জমে উঠছে নির্বাচন
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : জোট নিয়ে নানা সমীকরণ, চলছে দলগুলোর দৌড়ঝাঁপ।
আর মাত্র ৪৩ দিন পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা বেড়ে গেছে। কে কার সঙ্গে জোট করবেÑ এ নিয়ে চলছে নানা সমীকরণ। এ ছাড়া কোন দল কোন কৌশলে নির্বাচন করবে, কারা দল বা জোটে না গিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেÑ এ নিয়ে চলছে দৌড়ঝাঁপ। সারাদেশে সম্ভাব্য প্রার্থীদের গণসংযোগ চলছে। এর ফলে জমে উঠেছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ছোট-বড় অর্ধশতাধিক দল নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় হয়ে পড়লেও রাজপথের বিরোধী দলখ্যাত বিএনপি ভোটে অংশ নেবে কি নেবে না, রয়েছে এখনো সিদ্ধান্তহীনতায়। এ পরিস্থিতিতে দলটির অনেক নেতা ও সাবেক এমপি বিভিন্ন দলের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েছেন।
৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই পাল্টে গেছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দল ইতোমধ্যেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। আরও কয়েকটি নিবন্ধিত দল দুই-একদিনের মধ্যেই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেবে। দেশব্যাপী নির্বাচনের আমেজ শুরু হয়েছে তফসিল ঘোষণার পর থেকেই। নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলগুলো মনোনয়নপত্র বিতরণ শেষে এখন প্রার্থী চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে। দুই-তিনদিনের মধ্যেই আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএফ, যুক্তফ্রন্টসহ বিভিন্ন দল ও জোট প্রার্থী চূড়ান্ত করে ফেলবে।
এরই মধ্যে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে চলছে রাজনৈতিক জোট গঠনের প্রক্রিয়া। কোন দল কার সঙ্গে জোট করবে, সে জন্যই চলছে শেষ মুহূর্তের হিসাব-নিকাশ। সেই সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে চলছে দরকষাকষি। এর মাধ্যমে কীভাবে দলের জন্য বেশি আসন নেওয়া যায়, সে চেষ্টাও চলছে। নির্বাচনে বিজয়কে টার্গেট করেই সবকিছু করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
এক দফা দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে থাকা বিএনপি কি করবে, এখনো সিদ্ধান্তহীনতায়। এ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত তিনটি রাজনৈতিক দলÑ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ও জাতীয় পার্টি (মতিন) বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করে যুক্তফ্রন্ট নামে নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন করেছে। এই জোট এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নির্বাচন করতে চায়। এ ছাড়াও বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা আরও কয়েকটি দল নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা যায়। ঘোষিত তফসিল অনুসারে ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। তাই ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বিএনপির সঙ্গে থাকা আরও কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় প্রার্থী দিতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্র জানিছে।
সূত্র জানায়, আন্দোলন সফল না হওয়ায় বিএনপি এখন রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায়। নির্বাচন নিয়ে বিদেশীদের তৎপরতাও আগের মতো নেই। সরকার ও নির্বাচন কমিশন বিদেশীদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, সে জন্য নির্বাচন কমিশনসংশ্লিষ্ট সবাই অধিকতর তৎপর।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বলছেন সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন তারা করবেন। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির একাংশ নির্বাচনে যেতে চাইলেও হাইকমান্ডের গ্রিন সিগন্যাল না পাওয়ায় প্রকাশ্যে বলছেন না। দলটির অন্য অংশও নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে নিমরাজি। তবে তারা চায় ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সমঝোতা হলে নির্বাচনে যেতে। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপিকে আগে নিশ্চয়তা দিতে হবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বর্জন করা যাবে না। নির্বাচনকে কলুষিত করার জন্য ভোটে অংশ নেওয়ার কোনো মিশন থাকলে হবে না। তবে গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচন করতে চাইলে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ওয়েলকাম জানাবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন পুনর্তফসিল ঘোষণা করে সাংবিধানিক নিয়মে থেকে নির্বাচনের তারিখ কিছুদিন পেছালে আওয়ামী লীগ আপত্তি করবে না।
তফসিল ঘোষণার আগে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না- এ নিয়ে কিছুটা সংশয় থাকলেও এখন দলগুলোর অংশগ্রহণ আশানুরূপভাবে বাড়ছে। দোটানায় থাকা জাতীয় পার্টিও এখন পুরোদমে নির্বাচনের মাঠে। এ দলটি ৩০০ আসনে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে এখন প্রার্থী চূড়ান্ত করতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করে আসা তিন দল আরও কয়েকটি ছোট দলকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে ১০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করার কাজ করছে। তৃণমূল বিএনপির সঙ্গে আগেই আরও কয়েকটি দল জোট করার কথা জানালেও এখন নতুন করে আরও দুটি ছোট দলের জোট তৃণমূলের সঙ্গে এসে এ জোটের পরিধি বৃদ্ধি করেছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি ইসলামি দল মিলেও একটি রাজনৈতিক জোট করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে ২৮টি দল সংসদ নির্বাচনের ভোটে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সেগুলো হচ্ছে- আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণতন্ত্রী পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), জাতীয় পার্টি (জেপি), তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম এল), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, বাংলাদেশ কংগ্রেস, গণফোরাম, জাকের পার্টি, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (মুক্তিজোট) ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম)।
আর এখনো নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলছে যে কটি দল তার মধ্যে রয়েছে- বিএনপি, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ, রব), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ)। তবে ইসলামিক আন্দোলন বাংলাদেশ (হাতপাখা) ২৫ নভেম্বর বরিশালের চরমোনাইয়ে মাহফিল শেষে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করবে। জানা যায়, ওই দিন নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারে ইসলামিক আন্দোলন বাংলাদেশ।
এদিকে বাংলাদেশ কংগ্রেস সম্মিলিত মহাজোট করে নির্বাচন করবে বলে দলটির মহাসচিব অ্যাডভোকেট মো. ইমরুল ইসলাম জানিয়েছেন। এ জোটে থাকছে কাজী রেজাউল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় জোট, আলহাজ আবু নাসের ওয়াহেদ ফারুকের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ইসলামী ঐক্যজোট, মো. আবু আহাদ আল মামুনের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জাতীয় জোট, মির্জা আজমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ স্বাধীন জোট, প্রিন্সিপাল এম আর করিমের নেতৃত্বাধীন পলিটিক্যাল পার্লামেন্ট আ্যালায়েন্স (পিপিএ), এস এম আশিক বিল্লার নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক জোট বাংলাদেশ, ফয়েজ হোসেনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স ও অধ্যক্ষ গোলাম মোর্শেদ হাওলাদারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় ইসলামী জোট (বিএনআইএ)।
সূত্রমতে, রাজপথে আন্দোলনে থাকা বিএনপি এখন পর্যন্ত নির্বাচনে আসার পক্ষে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও দেশের রাজনীতিতে নতুন কোনো মোড় নিলে যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, সে জন্য দলটির প্রস্তুতি রয়েছে। তবে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে দলটির শতাধিক নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য বিভিন্ন দলের হয়ে নির্বাচন করবে। সে ক্ষেত্রে তৃণমূল বিএনপি ৩০০ আসনে প্রার্থী দিচ্ছে, যেখানে বিএনপি ছেড়ে আসা নেতারাও থাকবেন।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ৩০ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর, রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কমিশনে আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তি ৫ থেকে ১৫ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর। নির্বাচনের প্রচার চলবে ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত। ভোটগ্রহণ হবে ৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন। আর নারী ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার হচ্ছে ৮৫২ জন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের জন্য আলাদা আলাদা ভোটার তালিকার প্রস্তুত করেছে ইসি। এই তালিকা অনুযায়ী প্রতিটি সংসদীয় আসনের ভোটগ্রহণ করা হবে।
এবার ৩০০টি সংসদীয় আসনে ভোটকেন্দ্র থাকছে ৪২ হাজার ৩৮০টি। আর ভোটকক্ষ থাকছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৬৬৮টি। প্রতিটি ভোটকক্ষের জন্য একটি করে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স রাখা হবে। এ ছাড়া প্রতি কেন্দ্রে একটি করে অতিরিক্ত ব্যালট বাক্স দেওয়া হবে। সে হিসাবে সংসদ নির্বাচনে ৩ লাখের বেশি স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রয়োজন হবে। ভোটগ্রহণের জন্য এবার ১০ লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ৩০০ আসনে নির্বাচনের জন্য ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার এবং ৫৯২ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ইতোমধ্যেই অনেক দল ও জোট নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রার্থী বাছাই শুরু করেছে। আরও অনেক দল আসবে। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শত ফুল ফুটবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, দেশে নির্বাচনের পরিবেশ না থাকলেও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। তাই আমরা তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা এখন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় করতে আন্দোলন করছি। অবিলম্বে আমাদের দাবি মেনে নিতে হবে।
তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী জানান, দেশের জনগণের কাছ থেকে আমরা নির্বাচনের বিষয়ে অসাধারণ সাড়া পেয়েছি। অনেকেই আমাদের সঙ্গে নির্বাচন করতে চান। প্রার্থী চূড়ান্ত করে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা করব। তিনি বলেন, যারা আমাদের সঙ্গে জোটে আসছে বা ব্যক্তিগতভাবে আমাদের দলে এসে নির্বাচন করতে চান, তাদের আমরা স্বাগত জানাব।