এক জোড়া কালো চশমার কাহিনী – মোহীত উল আলম

0

এক জোড়া কালো চশমার কাহিনী

মোহীত উল আলম

আমার একবার ‘চোখ উঠেছিল’। মানে ছোঁয়াছে রোগ কন্জান্কটিভাইটিসে ধরেছিল। তখন এক জোড়া কালো চশমা পরেছিলাম। চশমা জোড়া কিনেছিলাম ২০০৪ সালে খুলনার মিনাবাজার থেকে। মাত্র পঁচিশ টাকা দিয়ে। সে সময়ে প্রিমিয়ারের ইংরেজি বিভাগ থেকে আমরা কিছু শিক্ষক আর কিছু ছাত্র-ছা্ত্রী মিলে সুন্দরবন বেড়াতে গেছিলাম। নিজেকে স্মার্ট দেখানোর জন্য ঐ চশমাজোড়া কিনে পুরো ভ্রমণটা সারি। কিন্তু চট্টগ্রামে ফেরার পর লক্ষ করলাম যে আমি যেহেতু পাওয়ার চশমা পরি, সেহেতু শুধু কালো চশমা পরলে আমার দেখতে অসুবিধা হয়। তো একদিন আরেকদিন চোখ উঠলো, মানে আবার কনজান্কটিভাইটিসে আক্রান্ত হলাম। ঐ সময়ে দুই তিনদিন চশমাটা পরলাম, চোখ নেমে গেলেও কিছুদিন স্টাইল করে নরম্যাল চশমার ওপর কালো চশমাটি পরে ঘোরাঘুরি করলাম। তখন সেলফির যুগ অতটা তেজে শুরু হয় নি। সম্ভবত ফেইসবুকও তখন বাংলাদেশে ঢোকেনি। তো এরপর চশমাটা হারিয়ে ফেললাম।

‘বৎসর, বৎসর চলে গেল, দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল, পশ্চিম সাগরতীরে, কে তুমি? পেল না উত্তর।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বিখ্যাত কবিতার মতো কালো চশমা যখন পরলাম কয়েকদিন, তখন ‘কে তুমি?’ বলে সবাই জানতে চাইলো আমার পরিচয়।

আরও বৎসর বৎসর চলে গেল। লিয়াকত আলী চৌধুরী নামক একজন বর্ষীয়ান প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী আমার খোঁজ পেলেন। ২০১৮ সাল বা ’১৯ হবে। বললেন, গ্রামে তিনি একটা স্কুল করেছেন, ওটার বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যেতে হবে। তখন ইস্ট ডেল্টার মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক সিকান্দার খান স্যার প্রধান অতিথি আর আমি বিশেষ অতিথি হিসেবে গেলাম। স্যারের কী জরুরী কাজ থাকাতে তিনি প্রধান অতিথির বক্তৃতা আগেই দিয়ে আনোয়ারার দক্ষিণ বন্দর থেকে শহরে ফিরে গেলেন। তখন বক্তৃতা দেবার পুরো দায়িত্বটা আমার ওপর পড়ল। মাইক পেলে ছাড়াছাড়ি নেই, বাঙালীর এই মহৎ গুণের খানিকটা আমার মধ্যে আছে। ঝাড়া একটা বক্তৃতা দিলাম প্রায় ঘন্টাখানেক, এবং শেষে বলেছিলাম, আমি তাঁদের ওখানে গিয়ে খুব প্রীত হয়েছি, এবং আবার ডাকলে আবার আসব। তবে এই প্রত্যয়ের পেছনে খানিকটা রোম্যান্টিকতা আছে। ঐ গ্রাম থেকে অল্প দূরে আমার এক আপার বিয়ে হয়েছে, সে ১৯৭১ সালের ১৫ জানুয়ারি। তখন একবার শহরের ছেলে বা শহুরে কাক হিসেবে গ্রামে বেড়াতে যাবার ছলে আপার সঙ্গে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যাই। আবিস্কার করি যে আপার দু’টো ননদ আছে যারা আমার চেয়ে ছোট কিন্তু কাছাকাছি বয়সের। যে ক’দিন ছিলাম আমার প্রারম্ভিক যুবক বয়স আর তালতোবোনদের কাছাকাছি বয়স হওয়াতে বেশ গল্প-গুজব হাসি ঠাট্টা চলতেই থাকে। তো সেদিন বক্তৃতার সময় যেহেতু আমার আপার শ্বশুরবাড়িটা দক্ষিণবন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের থেকে বেশ কাছে, আমার মনে একটা জিনিষ আরেকটা জিনিষকে মনে করিয়ে দেয়, এবং সেভাবে বহু বছর আগে তালতোবোন দু ‘জনের সঙ্গে আমার রম্য স্মৃতির কথা মনে পড়ল। তখন আমি ঐ প্রসঙ্গ সেখানে টেনে বললাম যে তালতোবোন দু’জনই আমাকে ‘মধু হই হই বিষ খাওয়াইছে’। পুরে অনুষ্ঠানস্থলে হাসির রোল আর যেন থামে না।

২০১৮ বা ’১৯-এর পর বৎসর বৎসর চলে গেল। আবারো উদয় হলেন লিয়াকত আলী চৌধুরী। সরাসরি আমার দপ্তরে হাজির। আগের চেয়ে খানিকটা বুড়িয়ে গেছেন তিনি। আমাকে বললেন, যেতে হবে, এবার স্কুলের দশমবছর পূর্তির অনুষ্ঠান এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা। এবার আমি প্রধান অতিথি, চবির আমার পুরোনো ইংরেজির ছাত্র বর্তমানে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, কবি অধ্যাপক এ এন এম মুজিবু রাহমান আর ড. শামসুদ্দিন শিশির থাকবেন বিশেষ অতিথি হিসেবে। মুজিবকে আমি পছন্দ করি, শিশিরকেও, যদিও আমি জীবনে যে জিনিষটা সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করি সেটি হলো বক্তৃতা দেওয়া। তবুও রাজি হলাম, কারণ লিয়াকত আলী চৌধুরী সাহেব আমাকে মনে করিয়ে দিলেন যে আমি নাকি ডাকলে যাব এরকম বলেছিলাম। আর ঐ স্কুলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং আমার ভালো একজন ফেবু বন্ধু রামচন্দ্র দাশও বারবার তাগিদ দিচ্ছিলেন আমি যেন মিস না করি। গতবারের আমার ব্তৃতাটা উনি পুরোটাই ভিডিও করেছিলেন।

শুক্রবার, ৮ মার্চ শিশির আসলেন লিয়াকত সাহেবের জিপটি নিয়ে। গাড়ির চালক হালিম হলো দশহাতা, মানে সে গাড়ি চালনা, মোবাইল চালনা, ফুল কেনা, লোক খাওয়ানো, সবই এক হাতে করছিল। কথায়ও খুব সরেস। আমি আর শিশির তার সঙ্গে নানান গল্প করতে করতে দক্ষিণ বন্দরে পৌঁছালাম।

লিয়াকত সাহেবের গাড়ি যেমন লেটেস্ট মডেলের তাঁর বাড়িটা আরও লেটেস্ট মডেলের। সেখানে ঢুকে পরিচয় হলো ডা. শাহরিয়ার মামুনের সঙ্গে। কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ আর হাসপাতালের এন্ডোক্রুনোলোজি বিভাগের প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক। ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার ছাত্র-ছাত্রীরা এন্ডোক্রুনোলজি শব্দটা উচ্চারণ করতে পারে। তিনি হেসে দিয়ে বললেন, পারে।

লিয়াকত সাহেবের বাসায় চা-নাস্তা সারার পর স্কুলের অনুষ্ঠানস্থলের দিকে রওয়ানা হলাম। দু’পাশে সারিবদ্ধ ছেলেমেয়েদের মধ্য দিয়ে আমরা ক্রমশ মঞ্চের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। ওরা ফুলের সাজি থেকে ফুল ছুঁড়ে মারছিলো। অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা কম ছুঁড়ে মারবে কেন? প্রায় ফুলে ফুলে গোসল করে ফেললাম। তখন একটা আবিস্কার মাথায় এলো। আমার মাথায় ব্রাইলক্রিমের পরশ মাখানো, ফলে চুল একটু আঠা আঠা থাকাতে ফুলগুলি চুলের সঙ্গে প্রায় সেঁটেই ছিল। আচ্ছা, আমার মনে হলো, হঠাৎ যদি ফুলগুলি গাছ হয়ে আমার মাথায় গজাতে থাকে? তো সেই ভাবনা থেকে একটা কবিতা “চাপ” শীর্ষক লিখে ফেবুতে দিলাম। কয়েকজন পড়ে বলল, তাদের খুব ভালো লেগেছে।

এবারের অনুষ্ঠানাদি চলছিল খুব ঢিমা চালে। তাই ব্কৃতৃতা দিতে গেলাম দীর্ঘ সময় পরে। তেমন যুৎ পাচ্ছিলাম না, মানে অনর্গল শব্দের পর শব্দ ফুটে উঠছিল না। যা হোক একটু সিরিয়াস বক্তৃতাই দিলাম। চমৎকার বলল মুজিব। আমি মনে মনে ওকে খুব প্রশংসা করলাম। যা হোক, রাত্রের অতি রসনাপূর্ণ খাওয়া দেয়ে সেরে আবার হালিমের গাড়িতে উঠলে সে বলল, এবার সে আমাদেরকে বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে শহরে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। চমৎকার একটা নৈশ ভ্রমণ হলো। মুজিব আর শিশির দু’জনই রসিক, কাজেই সময়টা কাটলো ভালো। আর মুজিব আহসান হাবীবের একটি অত্যন্ত ভালো দীর্ঘ কবিতা এত চমৎকার আবৃত্তি করে গেল মুখস্ত যে আমি বুঁদ হয়ে শুনলাম।

বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল প্রায় সাড়ে এগারটা। হাতে আমার ফুলের তোড়া আর একটি ল্যাপটপের ব্যাগের মতো ব্যাগ। খুকু ফুলটা নিল, আর আমি বাথরুমে ফ্রেশ হতে ঢুকলে সে ব্যাগটি খুলে দেখে সেখানে স্কুলের তরফ থেকে তথা লিয়াকত আলী চৌধুরীর তরফ থেকে উপহার হিসেবে দেওয়া ‘একটাটাল’ সামগ্রী। একটি অত্যধুনিক ডাইরিতো আছেই, সাথে কলম আর মগ, ওমা, সাথে একটা কালকুলেটর, একটি কালো টি শার্ট, আর এক জোড়া খুব দামী কালো চশমা। আমি কোন জিনিষ উপহার পেলে সেটি সাথে সাথে ব্যবহার করি। তো ঐ রাতেই টিউব লাইটের আলোয় কালো টি শার্টটা গায়ে চড়ালাম, আর কালো চশমা জোড়া চোখে পরলাম। একেবারে সেই জিরো জিরো সেভেন জেইমস বন্ড—শঁ কনেরি। নিজস্বী তুলে তক্ষুণি তক্ষুণি ফেবুতে চড়িয়ে দিলাম। তখন খেয়াল করলাম যে চিবুক আমার দুইদিনের আনশেইভড করা—ব্যস্ততার জন্য সময় পাই নি, তবে এখনকার স্টাইলের সঙ্গে যায়। একটু আনশেভেন চিবুক সম্ভবত হি-ইমেজ বাড়ায়। কিন্তু ’এক্সরে আই’ধারী আমার স্নেহের সহকর্মী আলমগীর মুহাম্মদের কাছে ধরা খেলাম।

লিয়াকত আলী চৌধুরীকে ধন্যবাদ এমন একটি সুন্দর, মনে মনে যেটি চাইছলাম, সেটি উপহার দেবার জন্য। দক্ষিণ বন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।

=শেষ=
ভ্রমণ: ৮ মার্চ ২০২৪।
রচনা : ২৫ মার্চ ২০২৪।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.