উন্নয়ন তরিকার গোলকায়ন। ড. মাহবুব হাসান । নিউ ইয়র্ক

0
আমি লিখবো এখানে সেই সুন্দর বাক্য যা গণমানুষের চেতনার প্রতিরূপ। কেন না, আমি তাদেরই প্রতিনিধি। আমি উঠে এসেছি তাদেরই সমাজ-সংসার থেকে। আমার চিন্তায়, পরাচিন্তায় এবং কর্ম-চিন্তায় তারাই আছেন উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময় হয়ে। তবে, উঠে এসেছি, এই কথার ব্যাখ্যা দরকার। কারণ আমি কোথায় উঠে এসেছি? সেই জায়গাটি কোথায়?
আমি বা আমরা গ্রামের মানুষ। গ্রাম একটি পরিপূর্ণ আবাসন ইউনিট। সে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বছর আগে। আমাদেরই চিন্তা আর ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে। আমাদের প্রয়োজন আর অপ্রয়োজনকে কাট-ছাঁট করে একটি উন্নয়ন চেতনার আলোকে, তারই মডেল হিসেবে। এবং আমি জানি এবং মানি যে, গ্রাম ও গ্রামীণ সভ্যতা সবচেয়ে দীর্ঘ, টেকসই সভ্যতার নমুনা। কিন্তু ওই সভ্যতার নাড়ি কেটে চলেছি একের পর এক নগর নির্মাণ করে। ধ্বংস করে চলেছি আমাদের প্রতিবেশের নিসর্গ-প্রকৃতি। নিসর্গ-প্রকৃতি আমাদের খাদ্য দেয় প্রাকৃতিক নিয়মেই। সবুজ গাছপালা আমাদের দেয় অক্সিজেন, যা দিয়ে আমরা নি:শ্বাস-গ্রহণ করে বাঁচি। আর যা ছাড়ি, সেই প্রশ্বাস ওই সব গাছেরাই গ্রহণ করে আমাদের পরিবেশকে শঙ্কামুক্ত করে ও রাখে। এই ন্যাচারাল বিষয়টিকে আমরা গুরুত্ব দিই না। তাই বন-বাদাড় কেটে-ছেঁটে রাস্তা-ঘাট বানাই সিমেন্টের, ঘরবাড়ি বানাই,দালান-কোঠা তুলি, বহুতল বা হাইরাইজ বিল্ডিং– না তুললে আমাদের নাগরিক জীবনের কোনো মান-সম্মান ইজ্জত থাকে না। আমরা পাল্লা দিই পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর সাথে। তাদের মতো সুউচ্চ দালানরাজি উঠাবার প্রতিযোগিতায় নামি। আমাদের গ্রামীণ জীবনের ফসলের মাঠ ধ্বংস করে নগরায়নের এই নেশায়, উন্নয়নের এই বিধ্বংসী কারিকুলাম আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক তরিকায় যোগ করা হয়েছে, তাকেই বলা হয়েছে ও হচ্ছে নগর-সভ্যতা ও উন্নয়ন।
গ্রাম ও পরিবেশ-প্রতিবেশ ধসিয়ে দিয়ে নগর নির্মাণ ও নগরায়ন যদি উন্নয়ন হয়, তাহলে সেখানে এতো সাংস্কৃতিক হেগেমনি কেন? মানুষের জন্য সার্বিক ভালো কোথায় রয়েছে সেটা বাদ দিয়ে চাঁদে যাওয়ার নেশায় মত্ত পৃথিবীর বিত্তবানদের চিত্ত ও বৈভব। কিন্তু কেন?
আমরা তো দেখতে পাচ্ছি মানুষের মুখে খাদ্য তুলে না দিয়ে, তাদের গ্রাসের অন্নের টাকায় বানানো হচ্ছে মহাকাশযান। বানানো হচ্ছে মানব-ধ্বংসের পরমাণু বোমা। এ-গুলোই কি উন্নয়নের নমুনা? মানুষের সব উন্নয়ন কি ধনী দেশগুলোর মধ্যে সম্পদ আহরণ ও আধিপত্য বিস্তারের বিবাদ-বিসংম্বাদ? মানুষ হত্যার জন্য কতোই না কোশেশ তাদের। নিজেদের ক্ষমতার দাপটে যে মানুষের জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেই দিকে কারো চোখ নেই। তাহলে কি ধরে নেবো তারা বধির ও কানা? নাকি তারা উন্নয়ন নামক এক বিধ্বংসী চেতনার হেগেমনির শিকার? তারা ক্ষমতার এক অন্ধ ও বীরদর্পী নেশায় মত্ত আজ , যা মূলত মাদকসেবীদের মধ্যে দেখা যায়? যদি এটাই হয়, তারা মত্ত-মাদকতায়, তাহলে তারা যে সুস্থ মানুষ নয়, তা বলাই বাহুল্য। আজকে এদের হাতেই দুনিয়ার দেশগুলো রাজনৈতিক ও উন্নয়ন নামক উন্মাদ নেশায় বন্দী।
২.
পৃথিবীর গরিব দেশগুলো এই হেগেমনিয়াল বিধ্বংসী সংস্কৃতির গিনিপিগ মাত্র। আজ আমরা এই সব ধনী দেশের প্রত্যাশিত কাজের অংশীদার এবং আমরা এই সব পাওয়ার ও সুপার পাওয়ারদের‘নাচের পুতুল’। আমরা যারা নিজেদের বিদ্যান বলে মনে করি, তারা তো ওই উন্নয়ন তরিকার বটিকাসেবনকারী গিনিপিগ, তাও আমরা অবস্থানে দ্বিতীয় স্তরের মানুষ। আমরা এই পজিশন পেয়ে বগল বাজাই। কেন না, আমাদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক যে-সব কারিকুলাম পড়ে শিক্ষিত হয়েছি, তাতে এই বোধসত্তাই আমাদের সম্পদ বলে গণ্য হবে এবং আমরা সেটাই করছি। আমি এখন আমার জন্মদেশের কথা বলতে চাই। কেন না, সেখানে রয়েছে আমাদের অন্ধ প্রগতিশীলতার নাড়ি। এই নাড়ি কেটে আমরা বেরুতে পারি না। সেই পথের কোনো আপাতত দুয়ার নেই, জানালা-ফানালা কিচ্ছু নেই।, কেবল ধূসরতায় ছাওয়া রাজনৈতিক উন্নয়নের এক অস্বচ্ছ বোধ খেলা করে। এর কোনো আগা-পাছা নেই। কেমন সেই অস্বচ্ছ চেতনার রূপ, সেই কথাই যাচ্ছি এখন।
জ্ঞানী-গিনিপিগ হিসেবে আমরা কি করি? দেশের উন্নয়ন তরিকার জয়গান করি। এখন রাজনৈতিক ক্ষমতায় শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আছে আওয়ামী লীগ। সাধারণ লোকেরা এবংবিরোধী রাজনীতিকরা বলেন হাসিনা ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতায় আছে ১১/১২ বছর ধরে। ভোট-ডাকাতি করে ক্ষমতায় আছে কি নেই, তারচেয়েও বড় হচ্ছে তারা এখন ক্ষমতা ভোগ করছেন। কারণ ক্ষমতায় থাকাটাই হলো আসল।
খালেদা জিয়ার ক্ষমতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক ও সামরিক শাসকদের গোপন ষড়যন্ত্র চলেছে, সে কথা আজ আর বলা হয় না। কেবল বলা হয় ৫০০ কোটি টাকার খাম্বা কেনার অর্থ লুটপাট করেছে খালেদার ছেলে তারেক জিয়া। তখন তারা ক্ষমতায়। বিরোধী আওয়ামিরা এই কথা চিল্লায়া বলতো। সুযোগ বুঝে এখনো তারা সেটা বলে। আর বিএনপির লোকেরা বলে এখন তো হাজার হাজার কোটি নয়, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের আড়ালে লোপাট করা হচ্ছে শত শত কোটি টাকা। একটি প্রজেক্টের মেয়াদ বাড়ানোর সাথে সাথে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোকে সরকারি ‘রোগ’ হিসেবে চিহিৃত করা যায়। দেশে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর কোনটার মেয়াদ ও বরাদ্দ বাড়েনি, কেউ কি তা বলতে পারেন? এ-এক ক্রনিক্যাল রোগ আমাদের সরকারগুলোর। আর তা যে লুটপাটের জন্যই, হরির বাতাশা লুটের মতোই লুটপাট তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ-সবের পাশাপাশি দেশের ব্যাংকগুলোকে লোনের মাধ্যমে লুট করে পাচার করার কথাও শোনা যায়।
এই দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক ক্যাওয়াসের মধ্যে ‘গণমানুষ’ এক অসহায় গিনিপিগ, অর্থাৎ তারা কোনো ফ্যাক্টর নয় আজ আর ক্ষমতা রদ-বদলের। আর সুশিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তিকরা কি করেন? তারা ক্ষমতাবান রাজনীতিকদের লেজুড়ে পরিণত হন। কেন না, রাজনৈতিক লেজুড় না হলে তিনি বা তারা পদ ও পদবি, পুরস্কার ইত্যাদি পাবেন না। আমাদের যে শিক্ষা তাতে পদ-পদবি অর্জন ও লেজুড়বৃত্তির কাঠামো-চেতনাই নির্মাণ করে।এই লেজুড়বৃত্তিকরাই বিএনপি ও আওয়ামি লিগের পক্ষে গলাবাজি ও কলমবাজি করেন। এদের বাইরেও কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক আছেন যারা বৈশ্বিক রাজনৈতিক বিষয়-আশয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। তারা সাউথ এশিয়ার ভূ-রানৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। স্ট্যাটিজিক্যালি বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় এবং কেন, সে সবেরও ব্যাখ্যা করেন। আর এ-সবই উন্নয়নকে কেন্দ্র করে বা উন্নয়ন সহযোগীর চাওয়া পাওয়ার সাথে সংযুক্ত। তারা আরে-ঠারে বলেন সরকারের কোন পক্ষে থাকা সুবিধাজনক। অর্থাৎ এখানেও একধরণের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি চলতে থাকে। তার কারণ, তারা বিশ্বের ক্ষমতাবানদের রাজনৈতিক ও সামরিক অরবিটভুক্ত। একে আমরা গোলকায়নের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক গোলকও বলতে পারি, যা মূলত গ্রিক মিথিক্যাল লেবিরিন্থের সাথে তুলনীয়।
চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতার দ্বদ্বে লিপ্ত, প্রকাশ্যে যতটা না তার চেয়ে চোরাস্রোতের মতো বহমান,দেখা ও বোঝা যায় না, তার রূপ কেমন। যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন ‘চীনা-ভাইরাস,তখন বোঝা যায় বিরোধের শৈলশিখরটি, গহনে তা কতোটুকু, সেটা সম্যক বোঝা কঠিন বৈকি। বাকিটুকু বুদ্ধিজীবীরা নানা উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণ করে নির্মাণ করেন সম্পর্কের স্বরূপ। সেই বিচারে তারা বলতে চেষ্টা করেন যুক্তরাষ্ট্র চায় চীনকে তার সামরিক খবরদারির অধীনে রাখতে। এই খেলায় সে হায়ার করেছে ভারতকে। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত এবং অটুট বন্ধুত্ব বিদ্যমান। যদিও বাংলাদেশের গণমানুষ ভারতকে তাদের শত্রূদেশ হিসেবেই চেনে। ভারতও তা জানে । তাই সে শিখন্ডি বসিয়ে বাংলাদেশের প্রশাসনে ও প্রশাসনের বাইরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মিনিমাম ৩৬ হাজার লোককে নিয়োগ করেছে। এরা কাজ করে রেমিটেন্স পাঠায় দেশে আর দেশের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করে–এই অভিযোগ রাজনৈতিক দল ও সাধারণের। এই কথাগুলো ওই সব বুদ্ধজীবী করেন যাদের অনেকেই দেশের বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশের ভেতরে থেকে এ-ধরনের কথা লিখলে তাকে গুম হতে হবে কিংবা খুন হতে হবে। সেই গুম ও খুনের কারবারিরা ভারতের ‘র’ এর লোক। পেইড কিংবা আনপেইড সেটা বড় কথা নয়। তারা দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে।
এ-কারণেই দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ভয়াবহ। আর চীন এটা বুঝতে পেরেই বাংলাদেশে ২৪ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করে এ-দেশে তার আধিপত্যের নিশান তুলেছে। মার্কিনি ও ভারতীয় সরকারের সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব যাতে বাংলাদেশকে গ্রাস করতে না পারে, এটাই তাদের লক্ষ্য। কারণ, ওই দুটি দেশ যদি বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্যের বীজ গাছ বড় করে তুলতে পারে, তাহলে চীনের জন্য তা ক্ষতিকর। তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামরিক আধিপত্যের বাইরে চলে যাবে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি। ভারতের ছোটো প্রতিবেশি দেশগুলোকে নানা উপায়ে চীন তার কবজায় নিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু বন্ধুরাষ্ট্র ভারত হাসিনার এতো তাগিদ সত্ত্বেও আশানুরূপ বিনিয়োগ করেনি। উপরন্তু প্রায় প্রতিদিনই সীমান্তে বাংলাদেশি মানুষদের ওপর গুলি চালায় এবং হত্যা করে সাধারণ চাষীদের। হাসিনার সরকারের সেই সাহস নেই যে এর প্রতিবাদ করে। মিহিগলায় দু্-একবার প্রতিবাদ করলেও, বিজিবির ফ্লাগ বৈঠক ছাড়া তেমন কোনো প্রতিবাদের চেহারা দেশের মানুষ দেখতে পায়নি। এই পক্ষবাজির পেছনে কাজ করে দেশের ও দশের উন্নতি বলে প্রচারিত তত্ত্ব। এটা যে এক অন্ধ উন্নয়নের গোলকধাঁধা সেটা কয়জনে বুঝতে পারে? আমরা কি বুঝি?
লেখক : ড. মাহবুব হাসান : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও কবি

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.