সিলেট ডায়রি–২ ছায়াবৃক্ষ – মোহীত উল আলম

0

আমার বন্ধু সুলেখক খসরু খলিলুর চৌধুরী থাকে নিউ ইয়র্ক। বাড়ি কিন্তু সিলেটে। আমরা তার বন্ধুরা সস্ত্রীক সিলেট বেড়াতে এসেছি শুনে সে এত উত্তেজিত যে চব্বিশ ঘন্টায় আটচল্লিশবার টেলিফোন করে সব বন্ধুদের খোঁজ খবরতো নিচ্ছেই, সাথে সাথে সিলেটনিবাসী বন্ধু জসীম, খালেদ আর জব্বারকে এ্যাটেনশন অবস্থায় রেখেছে আমাদের যাতে কোথাও কোন অসুবিধা না হয়। খসরুর দেশের জীবন ছিল চা-বাগানের সঙ্গে। ফুলবাড়ি টি এস্টটেইট ছিল তার দেশ ছাড়ার আগে শেষ কর্মস্থল। ফুলবাড়ির বর্তমান জেনারেল ম্যানেজার লুৎফর রহমান সাহেবকে সে টেলিফোনে আগেই বলে রেখেছিল। তাই আমরা শ্রীমঙ্গলের লাওয়াছাড়া বনে ঢোকার আগে উনার বাংলোতে গেলাম। তখন খসরু, তার নিউ ইয়র্ক সময় রাত দুটোয় টেলিফোন করে বলল, এ বাগানের কোথাও ‘ইয়েস্টার্ডে, টুডে, টুমরো’ নামক ফুলটি ফুটে আছে। সেটা যেন আরেকজন ম্যানেজার শাহরিয়ার আমাদের দেখায়। শাহরিয়ার খানিকটা ঘুরে এসে আমাদেরকে জানালেন যে গাছটি মরে গেছে। খসরুও যেমন জানে, আমিও জানি যে ‘ইয়েস্টার্ডে, টুডে, টুমরো’ নামক একটি ছায়াছবি আছে যাতে অভিনয় করেছিলেন কালজয়ী অভিনেত্রী সোফিয়া লোরেন, এবং নায়ক হিসেবে সম্ভবত মার্সেলো মাস্ত্রোয়ানি ছিলেন। কিন্তু আমি জানতাম না, ঐ ছবির নামে একটা ফুলও আছে। খসরু যেমন অনবদ্য লেখে, তেমনি তার ফুল-জ্ঞান অসাধারণ। আমাদের হোয়াটসএ্যাপ বন্ধু ফোরাম তার পাঠানো ফুলের ছবি ও বর্ণনাতে ভরা থাকে। সে বাগানে থাকাকালীন ফুলের জগত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয় সম্ভবত। পেশা মানুষকে বেশ খানিকটা তৈরি করে নেয়।

ফুলের জগত থেকে আসি গাছের জগতে। এই ট্যুরে আসার পেছনে আমার লোভ কাজ করেছিল প্রধানত লাওয়াছড়া বন দেখা। বাংলাদেশের গোটা দশেক বন আমি ঘুরেছি, এবং এক এক বনের এক এক বৈশিষ্ট্য দেখেছি। লাওয়াছড়া বন আমি প্রথম দেখতে আসি নব্বই দশকের শুরুতে। চবির অধিভুক্ত ছিল তখন সিলেট এমসি কলেজের ইংরেজি বিভাগ। আমরা তিনজন সহকর্মী অনার্স পরীক্ষার ভাইভা নিতে এসে ফেরার পথে শ্রীমঙ্গলে নামি কেননা ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র ফয়েজুল মতিন এবং নজরুল তাহের বিভিন্ন চা-বাগানে কর্মরত ছিলেন। তাঁদের আতিথ্য নিই, এবং সে সুযোগে লাওয়াছড়া বোন দেখতে আসা। একটা গাছ দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। নাম—ক্লোফর্ম ট্রি। শুনেছি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ঐ প্রজাতির ঐটাই ছিল একমাত্র গাছ। বিশাল গাছ, প্রায় তিন শ ফুট উঁচু। বিশাল গুঁড়ি। শুধু মাত্র একেবারে ডগায় ছিল কিছু পত্রপল্লবিত শাখা। মনে পড়ছে, এই গাছটার অপরূপ সৌন্দর্যের কথা আমি আমার পুরষ্কার পাওয়া বই “গল্পে গল্পে ইংরেজি শেখা”-তে উল্লেখ করেছিলাম। পরে, বহুদিন পরে, একদিন ডেইলি স্টার-এ খবর দেখি ছবি সহ যে গাছটি মারা গেছে। খুব দু:খ পেয়েছিলাম। যা হোক, লাওয়াছড়া বনের মধ্যে আমার প্রধান আকর্ষণ—এর মহীরুহের সমাবেশ। প্রায় সবগুলোই বিরল গাছ। রত্তন নামক গাছগুলি সটান উঁচু উঠে গেছে এক শ দেড়শ ফুট। কী বিশাল গুঁড়ি। প্রকৃতির সম্মোহনীয় শক্তি। শিমুল, জারুল, মিনজিরি, ঘোড়ানিম, সোনালু, হরীতকী, বহেরা, গামারি, আমলকী সহ নানা চেনা-অচেনা গাছের ঘন বন লাওয়াছড়া। গাছের জন্য দৃষ্টি আটকে থাকে। বনের এই নিবিড়তা আমাকে খুব টানে। আর ঢাকা আর চট্টগ্রাম থেকে যে রেললাইনটি লাওয়াছড়া বনের বুক ফেঁড়ে সিলেটের দিকে চলে গেছে, সে রেললাইনটি বিখ্যাত–কেন না “এরাউন্ড দ্য ওয়ালর্ড ইন এইটি ডেইজ” নামক ছবিটির একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল বনভেদী এ রেলওয়ে ট্র্যাকে। এর অনেক অনেক বছর পরে প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদ তাঁর “আমার আছে জল” ছায়াছবির কিছু দৃশ্য এখানে রূপায়িত করেছিলেন। আর আজকে আমরা চবি পাশ করা এই বুড়ো দম্পতিরা রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে বসে কয়েকটা মোবাইল শুটিং করলাম। শেখর ছিল পরিচালক। হয়তো এইসব দৃশ্য সে ফেবুতে দেবে। একটা জিনিষ লক্ষ করলাম, আমাদের আচার-আচরণ, কথাবার্তায় আমরা যে নানা-নানী, দাদা-দাদীর পর্যায়ে দিন গুজরান করছি, তা কোথাও মনে হচ্ছিল না। অসুখ-বিসুখ, শরীরের ব্যথা-বেদনা যেন আমাদের জানা নেই। কলবল কলবল অবস্থা, প্রচন্ড অট্টহাসিতে মুহূর্তগুলো মুর্হমুহ ফেটে পড়ছিল। সুবোধতো আছেই সর্বক্ষণ তাত লাগানো কথার পশরা সাজিয়ে, চিকন-চাকন আব্দুল হাইও তার লাজুক মুখ দিয়ে হোমিওপ্যাথির পুইজ্জার মতো হিউমার দিয়ে যাচ্ছিলো। এই ট্রেনলাইন সম্পৃক্ত অভিনয় করার সময় আমার মনের চাপা আকাঙ্ক্ষা যেন উৎলে উঠল। আমার অভিনয় প্রতিভা না থাকাতে, এবং স্বভাবগত খুব লাজুক টাইপের হওয়াতে অভিনয় জগতে ঢুকতে পারিনি। গান গাইতে পারি না, সেটা যেমন আমার একটা আক্ষেপ, তেমনি অভিনয় করতে পারি না সেটাও আমার একটা আক্ষেপ। আমি লক্ষ করেছি আমি যে মিথ্যা বলতে পারি না, মিথ্যা বললে আমার মুখ যে লাল হয়ে যায় সেটার সঙ্গে আমার অভিনয় করতে না পারার সম্পর্ক আছে।

লাওয়াছড়া বন ঘুরে সিলেটের পথে রওয়ানা দেবার আগে আমরা জেরিন নামক আরেকটি চা-বাগানে গেলাম। সেখানে সবুজ বিস্তীর্ণ মাঠে দেখলাম এক জোড়া দোলনা। এর কিছু আগে আমরা বনে শুটিং করেছি, তার রেশ যেন রয়ে গেছে। তাই দোলনায় দুললাম জোড়ায় জোড়ায়। ভিডিও হলো। হয়তো ফেবুতে আসবে। এ ব্যাপারে এগিয়ে রইলেন রীনা ভাবী। তিনি খুব চটপটে আর আনন্দ-সমঝদার। তিনি আমার আর খুকুর দোলনায় দোলার সময় সহযোগী প্লেব্যাক সিংগারের মতো “সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে” গানটা সুন্দর গেয়ে দিলেন।

চা বাগানের জেনারেল ম্যানেজার লুৎফর সাহেবের সঙ্গে আলাপের পরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া চা-বাগানের শ্রমিক অসেন্তোষের কারণ হিসেবে বিপরীত ছবিটি পেলাম। বেতন বাড়ার দাবি হিসেবে চা-শ্রমিকেরা ঊনিশ দিন ধর্মঘট করে। পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেতন দৈনিক ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৭০ টাকা নির্ধারিত করে দিলে আন্দোলন থেমে যায়। রাষ্ট্রীয় রাজস্ব আয় বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কিন্তু ম্যানেজার সাহেব বোঝালেন যে ১৭০ টাকা হচ্ছে একজন শ্রমিকের দৈনিক নগদ আয়। কিন্তু শ্রমিকদেরকে দেয়া বিভিন্ন বিনা-খরচে দেওয়া সুবিধাদি হিসাবে আনলে এই আয় হয় দৈনিক ৪৫০ টাকা। আসলে প্রতি সমস্যার দুটো বিপরীতমুখি চিত্র থাকে। এটি জানা থাকলে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়।
আমরা ফেরার পথে মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতি চলছিল বাগানগুলোতে। দেখলাম শ্রমিকেরা রাস্তার পাশে বসেই কাগজের মধ্যে রাখা লাঞ্চ করছে। এদের চেহারা একনজর দেখলে বোঝা যায় রোগা-ভোগা নরনারী এরা, জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থা। রাজা লিয়ারের ‘বেয়ার ফর্কড এ্যানিম্যাল’-এর মতো। মনে হলো, মানবেতর পর্যায়ের জীবনযাপন এদের। মনের ভিতর দু:খ চারিয়ে উঠল।

ম্যানেজার শাহরিয়ার আমাদেরকে নিয়ে একটি আলাদা জায়গায় পৌঁছালেন। এটাকে বলা হয় বীজতলা। অর্থাৎ, চা-গাছ যেগুলি বাগানে চাষ করা হয়, যা থেকে চা-পাতা সংগ্রহ করা হয়, সে গাছগুলি হলো বনসাই করা। কিন্তু প্রকৃত চা-গাছ অন্যান্য গাছের মতোই লকলকিয়ে বড় হয়, এবং সেগুলোরই আলাদা একটি বাগান এটি। এই পূর্ণাঙ্গ গাছগুলো থেকেই চায়ের বীজ বা বিচি সংগ্রহ করা হয়, যেভাবে আমরা বড়ই গাছ থেকে বড়ই সংগ্রহ করি। চা-শিল্পের এই আশ্চর্য প্রাকৃতিক সংশ্লেষের কথা আমি আগে জানতাম না।

চা বাগানের ভিতর দিয়ে গাড়ি চলছিল আর লক্ষ করলাম, চা বাগানের সৌন্দর্য আসলে হলো এর ছায়াবৃক্ষ। শ্যাডো ট্রি। চা বাগানের সবুজ নিবিড় চারাগুলোর ওপর কিছু দূরে দূরে এই গাছগুলি পোঁতা হয়েছে, এবং সেগুলিই অপূর্ব ল্যানস্কেইপ তৈরি করছে। আমাদের ভাড়া করা মাইক্রোর সাথে জসীম নিয়েছিল তার প্রাইভেট গাড়িটা। মোট তেরজনের দল। লাওয়াছড়া থেকে শ্রীমঙ্গল পৌঁছে “পানসী” নামক ব্যস্ত রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম মধ্যাহ্নভোজন সারতে। যদিও দেখলাম ঘড়ি বলছে সাড়ে তিনটা। খাওয়া-দাওয়ার পর ফিরতে ফিরতে প্রকৃতিকে সচকিত করে দিয়ে সন্ধ্যা নামল। দূরের দিগন্তের বৃক্ষরাজি দুর্দান্ত এক সিলুয়েট তৈরি করল। মৌন পরিবেশ। সহসা রাত নামল। মাইক্রোর ড্রাইভারকে কয়েকবার মনে হলো মনসংযোগ হারাচ্ছেন।

এক সময়ে আমাদের মাইক্রো একটি পেট্রোল পাম্পে ঢুকল। আমি গাড়ি থেকে দেখতে পেলাম, তেল নেবার পাম্পের ওপরে একটি স্টিকার লাগানো হয়েছে। বলা হচ্ছে যে ‘এক লিটারের কমে তেল দেওয়া যাবে না’। সুবোধ এই কথাটা নিয়ে এমন হাসি ঠাট্টার আয়োজন করল যে কাউকে তেল মারতে গেলে এক লিটারের কম মারা যাবে না, এই কথা সে বলল, আর আমাদের হাসিতে দম আটকে আসার উপক্রম। সে আনন্দের রেশটুকু নিয়ে আমরা হোটেলে ফিরলাম।

=শেষ=
২৩ অক্টোবর ২০২২

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.