বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৩৮৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে দেশে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশ বেশি। নিট এফডিআই বেড়েছে আরও বেশি, প্রায় ৬০ শতাংশ।
আর মাত্র ২০ দিন! তার পরই বাংলাদেশের মানুষের বহুল প্রতীক্ষিত একটি স্বপ্ন পূরণ হবে; ২৫ জুন চালু হবে পদ্মা সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করবেন। শনিবার সন্ধ্যায় সেতুতে পরীক্ষামূলকভাবে বাতি জ্বালানো হয়েছে।
ঐতিহাসিক এই মুহূর্তটিকে ঘিরে দেশে-বিদেশে চলছে আলোচনা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা। অর্থনীতিতে নতুন প্রাণসঞ্চারের আশা করছেন সবাই। যার ঢেউ বিদেশি বিনিয়োগেও পড়েছে। পদ্মা সেতু ঘিরে দেশে বিনিয়োগের যে আবহ তৈরি হয়েছে তার প্রভাব বিদেশি বিনিয়োগেও পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার দেশে বিদেশি বিনিয়োগের সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৩৮৮ কোটি ২০ লাখ (৩.৮৮ বিলিয়ন) ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে দেশে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশ বেশি।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই ১০ মাসে ২৮১ কোটি ১০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। দেশে আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়তে শুরু করেছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই দেশে বিনিয়োগের আবহ তৈরি হয়েছিল। জুনে পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হবে, সেই খবরে কয়েক মাস ধরেই দেশে বিভিন্ন খাতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছিল। সে কারণেই শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারি, পরিবহন খাতের বাস-ট্রাক তৈরির যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য খাতের সব ধরনের যন্ত্রপাতি-সরঞ্জাম আমদানি বেড়েছে। সব মিলিয়ে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে।
আর ‘দেশি বিনিয়োগ বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে’ অর্থনীতির এই সূত্রকে সত্যি প্রমাণ করেই দেশে এখন বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে নিট এফডিআই বেড়েছে আরও বেশি, প্রায় ৬০ শতাংশ। এই ১০ মাসে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে নিট বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ১২১ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরের ৩৩৮ কোটি ৬৮ লাখ ৬০ হাজার ডলারের (৩.৩৮ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছিল বাংলাদেশে। ওই অঙ্ক ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে মাত্র ৪ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২৫০ কোটি ৭৩ লাখ (২.৫০ বিলিয়ন) ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২৩ কোটি ৩০ লাখ (৩.২৩ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ১২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার।
২০১৮-১৮ অর্থবছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল দেশে। এর মধ্যে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২৬৩ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসে ওই বছর। এর মধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে জাপানের কোম্পানি জাপান টোব্যাকো। আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কেনা বাবদ প্রায় ১৫০ কোটি (১.৫ বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছিল তারা।
এবার যে গতিতে দেশে এফডিআই আসছে, তাতে অর্থবছরের বাকি দুই মাসের (মে ও জুন) তথ্য যোগ হলে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে চলতি অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।
বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট অঙ্ককে নিট এফডিআই বলা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ‘সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ও বিদেশি ঋণ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী বিদেশি বিনিয়োগে মন্দা ছিল। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এফডিআই প্রবাহও বাড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়েছে।
আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে প্রতিবেদনে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা পদ্মা সেতুতে জ্বালানো হয়েছে বাতি। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় তৈরি পোশাক খাতে কোরিয়া, চীন ও হংকং থেকে উল্লেখযোগ্য বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ, ব্যাংক, টেলিকমিউনিকেশন খাতেও কিছু বিনিয়োগ এসেছে। এ কারণেই এফডিআই প্রবাহে গতি এসেছে বলে জানান তারা।
আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, বিদেশি কোম্পানিগুলো তিনভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে। মূলধন হিসেবে নগদ বা শিল্পের যন্ত্রপাতি হিসেবে, বাংলাদেশে ব্যবসা করে অর্জিত মুনাফা বিদেশে না নিয়ে পুনর্বিনিয়োগ করে এবং এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারে।
এ তিন পদ্ধতির যেকোনোভাবে দেশে বিনিয়োগ এলে তা এফডিআই হিসেবে গণ্য করা হয়। ২০১৫-১৬ থেকে ২০২০-২১ এই পাঁচ অর্থবছরে দেশে মোট ২ হাজার ৩৯ কোটি ৫৯ লাখ ডলার (২০.৩৯ বিলিয়ন) এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ১৫ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার।
এই সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা মোট বিনিয়োগের প্রায় ১৭ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে সিঙ্গাপুর। তারা মোট বিনিয়োগের সাড়ে ১৬ শতাংশের মতো বিনিয়োগ করেছে। তৃতীয় অবস্থানে নেদারল্যান্ডসের বিনিয়োগ ৮ শতাংশের মতো। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, চীন, মিসর, যুক্তরাজ্য, হংকং এবং অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ রয়েছে।
এই বিনিয়োগ বাংলাদেশের প্রযুক্তির অগ্রগতি, দক্ষতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উন্নত অবকাঠামো এবং ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগে ইতিবাচক ধারায় সন্তোষ প্রকাশ করে বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের চেম্বার অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও আমদানি-রপ্তানি বাড়ছে। অন্য সূচকগুলোও ভালো।’
তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে অস্থিরতা নেই দীর্ঘদিন। পদ্মা সেতু চালু হয়ে যাচ্ছে। মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলও এ বছরেই চালু হবে। সব মিলিয়ে দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগেও একটি ভালো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। এখন এটাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিলে দেশে এফডিআই আরও বাড়বে।’
সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ব্র্যান্ডিং। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে আমরা এখনও আমাদের ব্র্যান্ডিং যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এ ছাড়া আমাদের বন্দরের সমস্যা আছে। এতদিনেও আমরা আমাদের বন্দরের অটোমেশন করতে পারিনি।’
এগুলো ঠিক হলে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ আসবে বলে আশার কথা শুনিয়ে তিনি বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একা বিনিয়োগ করে খুবই কম। দেশি বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। সে কারণে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে দেশি বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। পদ্মা সেতু ঘিরে এখন যেহেতু দেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগও আসবে।’
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অর্থনীতিতে একটি সূত্র আছে, দেশি বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে না। এই যে প্রচুর আমদানি হচ্ছে, ডলারের চাহিদা বেড়েছে তার মানে এখন দেশে বিনিয়োগ বেড়েছে। আর এ সবকিছুই কিন্তু পদ্মা সেতুকে ঘিরে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু চালু হওয়ার পর যেভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দিয়েছিল, পদ্মা সেতু তার থেকেও বেশি অবদান রাখবে অর্থনীতিতে। এ বিষয়টি দেশি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বুঝতে পেরেছেন। সে কারণেই দেশি বিনিয়োগের সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে আমাদের বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে আছে; জিডিপি ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে। করোনার মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ কিছুটা হলেও বেড়েছিল, বেসরকারি খাতে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। এখন সবকিছু অনুকূলে থাকায় সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে গতি এসেছে। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও নতুন উদ্যমে বিনিয়োগ করছেন। সে কারণেই আমদানি বাড়ছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি বেড়ে প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশে উঠেছে। টানা আট মাস ধরে বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকটি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠেছিল।
তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি কমে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশে নেমে আসে। মার্চে তা দশমিক ৫৭ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে ওঠে। সর্বশেষ এপ্রিল মাসে তা আরও বেড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশে উঠেছে।
অন্যদিকে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৭ হাজার ৪২২ কোটি (৭৪.২২ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪১ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই ১০ মাসে ৫২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪৭ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৪ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।