বন্ধুর কিশোরী কন্যার সঙ্গে জিন্নাহর প্রেম । সুমন পালিত
‘কায়েদে আজম’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। এ রাষ্ট্রটির ব্যাপারে আপত্তি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের আলেম সমাজের এক বড় অংশের। তাদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ ছিল অখন্ড ভারতের পক্ষে। আর জামায়াতে ইসলামীর পরবর্তী কর্মকান্ড নিয়ে যত বিতর্কই থাক, পাকিস্তান সম্পর্কে তাদের বক্তব্য ছিল বিলিয়ন ডলার দামি।
দলটির প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদি পাকিস্তানকে ‘নাপাকিস্তান’ বলে ‘ফতোয়া’ দিয়েছিলেন। বলা হয়, অসম্ভবকে সম্ভব করাই ছিল খোজা সম্প্রদায়ের শিয়া মুসলিম পরিবারের সন্তান জিন্নাহর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। জিন্নাহ প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছেন করাচি ও বোম্বাইয়ের (এখন মুম্বাই) দুটি প্রাইমারি স্কুলে এবং করাচির এক মাদ্রাসায়। কিন্তু মাদ্রাসা ভালো না লাগায় তাঁকে ভর্তি করা হয় পাদরিদের স্কুলে। মাদ্রাসায় কয়েক দিন পড়লেও তাঁর উর্দু বা আরবি শেখা হয়নি। করাচির ব্যবসায়ী পিতার সন্তান জিন্নাহ এনট্রান্স বা এসএসসি পাস করেন ১৫ বছর বয়সে। কিশোর বয়সেই ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য যান বিলেত।
কৃতিত্বের সঙ্গে ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফেরেন জিন্নাহ। প্রতিপক্ষের অনেকে তাঁকে অবজ্ঞা করে বলতেন ‘এনট্রান্স পাস ব্যারিস্টার’। তবে আইনজীবী হিসেবে জিন্নাহ ছিলেন সত্যিকার অর্থে তুখোড়। তাঁর হাতে মামলা আসা মানেই জিতে যাওয়া- এটি প্রবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বোম্বের তো বটেই, তাঁর সময়ে অখন্ড ভারতের সবচেয়ে দামি আইনজীবীও ছিলেন তিনি। জিন্নাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বলতে গেলে অবিশ্বাস্যভাবে। ভারতবর্ষের মুসলমানদের সিংহভাগ সুন্নি সম্প্রদায়ের। তাদের অনেকের কাছে শিয়া খোজা সম্প্রদায়ের লোকেরা কতটা মুসলিম তা প্রশ্নের বিষয়। ব্যক্তিগত জীবনে জিন্নাহ ধর্মাচারের ধার ধারতেন না। শূকরের মাংসে তাঁর আসক্তি ছিল, যা মুসলমানের জন্য হারাম
আইন পেশার মতো রাজনীতিতেও তিনি ছিলেন সমান তুখোড়। খ্যাতনামা সাংবাদিক ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবরের ভাষায়, ‘জিন্নাহর আগ্রহ ছিল আইন পেশায়, থিয়েটার হলে গিয়ে নাটক দেখায় এবং রাজনীতিতে। ’
জিন্নাহর রাজনীতিতে হাতেখড়ি কংগ্রেস নেতা দাদাভাই নওরোজির কাছে। আপাদমস্তক কেতাদুরস্ত জিন্নাহ সম্পর্কে বলা হয়, তিনি ছিলেন মননে মগজে পশ্চিমা ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী। ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন ভারতের পক্ষে ছিলেন তিনি। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় নবাব স্যার সলিমুল্লাহর সভাপতিত্বে মুসলমান নেতাদের বৈঠকে জন্ম নেয় মুসলিম লীগ। ভারতবর্ষের মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা ছিল এ দলটির ঘোষিত উদ্দেশ্য। মুসলিম লীগে যোগদানের জন্য জিন্নাহকে আহ্বান জানানো সত্ত্বেও তিনি সাড়া দেননি। ওই দলের নেতাদের ব্রিটিশ তোষণ ও সামান্তবাদী ধ্যানধারণা তাঁর পছন্দ হয়নি। মুসলিম লীগ গঠনের নয় বছর পর ১৯১৫ সালে জিন্নাহ এ দলে যোগ দেন। তাঁর যোগদানের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তিনি কংগ্রেসে বহাল থেকেই মুসলিম লীগের সদস্য হন। একই সঙ্গে দুই দলে যুক্ত হয়ে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ১৯১৫ সালে বোম্বাইতে কংগ্রেসের অধিবেশন ডাকা হয়। জিন্নাহ মুসলিম লীগের অধিবেশনও যাতে একই সময়ে বোম্বাইতে হয় সে উদ্যোগ নেন। উদ্দেশ্য ছিল দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলোচনা জোরদার করা। জিন্নাহর উদ্যোগেই ১৯১৬ সালে দুই দলের মধ্যে লখনৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে তিনি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। সে সময়ও জিন্নাহ ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা। লখনৌ চুক্তিতে কংগ্রেস মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন এবং ভারতের যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সেখানে তাদের সম্মানজনক প্রতিনিধিত্ব মেনে নেয়। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে মেলবন্ধনের মাধ্যমে জিন্নাহ হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্যসূত্রে বাঁধতে চেয়েছেন। যে কারণে কংগ্রেস নেত্রী সরোজিনী নাইডু জিন্নাহকে অভিহিত করেন ‘হিন্দু-মুসলমানের মিলন দূত’ হিসেবে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনকালে ভারত ভাঙার জন্য যে দুজন বুড়ো খোকা দৃশ্যত দায়ী তারা দুজনই গুজরাটি। এর একজন মহাত্মা গান্ধী, অন্যজন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। করাচিতে জন্মগ্রহণ করলেও জিন্নাহদের আদি বাসস্থান গুজরাটের কাথিয়াওয়াড়ে। ১৯১৫ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করলেও তিনি কংগ্রেস ছাড়েননি। সে সময় একই সঙ্গে একাধিক দলের সদস্য হওয়ার বিধান ছিল। দুই দলের নেতৃস্থানীয় পদে থেকে তিনি হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সৃষ্ট রাজনৈতিক দূরত্ব ঘোচাতে চেয়েছিলেন। মুসলিম লীগ সভাপতি জিন্নাহ ও কংগ্রেস অধিপতি লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলকের সমঝোতা বা লখনৌ চুক্তি দুই পক্ষকে বেশ কাছাকাছি নিয়ে আসে। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রেক্ষাপট পাল্টে যায়। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য প্রতিষ্ঠার বদলে কংগ্রেসে গান্ধীজির সত্যাগ্রহ ও অহিংসার নীতি প্রাধান্য পায়। এ ধরনের কল্পনাবিলাসী তত্ত্বে জিন্নাহর আস্থা ছিল না। তিনি কংগ্রেসে তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ গুজরাটি ব্যারিস্টার গান্ধীর প্রভাব-প্রতিপত্তিকে ভালোভাবে নেননি। সন্দেহ নেই, মহাত্মা গান্ধী নিজেও ছিলেন সব ধর্মবর্ণের মানুষের সহাবস্থান ও সমধিকারের পক্ষে।
মুসলিম লীগ সভাপতি হিসেবে জিন্নাহ মুসলিম স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবেন- এমনটিই আশা করতেন। প্রথম মহাযুুদ্ধে জার্মানির সঙ্গে জোট বাঁধে তুরস্ক। এ যুদ্ধে ব্রিটিশ-ফ্রান্স মিত্র জোটের কাছে তারা পরাজিত হয়। তুরস্কের সুলতান মুসলিম জাহানের খলিফা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সুলতানের মর্যাদা যাতে ক্ষুণ্ন না হয় সেজন্য ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করে মুসলিম লীগ। লন্ডনেও পাঠানো হয় প্রতিনিধি দল। কিন্তু সে দেনদরবারে কোনো প্রতিশ্রুতি আদায় করা যায়নি তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জের কাছ থেকে। স্বভাবতই হতাশ হয়ে ওঠেন জিন্নাহ। এর রেশ না কাটতেই গান্ধীজি মাওলানা মোহাম্মদ আলী-শওকত আলী ভ্রাতৃদ্বয়কে দিয়ে মুসলমানদের সংগঠিত করে খেলাফত রক্ষায় আন্দোলনের ডাক দেন। একই সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তুতি নেন। ১৯১৯ সালে কলকাতা অধিবেশনে জিন্নাহ কংগ্রেস সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। এ সম্মেলনে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাবে একাত্ম হতে পারেননি জিন্নাহ। তিনি একে অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করেন। তাঁর বক্তৃতাকালে মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলী হইচই করে বাধা দিতে থাকেন। এ আচরণের প্রতিবাদে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন জিন্নাহ। কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর দেড় দশকের সম্পর্কেরও অবসান ঘটে।
জিন্নাহ কংগ্রেস ছাড়লেও তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ থেকে সরে আসেননি। ভারতবর্ষের মুসলমানদের অধিকার সংরক্ষণ করে অখন্ড স্বাধীন ভারতের প্রত্যাশী ছিলেন তিনি। কিন্তু কংগ্রেস নেতাদের অনুদার মনোভাবে সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। মহাত্মা গান্ধী মুসলিম লীগ বা জিন্নাহকে ছাড় দেওয়ার পক্ষে থাকলেও কংগ্রেস নেতাদের একাংশের উগ্র মনোভাবে ভারতবর্ষের ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্ট ভারত ভেঙে প্রতিষ্ঠিত হয় দুটি রাষ্ট্র- ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুটি অংশের একটি ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশ। আরেকটি ছিল সিন্ধু, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের সমন্বয়ে পশ্চিম পাকিস্তান। দুটি অংশের দূরত্ব ছিল ১৩০০ মাইল। মাঝে ভারত। জিন্নাহ যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কতটা করিৎকর্মা ছিলেন পাকিস্তান নামের উদ্ভট রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তারই প্রমাণ।
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বিয়ে করেছেন দুটি। এর একটি ১৫ বছর বয়সে। এনট্রান্স পাসের পর বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়ার আগে। জিন্নাহর মায়ের ইচ্ছায় এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু সে বালিকাবধূ মারা যান জিন্নাহ বিলেত থাকার সময়। বিলেতি জীবনে জিন্নাহ দুটি দুঃসংবাদ পান দেশ থেকে- একটি ছিল মায়ের মৃত্যু, অন্যটি বালিকাবধূর। জিন্নাহ শুধু নন, স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপিতা মহাত্মা গান্ধী ও বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও বিয়ে করেছেন বাল্যবয়সে। গান্ধীজি মাত্র ১৩ বছর বয়সে কস্তুরবাঈর সঙ্গে সাতপাকে আবদ্ধ হন। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ১৪ বছর বয়সে তাঁর চাচাতো বোন শেখ ফজিলাতুন নেছার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় বধূর বয়স ছিল মাত্র তিন বছর।
জিন্নাহর দ্বিতীয় বিয়েটি ছিল প্রেমের। প্রথম বিয়ের ২৭ বছর পর এক বন্ধুকন্যার প্রেমে জড়ান তিনি। ১৯১৬ সালে ৪০ বছর বয়সের জিন্নাহ ছিলেন বোম্বের প্রথিতযশা আইনজীবী। উদীয়মান রাজনীতিক হিসেবেও তিনি নিজের শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন। সমাজের উচ্চমহলে ছিল জিন্নাহর আনাগোনা। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর একজন ছিলেন বোম্বাই তথা অবিভক্ত ভারতের শীর্ষ ধনী অগ্নিপূজারি পারসি ধর্মের অনুসারী স্যার দিনশাহ পেটিট। স্যার দিনশাহ পেটিট দার্জিলিংয়ের বাসভবনে বেড়াতে আসার জন্য বন্ধু জিন্নাহকে নিমন্ত্রণ জানান। কংগ্রেস নেতা হিসেবে তিনি জিন্নাহকে বেশ পছন্দ করতেন। তাঁর মুসলিম লীগে যোগদান এবং সে দলের সভাপতি হওয়ায়ও তিনি খুশি হয়েছিলেন। দার্জিলিংয়ের বাড়িতে সে সময় অবকাশ কাটাচ্ছিলেন দিন শাহর ষোড়শী কন্যা লেডি রতনবাঈ। কন্যাকে স্যার দিনশাহ পেটিট ডাকতেন রতি নামে।
সেই সময়ের মুম্বাইয়ে স্যার দিনশাহর কন্যা মিস রতির সৌন্দর্য রীতিমতো আলোচনার বিষয় ছিল। আর জিন্নাহ তখন ভারতীয় রাজনীতির কেউকেটাদের একজন। দার্জিলিংয়ের বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়া আর নৈঃশব্দ্য পরিবেশ এমনই জাদু দেখাল যে ষোড়শী লেডি রতি ও ৪০ বছরের মিস্টার জিন্নাহ একে অন্যের প্রেমে পড়ে গেলেন। দার্জিলিং ভ্রমণের সময়ই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্যার দিনশাহ পেটিটের কাছে তাঁর মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন।
আগেই বলেছি, জিন্নাহ পারঙ্গম ছিলেন আইন পেশায়, নাটক দেখায় এবং রাজনীতিতে। আইন পেশায় আসামি, সাক্ষী বা বাদীকে জেরা করার সময় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য নাটুকেপনার আশ্রয় নেওয়া হয়। সেদিক থেকে জিন্নাহর জুড়ি ছিল না। তিনি বন্ধু স্যার দিনশাহর কাছে তাঁর মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার ক্ষেত্রে ভণিতার আশ্রয় নেন।
‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস জিন্নাহ দ্য ম্যারেজ দ্যাট শুক ইন্ডিয়া’ বইটির লেখিকা শীলা রেড্ডির কথায়, দার্জিলিংয়েই একদিন নৈশাহারের সময় মিস্টার জিন্নাহ প্রশ্ন করেন দুই ধর্মের মধ্যে বিয়ে নিয়ে স্যার দিনশাহর মতামত কী। মিস রতির বাবা সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেন, দুই ধর্মের মধ্যে বিবাহসূত্রে মেলবন্ধন হলে জাতীয় ঐক্য দৃঢ় হবে। স্বয়ং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও এর থেকে পছন্দের উত্তর বোধহয় দিতে পারতেন না। মুহূর্তের মধ্যে মিস্টার জিন্নাহ ফের মুখ খোলেন এবং স্যার দিনশাহকে জানান যে, তিনি তাঁর মেয়েকে বিয়ে করতে চান। তবে এ প্রস্তাবে উত্তেজিত হয়ে পড়েন স্যার দিনশাহ। উত্তেজনা এতটাই ছিল যে, অতিথিকে তিনি সেই মুহূর্তে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। জিন্নাহ অনেক চেষ্টা করেও স্যার দিনশাহর মত বদলাতে পারেননি। দুই ধর্মের মধ্যে বিয়ে হলে যে বন্ধুত্ব আর ঐক্য দৃঢ় হবে, স্যার দিনশাহর তত্ত্ব প্রথম পরীক্ষাতেই ব্যর্থ হয়ে যায়।
স্যার দিনশাহ ছিলেন প্রচ- জেদি, অন্যদিকে উদার মনের মানুষ। কিন্তু তাঁর বিদুষী ও অনন্যা সুন্দরী কন্যা বাবার বয়সী কারোর প্রেমে পড়বে বা তাকে বিয়ে করবে এতটা উদার তিনি ছিলেন না। এ ঘটনার পর জিন্নাহর সঙ্গে দিনশাহর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ধনী ও প্রভাবশালীদের একজন হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েন। কারণ স্যার দিনশাহ জানতেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ শীর্ণকায় দেহের অধিকারী হলেও অপরিসীম মানসিক শক্তির অধিকারী। তিনি মেয়ে লেডি রতিকে বলেন, যত দিন সে বাবার বাড়িতে থাকবে, ততদিন সে যেন কোনোভাবে জিন্নাহর সঙ্গে সম্পর্ক না রাখে। প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত জিন্নাহ যাতে তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে না পারে সে জন্য আদালতেরও স্মরণাপন্ন হন। আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। দিনশাহ এ নিষেধাজ্ঞায় আশ্বস্ত হন। ভাবেন বোম্বাইয়ের সেরা আইনজীবী জিন্নাহ রতির সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে অন্তত আদালত অবমাননার ঝুঁকি নেবেন না।
কথায় বলে প্রীতি না মানে রীতি। মুসলিম লীগ সভাপতি, ভারতবর্ষের সবচেয়ে দাপটওয়ালা আইনজীবী জিন্নাহ এবং তার কিশোরী প্রেমিকা লেডি রতির ক্ষেত্রেও তা সত্যি। মেয়েকে সাবধান করে দেওয়া এবং আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরও দুজনের চিঠি চালাচালি চলতেই থাকে। চলে লুকিয়ে দেখা সাক্ষাৎ। শীলা রেডিড তার বহুল আলোচিত বইয়ে বলেছেন, একবার রতিকে একটি চিঠি পড়তে দেখে ফেলেন দিনশাহ। চিৎকার করে ওঠেন তিনি, এটা নিশ্চয়ই জিন্নাহর চিঠি। রতিকে ধরার জন্য ডাইনিং টেবিলের চারদিকে দৌড়াতে থাকেন তিনি, যাতে পাকড়াও করা যায় জিন্নাহর চিঠিটা। কিন্তু মেয়েকে ধরতে পারেননি স্যার দিনশাহ।
এভাবে চলতে থাকে মিস্টার জিন্নাহ ও মিস রতির অসম প্রেম। লেডি রতির মতো অসামান্য সুন্দরী এবং ভারতের সেরা ধনী পরিবারের কন্যা তার চেয়ে আড়াইগুণ বয়সী জিন্নাহর প্রেমে কেন হাবুডুবু খেলেন তা একটি আলোচিত বিষয়। জিন্নাহ ছিলেন কঠিন স্বভাবের মানুষ। এমন নীরস মানুষের প্রেমে মিস রতি উতলা হয়েছিলেন সম্ভবত সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের টানে। শুধু মিস রতি নয়, জিন্নাহর প্রতি নাকি দুর্বলতা ছিল সে সময় বোম্বের নাইটিঙ্গেল বলে অভিহিত সরোজিনী নাইডুর। তবে এটি গুঞ্জন না সত্যি তা হলফ করে বলার উপায় নেই। গুঞ্জন যাই থাক, জিন্নাহর সঙ্গে লেডি রতির প্রেম ও বিয়েতে সরোজিনী নাইডু সহযোগিতাই করেছেন। ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস জিন্নাহ- দা ম্যারেজ দ্যাট শুক ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের লেখিকা শীলা রেড্ডিও বলেছেন- প্রেম নয়, নাইডু সব সময় জিন্নাহকে শ্রদ্ধার চোখেই দেখতেন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।
Email: [email protected]