প্রণোদনা বাড়ার পর বাড়ছে রেমিট্যান্স
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সপ্রবাহে ফের গতি ফিরছে। টানা পাঁচ মাস কমার পর ডিসেম্বরে কিছুটা বেড়েছিল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে সেই গতি আরও বেড়েছে। জানুয়ারির ২০ দিনেই দেশে ১২২ কোটি ৪১ লাখ (১.২২ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১০ হাজার ৫২৭ কোটি ১৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
অর্থনীতির গবেষক ও ব্যাংকাররা বলছেন, নতুন বছরের প্রথম দিন থেকে সরকার রেমিট্যান্সপ্রবাহে নগদ প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে। তারই ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে এই সূচকে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙা হওয়ায় ওই সব দেশ থেকে বেশি রেমিট্যান্স আসছে বলে মনে করছেন তারা।
রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিয়ে আসছিল সরকার। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তা বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
অর্থাৎ কোনো প্রবাসী এতদিন ১০০ টাকা দেশে পাঠালে যার নামে পাঠাতেন তিনি ১০২ টাকা পেতেন। এখন পাচ্ছেন ১০২ টাকা ৫০ পয়সা।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিট্যান্সের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি জানুয়ারি মাসের ২০ দিনে (১ থেকে ২০ জানুয়ারি) প্রবাসীরা বিভিন্ন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ১২২ কোটি ৪০ লাখ ৯০ হাজার ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই ২০ দিনে যে হারে রেমিট্যান্স এসেছে, মাসের বাকি ১১ দিনে যদি সে হারেও আসে তাহলে জানুয়ারিতে মোট রেমিট্যান্সের অঙ্ক গিয়ে ঠেকবে ১৯০ কোটি ডলারে; যা হবে একক মাসের হিসাবে আগের সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এর আগে ২০২১ সালের জুনে ১৯৪ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। জানুয়ারি মাসের ২০ দিনে যে রেমিট্যান্স এসেছে, তার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। ৪২টি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৯৬ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। আর পাঁচটি বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫২ লাখ ডলার।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়ার সময় সারা বিশ্বই মহামারিতে কাঁপছিল। আশঙ্কা করা হয়েছিল, প্রবাসী আয়ে ভাটা পড়বে। কিন্তু অবিশ্বাস্য উত্থানে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে চাপ পড়তে দেননি। টানা দেড় বছর বাড়ার পর গত বছরের জুলাই থেকে ক্রগামত কমতে থাকে রেমিট্যান্স।
তবে বছরের শেষ পাঁচ মাস ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির পরও ২০২১ সালে ২ হাজার ২০৭ কোটি (২২.০৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছিল বাংলাদেশ, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এর আগে এক বছরে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০ সালে, ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে এসেছিল ১৮ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার।
অর্থবছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) ১ হাজার ২৩ কোটি (১০.২৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ২৯৪ কোটি ডলার। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ২৭০ কোটি ডলার বা ২০ দশমিক ৯ শতাংশ।
তবে নতুন বছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্সপ্রবাহ ফের বাড়বে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মহামারির মধ্যে একটা ভিন্ন পেক্ষাপটে রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন হয়েছিল। যার কাছে যা জমানো টাকা ছিল পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনে সব দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল। করোনায় সবকিছু বন্ধ থাকায় অবৈধ পথে (হুন্ডি) কোনো রেমিট্যান্স আসেনি; সব এসেছিল ব্যাংকিং চ্যানেলে। সে কারণেই গত অর্থবছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল।
‘এরই মধ্যে দুটি সুসংবাদ এসেছে। তিন বছর পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে; ফের শ্রমিক যাবে সেখানে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙা হয়েছে। সেখান থেকে বেশি রেমিট্যান্স আসবে। আরেকটি সুখবর হচ্ছে, সরকার ১ জানুয়ারি থেকে রেমিট্যান্সের প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্সে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমরা সেই প্রভাব দেখতে পাচ্ছি।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ কথা ঠিক যে চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্সপ্রবাহে ধীরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু সেটা গত অর্থবছরের চেয়ে কম। আগের যে কোনো অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করলে এই রেমিট্যান্সকে কিন্তু কম বলা যাবে না। করোনা মহামারির মধ্যে সবকিছু বন্ধ থাকায় গত অর্থবছরে কিন্তু পুরো রেমিট্যান্স এসেছিল ব্যাংকিং চ্যানেলে; হুন্ডির মাধ্যমে আসেনি। এখন সবকিছু খুলে যাওয়ায় এবং ব্যাংক রেটের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশ বেশি হওয়ায় সম্ভবত হুন্ডির মাধ্যমেও কিছু রেমিট্যান্স আসছে। সে কারণেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কম দেখা যাচ্ছে।
‘তবে আমার মনে হচ্ছে, রেমিট্যান্সপ্রবাহে ফের গতি ফিরে আসবে। সরকার প্রণোদনার পরিমাণ বাড়িয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতেও গতি ফিরে এসেছে। এসব কিছুর প্রভাব রেমিট্যান্সে পড়বে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রণোদনা বেড়েছে। সামনে দুটি ঈদ উৎসব আছে। সবকিছু মিলিয়ে আগামী দিনগুলোয় রেমিট্যান্স বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।’ ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর রেমিট্যান্সপ্রবাহেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ওই বছরের এপ্রিলে মাত্র ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। মে মাসে তা বেড়ে ১৫০ কোটি ৪৬ লাখ ডলারে ওঠে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার।
মহামারির মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরোটা সময়ে (২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন) রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন লক্ষ করা যায়। ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
গত অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্সপ্রবাহে ভাটার টান লক্ষ করা যায়। প্রথম মাস জুলাইয়ে আসে ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আগস্টে আসে ১৮১ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে আসে ১৭২ কোটি ৬২ লাখ ডলার। অক্টোবরে আসে ১৬৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। নভেম্বরে আসে আরও কম, ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার।
তবে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে তা কিছুটা বেড়ে ১৬৩ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা সোয়া কোটি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ। দেশের জিডিপিতে সব মিলিয়ে রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো।
রিজার্ভও বাড়ছে : গত ৫ জানুয়ারি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪৪ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। গত কয়েক দিনে তা বেড়ে এখন ৪৫ বিলিয়ন ডলারের ওপর অবস্থান করছে। রোববার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।