বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে ‘মুক্তিযুদ্ধকে হত্যার’ চেষ্টা করা হয়েছে – হীরেন পণ্ডিত

পর্ব-১৫

0

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়নি, মুক্তিযুদ্ধকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। যারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চেয়েছিল, তারাই এ হত্যার পেছনে ছিল। এ হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষের চারা রোপণ হয়। বাংলাদেশকে এখনো এর দায় বহন করতে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এ হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি-মার্কিন নীলনকশার বাস্তবায়ন হয়। পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খন্দকার মোশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে কনফেডারেশন গড়ে তোলার জন্য কলকাতার মার্কিন কনসালের সঙ্গে সলাপরামর্শ করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোশতাকের নেতৃত্বে কনফেডারেশনপন্থীরা ভূমিকা অব্যাহত রাখে। মোশতাক-কনফেডারেশনের খুনি মেজর সাহেবরা জিয়াউর রহমানের সহযোগিতা পায়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর হত্যাকারী গোষ্ঠী প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের সংবিধানকে টার্গেট করে। আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে হত্যা করে। এতে বোঝা যায়, ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে আমাদের সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে হত্যাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। এসব তারাই করেছে, যারা বাংলাদেশকে একেবারেই চায়নি। তাদের মনেপ্রাণে ছিল পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশ উল্টো পথে যাত্রা করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাইকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা কওে ফেলা হয়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মূল্যবোধকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর সাম্প্রদায়িকতা ও যে নৈতিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়, তার ফল এখনো ভোগ করতে হচ্ছে। এখন আমরা শিক্ষা ও নারী নীতি করছি, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে নানা আপসকামিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী বাংলাদেশের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ছিল না। ধর্মভিত্তিক সামরিক শাসকদের হাত থেকে মুক্ত করে গণতান্ত্রিক শক্তির দেশ গড়াই ছিল এর লক্ষ্য। ১৯৭৫ সালে সেই স্বপ্নটি ভঙ্গ হয়েছে। আমাদের সত্যিকারের সর্বনাশ হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শিক্ষার আন্দোলনকে গতিশীল করার চেষ্টা করেছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে শিক্ষার অধিকার দিয়েছিলেন। আজ শিক্ষার এই ঢালাও বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। তাঁকে হত্যার পর শিক্ষার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিস্তার রুদ্ধ হয়ে যায়।

অসাম্প্রদায়িকতা থেকে আমরা অনেক দূর চলে গেছি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষের চারা রোপণ করা হয়েছিল। এখনো তার দায় আমাদের বহন করতে হচ্ছে।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। কথা ছিল যে সে দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। ঘুরে ফিরে দেখবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই তাকে এক সময় বহিষ্কার করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে পরিচালিত ধর্মঘট সংগ্রামের প্রতি তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন। সংহতিমূলক ছাত্র ধর্মঘট সংগঠিত করে সরাসরিভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এই ছিল তার ‘অপরাধ’। এ ঘটনার প্রায় তিন দশক পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই সেই বহিষ্কৃত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সসম্মানে বরণ করে নিতে প্রস্তুত হয়েছিল।

বেশ কিছুদিন আগেই প্রস্তুতির শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নিতে। উৎসবের আমেজে সুসজ্জিত ও মুখরিত হয়েছিল ক্যাম্পাসের সবগুলো ভবন, আঙ্গিনা, প্রাঙ্গণ। কথা ছিল যে, ক্যাম্পাসে পদার্পণের পর বঙ্গবন্ধু প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশের শহিদদের মাজার জিয়ারত ও সেখানে পুষ্পমাল্য অর্পণ করবেন। তারপর তিনি জগন্নাথ হল ও সেখানকার বধ্যভূমিতে, শহীদুল্লাহ হল হয়ে ফজলুল হক হলে যাবেন। অতঃপর তিনি শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে টিএসসি মিলনায়তনের এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দেবেন। বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসের সর্বত্র ছিল ব্যাপক তোড়জোড়।

কিন্তু পর্দার পেছনে চলছিল কুটিল-হিংস ষড়যন্ত্রের আয়োজন। ষড়যন্ত্রকারীরা দুর্বল ছিল না। তাদের সঙ্গে ছিল আন্তর্জাতিক মদদ। সরকারের নানা ব্যর্থতা, গুরুতর ভ্রান্তি ও ত্রুটি-বিচ্যুতির ফলে সৃষ্ট গণবিচ্ছিন্নতার সুযোগে তারা সুকৌশলে তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এনেছিল। বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে চরম উদাসীনতা, এবং শত্রু যে কত ভয়ংকর বর্বর হতে পারে সে সম্পর্কে উপলব্ধির দুর্বলতাকে তারা কাজে লাগিয়েছিল। ঘরের ভেতরেই ছিল ঘাতক শক্তির চর।

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে ছিল মানবিকতা, নৈতিকতা, আইন-কানুন ও সামাজিক মানদণ্ডের নিরিখে একটি ভয়ংকর অপরাধ। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডটি একই সঙ্গে ছিল একটি দেশদ্রোহিতামূলক রাজনৈতিক অপরাধের ঘটনা। তা প্রথমত এ জন্য যে, সেদিন দেশের রাষ্ট্রপতি, মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল। সেদিন সংবিধান লঙ্ঘন করে প্রয়াত রাষ্ট্রপতির আসনে স্বঘোষিতভাবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছিল খুনি মোশতাক।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রধান যে কথাটি বলতে হয় তা হলো, ১৫ আগস্টের বর্বর হত্যাকাÐের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র ও মর্মবাণী উল্টোপথে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আঘাত হানা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল অর্জনগুলোর ওপর। পাকিস্তান রাষ্ট্রেও ভৌগলিক-রাজনৈতিক কাঠামো থেকে বের হয়ে এসে একই চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য দেশবাসী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেনি। মুক্তিযুদ্ধ একটি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ প্রয়াস ছিল না। পাকিস্তানকে দ্বি-খণ্ডিত করে তার পূর্বাংশে একটি দ্বিতীয় পাকিস্তান কায়েম করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। আমাদের মহান এ মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি ‘জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম’। সেটা ছিল কয়েক যুগ ধরে পরিচালিত জনগণের সার্বিক সংগ্রামী অভিযাত্রার শীর্ষবিন্দু। সেটা ছিল একটি ‘জনযুদ্ধ’। পাকিস্তানি মতাদর্শ, সামাজিক-অর্থনৈতিক নীতি ও রাজনৈতিক চরিত্রকে নেতিকরণ করেই নতুন নীতি-আদর্শ-বৈশিষ্ট্য-ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ। এবং এ সামগ্রিক গণ-সংগ্রামের সবটুকু নির্যাস ও নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের চরিত্র-ভিত্তি মূর্ত রূপ পেয়েছিল ১৯৭২-এর সংবিধানে। বিশেষত গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র-তথা সেই সংবিধানে বর্ণিত ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সঙ্গে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল ১৯৭২-এর সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রের সেই মূল ভিত্তি। মুক্তিযুদ্ধের নেতাকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে হনন করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধেও চেতনা ও ধারা। ‘ফরমানের’ দ্বারা প্রথমে মোশতাক ও পরে সামরিক শাসক জিয়া এবং এরশাদ বদলে দিয়েছিল ১৯৭২-এর সংবিধানের মৌল চরিত্র ও ভিত্তি। সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের নীতি। ত্রিশ লাখ শহিদের রক্ত ও বহু যুগের গণ-সংগ্রামের ফসল, মহান মুক্তিযুদ্ধেও চেতনা ও ধারাকে যে সংবিধানের মাধ্যমে ১৯৭২ সালে মূর্ত রূপ দেওয়া হয়েছিল, তাকে উল্টে দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ও শোষণ-লুটপাটের নীতি ও ধারা।

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.