সিলেট ডায়রি – মোহীত উল আলম

0

পাহাড়িকা লম্বা একটা শুঁই পোকার মতো ধীরে ধীরে ৯ নম্বর প্লাটফর্মে ইন করল। আমি আর খুকু চট্টগ্রাম স্টেশনে পৌঁছেই খিলানের সঙ্গে চক্রাকারে সিমেন্টের বেদীতে বসে অপেক্ষা করছিলাম। আমাদের সিট পড়েছে ‘ঙ’ বগির ৯ ও ১০। আমরা কয়েক দম্পতি চলেছি সিলেটের পথে। চবির অষ্টম ব্যাচের বন্ধু আমরা। চবি ছেড়েছি আমরা ৪৫ বছর আগে, কিন্তু প্রবীণ বয়সে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুপ্রীতি ক্রমশ বাড়তে বাড়তে হোয়াটসঅ্যাপে একটি ফোরামে রূপ নেয়। তারই ফলশ্রুতিতে বড় বেড়ান, ছোট বেড়ান আমাদের জীবনযাপনের অংশ হয়ে যাচ্ছে।

এবার সিলেট যাচ্ছি সস্ত্রীক আমি, শেখর, আব্দুল হাই,, আর সুবোধ, আর একলা যাচ্ছে কিবরিয়া আর সাযেদা। আমি মনে করতে পারছিলাম না, লাস্ট কখন আমি ট্রেনে চড়েছি। তাই একটা লম্বা ট্রেন ভ্রমণ নিতে আমি উৎসুক ছিলাম। ট্রেনের চলার মনমাতানো ছন্দ—ঝমাঝম, ঝমাঝম। পাহাড়িকার বগিটি ভালোই লাগল। প্রতি সিটের পেছনে প্লেনের মতো ছোট এলুমিনিয়াম টেবিল সাঁটান। খাবার রেখে খাবার জন্য। কাজ শেষে ভাঁজ করে আবার সিটের ব্যাকের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া যায়। গ্লাস রাখার একটা পট হোলও আছে। পায়ের বিস্তারের পরিসরও সন্তোষজনক। এসি শুরু হলো ট্রেন ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে। ট্রেন ছাড়তে সকাল ৭-২০ মিনিটের এক সেকেন্ডও দেরি হলো না। ভেরি গুড।

ট্রেন চলতে শুরু করলে, চট্টগ্রাম শহর পার হতেই সবুজ প্রকৃতি রাস্তার দু’পাশে দুপদাপ করে জানলা দিয়ে আমার চোখে পড়তে লাগল। বাংলাদেশের প্রকৃতি অসম্ভব সুন্দর। সবুজে-সবুজে ভরা বৃক্ষ, লতা, গুল্ম, পত্র-পল্লব। একটা সবুজ পত্রাদির আম গাছের পেছনে হুমকি দিয়ে একটা মিনজিলি গাছ আরো সবুজ হয়ে আকাশকে শাসাচ্ছে। গ্রাম বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের। টের পেলাম ঘন ঘন টিন শেড আর ইটের দেয়ালের বাড়ি চোখে পড়তে। দিনটা, ২১ অক্টোবর, আসলে অত্যন্ত রৌদ্রঝলোমলো দিন ছিল। আকাশে কোন মেঘ ছিল না। চারদিকে দিগন্তবিস্তৃত গাছ-গাছালি আর বাড়ি ঘর যেন এই অবারিত রোদ ঘাড়ে-পিঠে-বুকে আর মাথায় লুফে নেবার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আমি আসলেই চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কিন্তু এই ঘন প্রকৃতির মোহময়ী পরিবেশের মধ্যেও লোহা-লক্কড়, ইট-সিমেন্টের বাড়াবাড়ি রকম সমাবেশ। বাংলাদেশ উন্নতি করছে, তা এই ইট-সিমেন্টের স্থাপনা দেখলে বোঝা যায়। ফেনীকে আর আগের মতো রুগ্ন-ক্ষয়া, শহর হবে-কি হবে-না এরকম দ্বিধার মধ্যে দেখলাম না। বিশ বছর আগের চট্টগ্রামের মতোই এর এখন নাগরিক রূপ। উঁচু উঁচু বাড়ি, আধুনিক দোকানের পসরা, আর মোটামুটি স্বচ্ছন্দ পরিধেয় পরে মানুষজনের হাঁটহাঁটি জানান দিচ্ছে নগরায়নের সুনামি চলছে মফস্বল শহরগুলোতেও।

সাযেদা হাঁক-ডাকে অভ্যস্ত মহিলা। ফেনী পার হতে না হতেই, সেই সকাল নয়টার মধ্যে ঘোষণা দিল গেল রাতে সে সারা রাত জেগে বন্ধুদের জন্য পরোটা, চিকেন কাবাব আর গাজরের হালুয়া তৈরি করেছে। আমার গত রাত্রে কোথাও একটা আরটিকেল জমা দিতে হবে, সেটা শেষ করে রাত একটার দিকে বিছানায় গেলেও ঘুম ধরা দেয়নি ফজরের আজানের আগে পর্যন্ত। সকালে আবার হেভি নাস্তা করেছি। শরীরটা একটু ডিসটিউনড। তাই সাযেদার দেওয়া খাবার একটু সতর্কতার সঙ্গে খেলাম। রানিং ট্রেনে অনাবশ্যক বারবার ছোট ঘরে যেতে আমার ইচ্ছা ছিল না।

পাহাড়িকা সময় এবং গতিতে সন্তোষজনক, তবে বাংলাদেশের একটি বড় ট্রেন যেরকম হওয়া উচিত, পাহাড়িকা ঠিক সেরকমেরই একটি ট্রেন। খাবারের জন্য ট্রেনের খাবার ঘর থেকে খাবার কেনা গেলেও, ট্রেনের যাত্রীদের কাছে হকারদের ফিরি করা খাবারই যেন বেশি পছন্দ। চানাচুরওয়ালা, ঝালমশলা বিক্রেতা, সান পাপড়ি আর পপকর্ন, নানারকমের চিপস, লজেন্স, চকোলেট, আইসক্রিম, কদবেল, আনারস, কলা, পান এমন হরেকরকম খাবারের বিক্রেতারা স্বচ্ছন্দে তাদের পণ্য হকারি করতে করতে বগির এক দরজা দিয়ে ঢুকে আরেক দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে মানে পুন:পুন: তারা আসছে। বিরক্ত না হয়ে আমি জনগণের একটি প্রাত্যহিকতায় অংশ নিয়ে খুব তুপ্তি পাচ্ছিলাম। আখাউড়া জংশনে আব্দুল হাইকে দেখলাম বাংলাদেশ দল টি-২০ যেমন স্লো স্পিডে খেলে তার চেয়েও ধীরে একজন গামছাওয়ালার কাঁধ থেকে একটা গামছা বেছে নিয়ে দরদাম করে এক শ টাকা দিল। খুকুরও একটা গামছা পছন্দ হলো। কিন্তু কিবরিয়া দড়াদড়ি করতে গিয়ে ৭৫ টাকা বলায় গামছাবিক্রেতা ছেলেটা আমাদের সমস্ত আত্মমর্যাদাবোধ ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে শুধু ‘ধন্যবাদ’ শব্দটা উচ্চারণ করে এমন ন্যাপোলিয়নের ভঙ্গিতে বগির দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল যে আমি অপমানটুকু হজম করার জন্য মনে মনে যুক্তি পেলাম যে আসলে তখন ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে, তাকে বোধহয় তার আগেই ট্রেন থেকে নেমে যেতে হতো।

অপমানের কথা বললাম, কেন না এর একটু আগে কুমিল্লা স্টেশনে আমার সঙ্গে একজন যাত্রীর প্রায় বেধে গেছিল। আমাদের সিটের ওপরে মাল রাখার র্র‌্কর‌্টাযাক অতটুক পর্যন্ত গড়ায়নি। তাই আমাদের ব্যাগগুলো কয়েক সারি আগের সিটের ওপরের র‌্যাকে রাখা ছিল। কুমিল্লায় এসে গোলটা বাঁধল। এক লোক তাঁর স্ত্রীসহ ঐ সিটগুলোতে বসতে গিয়ে তার লাগেজ রাখতে পারছিলেন না। তিনি আমাদের একটা ব্যাগে হাত দিয়ে বললেন, এই ব্যাগটা কার। লোকটার বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। মাথায় তেলইন্যে একটা টুপি, মুখটা কাঁচাপাকা দাড়িতে সাজানো। পান্ডার মতো বড় বড় চোখ, আর লোমশ হাত। আমি কিছু বললাম না, মজাটা দেখতে লাগলাম। লোকটা কয়েকবার চিৎকার করার পর আমি লোকটাকে বললাম, ব্যাগটা আমাদের। এবং ঐ ব্যাগ ওখানেই থাকবে। লোকটা চ্যালেঞ্জ করে বলল, আই হ্যাভ দ্য রাইট। আমি বললাম, আমাদের সিটের সঙ্গে মাল রাখার র‌্যাকটা এতদূর পর্যন্ত পৌঁছায়নি। কোথায় রাখব? লোকটা বললেন, আপনি সেটা ট্রেন কোম্পানিকে বলেন। তখন ট্রেনের ঐ বগির এ্যাটেন্ড্যান্ট বললেন, স্যার, আপনারা ঝগড়া করলেতো সমস্যার সমাধান হবে না। এ বলে সে তার কেরামতি দেখালো। এদিকের ব্যাগ ওদিক, ওদিকের ব্যাগ এদিক সেদিক করে ঠিকই সবার লাগেজের জায়গা করে দিল। তখন ঐ লোকটি দেখলেন তাঁর একটি ব্যাগ র‌্যাকে উঠলেও দ্বিতীয়টি তাকে তাঁর সিটের পাশের আইলেই রাখতে হলো। তিনি আবার তাঁর সিটে বসার আগে যেন জাতিকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘মেন্টালিটি শুড বি স্যাক্রিফাইস। আমার সিলেটের বাড়িতে আপনাদের দাওয়াৎ রইল। আসেন, নো প্রব্লেম।’ তাঁর ভুল ইংরেজিটা ইংরেজির মাস্টার হিসেবে আমার কাছে জাতিগত সমস্যাটা উন্মোচন করল। তাই ঠিক সাড়ে চারটার সময় সময়মতো ট্রেন সিলেটে পৌঁছালে, ট্রেন থেকে নামার সময় তাঁকে আমি মৃদু হেসে বললাম, আমরা সবাই কিন্তু আপনার বাড়িতে যাচ্ছি। ভেবেছিলাম, আমার রসিকতায় লোকটা হেসে দেবেন। কিন্তু তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, ইউ আর ওয়েলকাম।

সারা রাস্তায় আমাদের নানা গালগল্পে কেটেছে। আর প্রচুর তৃতীয় লিঙ্গের মহিলা-পুরুষ বারবার বগিতে ঢুকে ভিক্ষা চাইছিল। তাদের মুখে এন্তার সাজনীর প্রলেপ, পোষাক দৃষ্টিশোভনীয় নয়। এদের তৎপরতা শহরাঞ্চলেও বেড়ে গেছে। ট্রেনেও তাই হচ্ছে, সেটা চাক্ষুষ করলাম। সে যাই হোক, আমরা গল্পে মেতে রইলাম।

কিবরিয়া একটা গল্প বলল, সেটা এখানে শেয়ার করি। সত্তর দশকে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিকী ছিল “সাপ্তাহিক বিচিত্রা,” আর তা’তে থাকতো “প্রবাসের চিঠি” শিরোনামে ততোধিক জনপ্রিয় একটি বিভাগ। কিবরিয়া মনে করতে পারল যে সে এরকম একটা প্রবাসীর চিঠি পড়েছিল, যেখানে প্রবাসী বলছে যে তিনি সৌদি আরবে কর্মরত ছিলেন। এবং তাঁর কাজ ছিল উট চড়ানো। তো তিনি খানিকটা কথ্য আরবি ভাষা রপ্ত করার দিকে ছিলেন। তাই একদিন, তিনি তাঁর মালিককে আরবিতে জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর উটের সংখ্যা মোট কত। কিন্তু ভাষার ওপর ভালো দখল না থাকাতে তিনি আসলে মালিককে বললেন যে ‘আপনি একটা উট’। বাস, সাথে সাথে কুল্লে হালাস, অর্থাৎ তাঁর চাকরি নট।

সিলেট স্টেশনে আমাদেরকে লাল গোলাপ দিয়ে বরণ করে নেবার জন্য এসেছিল ত্রয়ী বন্ধু জসীম, খালেদ আর জব্বার। বেজায় একটা ভিডিও রিসেপশান হলো। তারা আমাদের জন্য একটা মাইক্রো ঠিক করে নিয়ে এসেছিল। সেখানে সবার জায়গা হলেও আমি উঠলাম জসীমের গাড়িতে জসীম, খালেদ আর জব্বারের সঙ্গে। সিলেট আমি বহু বহুবার এলেও জীবনের পড়ন্ত বেলায় সস্ত্রীক বন্ধু সংসর্গে এসে সত্যি খুব ভালো লাগছিল। তারা আমাদের জন্য একটি হোটেল ঠিক করল মীরা বাজারস্থ এলাকায়।

হোটেল রুমে বসে এ লেখাটি লিখে ফেললাম, এখন রাত ৮-৫৫ মি.। ট্যুর ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা শেখর ফোন করে জানিয়েছিল নয়টার সময় নীচে ডাইনিংএ খেতে যেতে হবে। তথাস্তু।

=শেষ=

২১ অক্টোবর ২০২২

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.