নতুন মুদ্রানীতিতে প্রাধান্য পাচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিয়ে এবং জীবনযাত্রার খরচ সহনীয় পর্যায়ে আনার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আজ ঘোষণা হচ্ছে চলতি অর্থবছরের বাকি ৬ মাসের জন্য মুদ্রানীতি। এবারো নীতি সুদের হার আরেক দফা বাড়িয়ে টাকাকে আরো দামি করার পরিকল্পনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনীতির চলমান সংকট মেটাতে মুদ্রানীতি নয়, বরং বাজার ব্যবস্থার তদারকির পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে আজ বুধবার বিকাল ৩টায় জানুয়ারি-জুন মেয়াদের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার কথা জানানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর দ্রুততম সময়ে শপথ শেষে গঠিত হয়েছে নতুন সরকার। অর্থ-বাণিজ্য ও পরিকল্পনায় নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী যখন দায়িত্ব নিলেন তখন অর্থনৈতিকভাবে বেশ সংকটে দেশ। মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া মুদ্রানীতির খুব একটা প্রভাব দেখা যায়নি অর্থনীতিতে। দেশের মানুষকে প্রতিটি পণ্য ও সেবার জন্য আগের বছরের তুলনায় গুণতে হচ্ছে বাড়তি
প্রায় ১০ টাকা, দফায় দফায় দাম পরিবর্তন করেও বাগে আনা যাচ্ছে না ডলার। কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। পণ্যের আমদানি কমলেও, খরচ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। সেই তুলনায় প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে নেই কাক্সিক্ষত আয়। আর এতেই কমছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত। নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ বিনিয়োগকারীদের না থাকলেও বাড়ছে সুদের হার, একে ব্যবসা ও বিনিয়োগে অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলছেন বিনিয়োগকারীরা।
দেশের ব্যাংক খাতেও অনিয়ম-দুর্নীতির লাগাম কোনোভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটি। রেকর্ড খেলাপি ঋণ নিয়ে চলছে ব্যাংক খাত। গত কয়েক বছরে এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ডলার সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং তারল্য সংকট। তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো প্রতি কার্যদিবসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করছে। অপরদিকে অনেক ব্যাংক এখন সরকারি ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করছে। সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদের হার ১১ দশমিক ১৫ শতাংশে উঠেছে।
দেশের অন্যতম বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি। সদ্য সমাপ্ত ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ৯ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে ছিল। ২০২৩ সালে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ও সার্বিক মূল্যস্ফীতি- দুটিই রেকর্ড গড়েছে। গত আগস্টে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে ওঠে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান জানান, অর্থনীতির সামগ্রিক সূচকগুলো পর্যালোচনা করে আমরা মুদ্রানীতি প্রণয়ন করেছি। এ মুহূর্তে আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। লক্ষ্য বাস্তবায়নে সংকুলানমুখী মুদ্রানীতিই প্রণয়ন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, এবারের মুদ্রানীতিতে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে সব কিছু এখনই বলা যাচ্ছে না। মুদ্রনীতি ঘোষণার সময়ই বিস্তারিত জানানো হবে। এরই মধ্যে মুদ্রানীতির মৌলিক কাঠামো চূড়ান্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ২০২৩ সালের পুরো বছর বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাতেই গেছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, আশা করা যাচ্ছে নতুন বছরের জুনে তা ৬ বা ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
তিনি আরো বলেন, করপোরেট গভর্ন্যান্স নিয়ে কাজ শুরু করেছি, যা নতুন বছরেও অব্যাহত থাকবে। আমানতকারীদের স্বার্থে যে কোনো পদক্ষেপ বাংলাদেশ ব্যাংক নেবে। কারণ আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা দেয়াই হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মূলনীতি।
প্রায় ২ বছর ধরে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। আর অর্থনীতির ভিতকে ধারাবাহিকভাবে দুর্বল করছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্রমাগত ক্ষয়। শ্লথ হয়ে এসেছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দুই প্রধান উৎস- রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। এতে প্রায় দুই বছর ধরে চলে আসা ডলার সংকট আরো তীব্র হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজার ও আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারলে ব্যর্থ হবে সব উদ্যোগ। আর এ জন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, আগে থেকে মুদ্রানীতির খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করা হলেও নতুন অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছে।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ঋণের সুদহারকে ১৬-১৮ শতাংশে নিয়ে যেতে হতে পারে। ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহার এখনই প্রায় ১২ শতাংশে উঠে গেছে। এটিকে প্রতি মাসে ১ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়া পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। এজন্য সরকারের প্রস্তাবিত বাজেট বা ব্যয়ের লক্ষ্য অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা কমিয়ে আনা দরকার। এটি হলে নতুন টাকা ছাপানোর প্রয়োজন হবে না।
শুধু সুদহার বাড়িয়ে-কমিয়ে দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ অর্থনৈতিক অন্য সংকটগুলো কাটিয়ে উঠতে হলে সুশাসন ও সংস্কার লাগবে। বিশেষ করে ব্যাংক খাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর সুপারভিশন দরকার। করপোরেট সুশাসন না থাকলে কোনো নীতিতত্ত্বই কাজে আসবে না।