাম করেছি, যা একাধারে সব ধরনের পশ্চাদপদতা, ঘৃণা, অক্ষমতা ও সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে মুক্তি দেবে এবং অন্যদিকে সব ধরনের দারিদ্র্য ও বৈষম্য থেকে মুক্তি দেবে।
সামাজিক বিচ্ছিন্নতার বিষয়টিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য। আমরা সম্ভবত সামাজিক সমস্যাগুলোকে নিজেদের কাঁধে নিয়ে সেগুলো সমাধানের উদ্যোগ নিতে আর ইচ্ছুক নই। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের অভাবের বিষয়ে আমাদের গভীরভাবে এবং বিস্তৃৃত পরিসরে চিন্তা করতে হবে এবং বুঝতে হবে এখানে কী ঘটেছে। পাকিস্তানের আধিপত্য ও তাদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের অন্যতম অস্ত্র ছিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, গ্রাম পর্যায়ে সাংস্কৃতিক কর্মকা- প্রায় উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি। এক্ষেত্রে আমরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত অনুষ্ঠানের কথা বলছি না, বরং যে অনুষ্ঠানগুলো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আয়োজিত হতো, সেসব সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের অনুপস্থিতি আমাদের তরুণ সমাজকে তাদের ঐতিহ্য, নিজস্বতা ও গর্বের বিষয়গুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করছে এবং ফলে তৈরি হওয়া শূন্যস্থান পূর্ণ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অশুভ শক্তির প্রভাব দিয়ে।

আমরা আজ যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি, তা মোকাবিলা করতে হলে জনমানুষের ভেতরে আরও সংহতি প্রয়োজন, বিশেষ করে রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সংগঠন, তরুণ, সুশীল সমাজ, এনজিও, গণমাধ্যম এবং সকল বিশ্বাস ও মতাদর্শের মানুষের মধ্যে। সারা দেশ জুড়ে একটি গণসচেতনতামূলক প্রচার চালানো দরকার। যেখানে বিস্তৃত পরিসরে জানানো হবে, কেন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল এবং কী কারণে লাখ লাখ মানুষ ১৯৭১ সালে তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি; কিন্তু শুনেছে বা বইয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এখন কথা হলো, তারা যেখান থেকে পড়েছে সেগুলো কতটুকু সঠিক, তাও দেখার বিষয়। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম কি সঠিকভাবে আমাদের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরেছেন? নাকি আমরা তরুণ প্রজন্মের সবাইকে বিকৃত ইতিহাস জানিয়ে বিভ্রান্ত করেছি? এই বিষয়ে তরুণদের সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত। তরুণদের বা নতুন প্রজন্মের জানা উচিত সঠিক ইতিহাস।

মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে বাঙালি জাতির শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো একটি জাতির স্বপ্নের নাম। যে স্বপ্ন জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। যে চেতনা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল একটি গণতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায়।

বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের গৌরবজনক ঘটনা বা অধ্যায় হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ৩০ লাখ শহীদের বুকের তাজা রক্ত, লাখ লাখ মা-বোনের সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে একাত্তরের ৯ মাস যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। যত দিন বাঙালি জাতি থাকবে, ততদিন এই মুক্তিযুদ্ধই থাকবে শ্রেষ্ঠ গৌরবের অধ্যায় হিসেবে, অবিস্মরণীয় এক গৌরবগাথা হিসেবে। কারণ, বাঙালি জাতি জন্ম থেকেই কোনো না কোনো শাসক দ্বারা শোষিত হয়েছে, অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না-হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। যে নেতার জন্ম না হলে, যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি, সেই বাংলাদেশ পেতাম না।

আজকের তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য দরকার মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তাদের সামনে উপস্থাপন। সঠিক তথ্যটি তাদের সামনে তুলে ধরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি জাতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার সব ধরনের ব্যবস্থাই নিয়েছিল পাকিস্তানিরা। এ কারণেই তারা দেশের শ্রমজীবী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের হত্যা করেছিল। যারা বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছিল বাঙালি জাতি কীভাবে তাদের পরাজিত করেছিল তার সঠিক ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা সবারই দায়িত্ব ও কর্তব্য।

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে পরিবারের সদস্যরা। কারণ পরিবারের কাছে একটি শিশু অথবা কিশোর প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে। পরিবার যদি তাকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটি জানায় তাহলে নতুন প্রজন্মের বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম।

আমাদের স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সবার সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে কতটুকু সফল? আমরা লক্ষ্য করি, যে সময় যে সরকার আসে, সেই সময় ইতিহাসের বিভিন্ন পরিবর্তন আসে। নিজের চাহিদা বা সুবিধামতো ইতিহাসের পরিবর্তন করে নেয়া হয়। এই পরিবর্তন তো একটি জাতির জন্য সুখের বিষয় নয়। ইতিহাস বিকৃতি একটি জাতিকে ধ্বংস আর বিভ্রান্ত করারই নামান্তর। এখন মক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা করার জন্য নতুন প্রজন্মের পাশে থাকতে হবে এবং পাশে দাঁড়াতে হবে বিজ্ঞ অভিভাবকদের। তারুণ্য একটি প্রাণশক্তি, যা অফুরন্ত সম্ভাবনা ও বর্ণিল স্বপ্ন দ্বারা উজ্জীবিত থাকে। একটি স্ফুলিঙ্গ তারুণ্যকে উদ্দীপ্ত শিখায় পরিণত করতে পারে, যা হয়ে উঠতে পারে নক্ষত্রের মতো সমুজ্জ্বল। তরুণদের স্বপ্নগুলো হবে বাংলাদেশের স্বপ্ন, ভাবনাগুলো হবে বাংলাদেশের ভাবনা, কাজগুলো হবে বাংলাদেশের কাজ। এতেই গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, বাস্তবায়িত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.