অর্থনীতিতে তাক লাগানো উত্থান

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : ১৯৭২ সালের ৩০ জুন স্বাধীন বাংলাদেশে সংসদের প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন সেই সময়ের বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। আর সেই বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকার। কিন্তু ৫০ বছর পর চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটের আকারের এই বিশাল পরিবর্তনের পাশাপাশি গুণগত দিক থেকেও বাংলাদেশের অর্থনীতির তাক লাগানো উত্থান হয়েছে। তাই তো স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ওপর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র তকমা লাগানো পশ্চিমা বিশ্ব এখন ৫০ বছর পর এ দেশকে ‘সফলতার উদাহরণ’ হিসেবে চিহ্নিত করছে। বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় সাফল্যের সঙ্গে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজি পূরণের পর থেকেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ পশ্চিমা বিশ্ব।

ধারাবাহিকভাবে সর্বশেষ মূল্যায়ন প্রতিবেদনগুলোতে অভিন্ন শিরোনাম ছিল- ‘বাংলাদেশ, এ সাকসেস স্টোরি’। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সব প্রচলিত ধারণা বা মিথ ভেঙে দিয়ে অনুকরণীয় ভূমিকায় এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মিথের সঙ্গে যে বাংলাদেশের বর্তমান চিত্রের ন্যূনতম মিল নেই সেটাও ঘোষিত হয়েছে ইতিমধ্যে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে। তখন বাংলাদেশ হবে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বর্তমানে অবস্থান ৪১তম। ২০৩৩ সালে আমাদের পেছনে থাকবে মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ। আগামী ১৫ বছর দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ থাকবে। বাংলাদেশ সম্পর্কে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ১২টি দেশকে টপকে গেছে। আগামী ১৫ বছরে টপকে যাবে আরও ১৭টি দেশকে। এই যাত্রার প্রথম পাঁচ বছরে ৫টি দেশকে টপকে যাবে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ হবে ৩৬তম অর্থনীতির দেশ। পরের পাঁচ বছর আরও ৯টি দেশকে পেরিয়ে ২০২৮ সালে হবে ২৭তম বড় অর্থনীতির দেশ। পরের পাঁচ বছরে টপকাবে আরও ৩টি দেশকে।

অন্যদিকে, ১৯৭০ সালের ৬ জুন আওয়ামী লীগ আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয় এই ইশতেহারে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিশ্র“তি দেন যমুনা ও পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণের। দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে ২০১০ সালে এসে বিশ্বব্যাংকসহ কয়েকটি দাতা সংস্থার অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের চুক্তি করে বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্নীতি, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অপবাদ দিয়ে দুই বছর পর সেই চুক্তি বাতিল করে পশ্চিমা মদদপূষ্ট বিশ্বব্যাংক। পরে বিশ্বব্যাংকের বাইরে অন্যদের কাছ থেকে অর্থায়নের চেষ্টা করা হয়। জাইকা, এডিবি, আইডিবি ছাড়াও চীন ও মালয়েশিয়ার কাছ থেকেও ফিরতে হয় খালি হাতে। কিছুতেই কিছু না হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন নিজস্ব অর্থায়নে বিশাল এ প্রকল্প বাস্তবায়নের। এখন ২০২১ সালে এসে পদ্মা সেতু কোনো স্বপ্ন নয়, এটি একটি বাস্তবতা। আশা করা হচ্ছে, আসছে বছরের প্রথমেই সেতুতে চলবে গাড়ি। প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার এই মেগা প্রকল্প নিজের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ।

জানা যায়, কার্যকর মুক্তবাণিজ্য ও টেকসই সাপ্লাই চেইন তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কয়েক দশক ধরে কাজ করছে ইউরোপের বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বৃহত্তম জোট ফরেন ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন বা এফটিএ। বৈশ্বিক বাণিজ্যের বৃহৎ অংশের সরাসরি নিয়ন্ত্রক এখন এফটিএর সঙ্গে থাকা ১৭০০-এর বেশি বৃহৎ ব্র্যান্ড, আমদানিকারক, বিক্রেতা ও জাতীয় সংস্থাগুলো। এফটিএ তাদের মূল ফোকাসে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ‘এফটিএ ফোকাস :  ইজ বাংলাদেশ এ সাকসেস কেস’ শিরোনামের এ প্রতিবেদনে  অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যকে ‘অবিস্মরণীয়’ বলা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রচলিত মিথ বা ধারণা কীভাবে ভেঙে দিয়েছে তার উদাহরণস্বরূপ প্রধান ৩টি মিথ চিহ্নিত করা হয়েছে। এফটিএর প্রতিবেদন বলছে, এত দিন ধারণা ছিল বাংলাদেশ দারিদ্র্যের কশাঘাতে পিষ্ট। কিন্তু বাস্তবতা হলো- বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হাত ধরেই মানবিক উন্নয়ন করেছে। ১৯৯২ সালে থাকা ৫৭ শতাংশ দরিদ্রতার হার ২০১৪ সালে এসে অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে কমিয়ে ২৫ শতাংশে আনতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে মানুষের চাহিদা, স্বাক্ষরতা ও খাদ্য গ্রহণের সক্ষমতাও দ্রুত গতিতে বেড়েছে।

প্রতিবেদনে ‘স্বল্প সংখ্যক ব্যবসায়ীর লাভের প্রবৃদ্ধিই বেশি’ এমন ধারণাকে দ্বিতীয় মিথ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা বোঝাতে প্রতিবেদনে আয় বণ্টনের সর্বজন গৃহীত সূচক গিনি ইনডেক্সের কথা উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের চেয়েও বাংলাদেশে আয় বৈষম্য কম। গিনি ইনডেক্সের পয়েন্ট যদি ‘০’ হয় তাহলে আয়ের সত্যিকার সমতা এবং পয়েন্ট ‘১০০’ হলে সত্যিকার বৈষম্য ধরা হয়ে থাকে। এখানে বাংলাদেশের পয়েন্ট হলো ৩২.১। অথচ চীনের পয়েন্ট ৪২.১ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পয়েন্ট ৪১.১। প্রতিবেদনে ‘জনসংখ্যার আধিক্য রাষ্ট্র ও অর্থনীতির জন্য চাপ’কে তৃতীয় মিথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ধারণাকে বাংলাদেশ ভুল প্রমাণ করেছে উল্লেখ করে এফটিএ বলেছে, বেশি বেশি কাজের সুযোগ তৈরি করে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা যায় তা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া ১৯৮০ সালে যেখানে নারী প্রতি জন্মের হার ছিল ৬ সেটাকেও অত্যন্ত কার্যকরভাবে কমিয়ে এনে ২০১৪-তে ২.২ এনেছে বাংলাদেশ।

প্রতিবেদনে ‘আপনি জানেন কি’ শিরোনামে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ সেই স্বল্প সংখ্যক দেশগুলোর একটি, যারা জাতিসংঘের সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) প্রায় সবই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সেনাসদস্য জাতিসংঘে পাঠানোর কৃতিত্বও বাংলাদেশের। বাংলাদেশ সম্পর্কের মূল্যায়ন অংশে এফটিএর মহাপরিচালক ক্রিস্টিয়ান ইউয়ার্ট বলেছেন, ‘অবিস্মরণীয় উন্নয়নের মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়গুলো অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছে, দেশটি লক্ষ্য পূরণে অনেক দূর পথ হাঁটবে। এই পথপরিক্রমায় আন্তর্জাতিক বিশ্ব ও অন্যদের বাংলাদেশের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.