কেমন আছেন বশেমুরবিপ্রবির সেই মৃত্যুঞ্জয়ী কন্যা সুবর্ণা?
শায়ন মন্ডল : বশেমুরবিপ্রবি প্রতিনিধি: হাজারো ছন্দের বেড়াজালে আবদ্ধ এ মানব জীবন। ছন্দের উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে বহমান জীবনে আসে সুখ -দুঃখ। কখনো সুখের তীব্রতায় জীবনে নেমে আসে স্বর্গ সুখ । আবার কখনোবা দুঃখের প্রখরতায় নরকের তাপদাহে জ্বলতে থাকে জীবন। তারপরেও থেমে থাকে না যুদ্ধ । দীর্ঘ পাঁচ বছর পূর্বের জীবন যুদ্ধে হার না মানা এমন এক নায়িকার নাম সুবর্ণা মজুমদার। তিনি গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী। ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করার প্রারম্ভে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের অনাকাঙ্ক্ষিত এক দুর্ঘটনায় জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যুদ্ধ করে ফিরে আসেন তিনি।
বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার কুরমুনি গ্রামের এক দিনমজুরের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেণ সুবর্ণা । চার বোনের মধ্যে সুবর্ণা দ্বিতীয়। বড় বোনের যথেষ্ঠ মেধা থাকা সত্ত্বেও টাকার অভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়তো দূরের কথা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরমও তুলতে পারেননি। টানাপোড়েন এর সংসারে বাবা পড়ালেখার খরচ চালাতে না পেরে তাকে নবম শ্রেণীতে থাকতেই বিয়ে দেয় একই উপজেলার কালশিরা গ্রামের আশিষ কুমার মন্ডলের সাথে। কোন প্রতিবন্ধকতাই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। সংসারের সব কাজ সামলানোর পরেও লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। এভাবে তিনি এইচএসসি পাশ করেন। তারপর সংসারের বিদীর্ণ অবস্থা দেখে তিনি তার উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে চিন্তায় থাকেন।
ঠিক তখনই তার অনার্স ৪র্থ বর্ষে পড়ুয়া স্বামী ১৫০ টাকা পারিশ্রমিক হিসেবে লাইব্রেরিয়ানের কাজ শুরু করেন। পারিশ্রমিকের প্রাপ্ত টাকা থেকে সংসারের খরচ চালিয়ে ভর্তি ফরম এর টাকা গোছাতে থাকেন। অবশেষে সকল অভাব অনাটন ও সংসারের যাবতীয় কাজ সামলে অদম্য মেধার স্বাক্ষর রাখেন সুবর্ণা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম সারিতে উত্তীর্ণ হন। এরপর নতুন করে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ নিয়ে ভাবনা। তবুও তার স্বামীর অনুপ্রেরণায় উচ্চ শিক্ষার যাত্রা শুরু করেন। শুরু হয় তার স্বপ্নের পথ চলা।
কিন্তু হঠাৎ করে আচমকা থমকে যায় তার পথচলা। দিনটি ছিল রবিবার। সাপ্তাহিক ছুটি শেষে অন্যদিনের মত সেদিনও সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সুবর্ণা তার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারী থেকে এসে ক্যাম্পাসের মেইন গেটের সামনে নামেন। ক্লাসের দেরি হয়ে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি রাস্তা পার হতে যায়। কিন্তু হঠাৎ তার তীব্র আর্তনাদে নিস্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেপরোয়া এক ড্রাইভারের অসতর্কতায় গাড়ির নিচে পড়েন সুবর্ণা। আশেপাশের লোকজন এসে দেখতে পায় তার থেতলে যাওয়া নিথর দেহ।
তৎক্ষনাৎ তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গোপালগঞ্জের সদর হাসপাতলে। সেখানকার চিকিৎসকেরা তার বাঁচার ক্ষীণ সম্ভবনার কথা জানায়।তারা দ্রুত ঢাকা নেওয়ার পরামর্শ দেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে এয়ার এম্বুলেন্স আনা হয় সুবর্ণাকে ঢাকা নেওয়ার জন্য। কোন প্রকার দেরি না করে মুহূর্তের মধ্যে তাকে নিয়ে উড়াল দেয় হেলিকপ্টারটি।
দীর্ঘ সাত দিন ICUতে থেকে পনেরো দিনের মাথায় জ্ঞান ফেরে সুবর্ণার। “আমি কে, তুমি কি আমাকে চেন মা?”, মৃদুস্বরটি ভেসে আসে তার কানে। তখন সে আবছা দৃষ্টিতে একপলক তাকিয়ে জবাব দেয় “জ্বী আমি আপনাকে চিনি, আপনি আমাদের উপাচার্য স্যার।’’ আর তখনই সে নিজেকে প্রথমবারের মত হাসপাতালের বিছানায় আবিস্কার করেন। আস্তে আস্তে মনে হতে থাকে তার সেই পুরনো সাজানো গোছানো জীবনের কথা। নিমিষের মধ্যেই লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সবকিছু। সে তখন মুখ ঢুকড়ে কাঁদতে থাকে আর ভাবতে থাকে, সে হয়তোবা আর তার হারানো জীবনে ফিরে যেতে পারবে না। পঙ্গুত্ব বরণ করে বাঁচতে হবে সারাটি জীবন। তার স্বপ্নগুলো বুঝি এখানেই ধুলিৎসাৎ হয়ে যাবে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. খন্দকার নাসিরদ্দিন এর আন্তরিক প্রচেষ্টায় তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়।তার নির্দেশে ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যায় চলতে থাকে সুবর্ণার উন্নত চিকিৎসা। দীর্ঘ তিন মাস হাসপাতালে থাকাকালীন দুইবার মাথা ও তিনবার পায়ের সার্জারিসহ চিকিৎসার যাবতীয় ব্যায়ভার প্রায় ২০ লাখ টাকা বহন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এত দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে পাঁচ বছর পরে কেমন আছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো বেঁচে আছি তাতেইবা কম কিসের? সৃষ্টিকর্তার অপার করুণা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের আন্তরিক প্রচেষ্টা আজ আমায় এতদূর নিয়ে আসছে।আমি কোনদিন তাদের অবদান বলে শেষ করতে পারবো না।
আসলেই সেই দূরন্তপনা সুবর্ণা কি ফিরে আসতে পেরেছে তার স্বভাবিক জীবন যাত্রায়? জানতে চাইলে তিনি জানান, এখন আর আগের মত স্বাভাবিক জীবনে নেই। মাঝে মাঝে পায়ে ও মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করি। এখনো নিয়মিত ঔষধ চালিয়ে যাচ্ছি ।
এত প্রতিকূলতার মাঝেও সুবর্ণা স্বপ্ন দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হবার।সদ্য শেষ হওয়া স্নাতক শ্রেণিতে ৩.৬০ পেয়েছেন। তার ICU তে থাকাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবরোধ করে বেশকটি আলটিমেটাম দিয়েছিল। এর মধ্যে তার পড়াশোনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সুযোগ করে দেওয়া ছিল অন্যতম একটি দাবি।
এদিকে তৎকালীন সময়ে সুবর্ণার হাসপাতাল থেকে ফেরার এক সপ্তাহের মাথায় পরিবারের একমাত্র অবলম্বন তার স্বামী আশিষ কুমার মন্ডলকে সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন এর নির্দেশে মাস্টাররোলে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। স্বল্পবেতনের চাকুরীর উপার্জন দিয়ে শত অভাব অনাটনের মাঝেও তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। প্রতিনিয়ত প্রহর গুণতে থাকেন স্বামীর চাকুরী স্থায়ী হবার।আশা ছিল স্বামীর বেতনের টাকায় পুনরায় চিকিৎসা করিয়ে স্বভাবিক জীবনে ফিরে আসার। তবে সে স্বপ্ন পূরণ হয় বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুবের উদ্যোগে এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই তার উদ্যোগে সুবর্ণার স্বামীর চাকুরি স্থায়ী করণ করা হয়।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বদা শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমি আসার পরে সুবর্ণার স্বামী সম্পর্কে জানতে পেরেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মানুযায়ী তার চাকরি আমরা স্থায়ীকরণ করেছি। আমি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি।