হারিয়ে যাচ্ছে শার্টের পকেটে কলম রাখা মানুষ গুলো, হারিয়ে যাচ্ছে চিঠি ~~ নেছার আহমেদ খান
গ্রামীণ জীবনের শৈশব আর শহুরে জীবনে তেমন পার্থক্য ছিলনা আমাদের। তখন সংস্কৃতি টা একই সড়কে চলমান ছিল। সে সময়ের পোশাক আশাক চাল চলনের সাথে একটি উন্নত বৈশিষ্ট্য ছিল শিক্ষার আলোকে কলমে প্রকাশ। একজন শিক্ষিত মানুষ তাঁর পরিপাটি পোশাকে থাকবে আর পকেটে কলম থাকবেনা তা হতে পারেনা। আজ লেখার জন্য কাগজের প্রয়োজন হয়না তাই হয়ত কলমটা পকেটের জন্য ভরী বোঝা হয়ে গেল। সে সাথে চিঠি!
হাতে কলম আর টেবিলে রাখা সাদা কাগজে চেয়ারে বসে লেখা পত্র গুলো আজ উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এবং কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসেছে। আসলে এটাই বাস্তব, এই সময়টাই যে কবিতা, চিঠি, আবেদন কিংবা পত্রিকা অফিসে সংবাদ পাঠানোর জন্য এখন আর কাগজ-কলম নয়, এর ব্যবহারটা এখন কম্পিউটারের মাধ্যমে ইন্টারনেট, এসএমএস, ই-মেইলসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিতে আদান-প্রদান চলছে। অবশ্য চিঠি লেখার সময়ই বা কোথায়? মুঠোফোন, ইন্টারনেট, চ্যাট, ই-মেইল, এসএমএস এবং ফেসবুকের গতির ধাক্কায় কাগজ-কলমে হাতে এখন আর লেখা হয় না। সময়সাপেক্ষ বলে এ যুগে আর খাপ খাইছে না। একসময় বাবার কাছে টাকা চেয়ে পুত্রের চিঠির যে আবেদন ছিলো, তা এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়ের কাছে অজানাই থেকে যাচ্ছে। পুত্রের কাছে মায়ের একটা চিঠি কিংবা মায়ের কাছে পুত্রের একটা চিঠির কী আবেদন তা বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির আলোয় বেড়ে ওঠা একটি ছেলে বা মেয়ের অনুভূতিতে কখনোই স্পর্শ করবে না। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমরা যখন অভ্যস্ত ছিলাম না তখন চিঠিই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো, এই চিঠিই কখনও বিনোদনের খোড়াক যোগাত, কখনও ব্যথাতুর হৃদয়ে কান্না ঝরাতো, কখনও উৎফুল্ল করত, কখনও করত আবেগে আপ্লুত কী যে সেই অদ্ভুত টান কালি ও কাগজে লেখা চিঠিতে।
কিছু কিছু চিঠি বারবার খুলে পড়ে আবার ভাঁজ করে রাখতে রাখতে ভাঁজের অংশগুলোই ছিঁড়ে যেত। বিশেষ করে প্রেমের চিঠি, চিঠি পাওয়ার আকুলতা কিংবা চিঠি পড়ার আনন্দ সব ইন্টারনেটের এ যুগে কাগজ-কলমে লেখা চিঠির প্রচলন অনেক কমে গেলেও তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। অনেক অফিসিয়াল চিঠি এখনও প্রতিদিন ডাক বিভাগের মাধ্যমেই আসে। তবে প্রযুক্তির ছোঁয়া ডাক বিভাগেও লেগেছে। ফেসবুক টুইটার কিংবা মেইলে চিঠি বা তথ্যের আদান-প্রদান যত দ্রত হোক না কেন কাগজে লেখা চিঠির সেই আবেগময়তা যেন আজও ভুলবার নয়।বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে নিত্য নুতন সব প্রযুক্তি। আজ পকেটে পকেটে মোবাইলফোন। নিমিষেই প্রিয়জনের কাছে পৌঁছে যায় হৃদয়ের কথা। কাগজে চিঠি লিখে আবার তার জবাবের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকা সেই সময়টুকুও আজ হারিয়ে গেছে। আগের দৃশ্যটা কেমন ছিলো। একটা সময় ছিল একটি কাগজে চিঠি লিখে তার জবাব পাবার জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রিয় মানুষকে। চাতক পাখির মত পথের পানে চেয়ে থাকতে হয়েছে। কখন আসবে সেই চিঠি! কখন ডাক পিয়ন জোরে দরাজ কণ্ঠে বলবে চিঠি এসেছে চিঠি, বাড়িতে কে আছেন? প্রিয় মানুষের কাগজে লেখা খামে ভর্তি চিঠি হাতে পেয়ে খুশিতে একেবারে আটখানা।
এটাতো সাধারণ মানুষের কথা বললাম। আমাদের সময়ে শিক্ষকদের পকেটে দুটি কলম থাকতো। একটি কালো আরেকটি লাল। আমরা বুঝতাম ওনি শিক্ষক। কারণ সে সময়ের পোশাক আশাক চাল চলন শিক্ষকদের আলাদা পরিচয় দিত। এখন সেই সব শিক্ষকদের প্রজন্ম আপডেট হয়েছে। তারা পকেটে কলম রাখা সুন্দর মনে করেনা। আর তাই শার্টের পকেটে কলম রাখা মানুষ গুলো বিলীন হচ্ছে ধীরে ধীরে।
একসময় মার্জিন টানা কাগজে বলপেন কিংবা রেডলিপ কলম দিয়ে লেখা একটি চিঠির আনন্দই ছিলো আলাদা।পরিবার, অফিস ও প্রতিষ্ঠান তথা মানুষে মানুষে যোগাযোগের মাধ্যম এই চিঠি জীবনের নানা বিষয় তুলে ধরত। কাগজে চিঠি লেখার বাক্য চয়ন, ভাষার প্রায়োগিক ব্যবহার, চিঠির কথা সব মিলিয়ে চিঠির নান্দনিকতায় স্নেহ ভালবাসার পূর্ণতায় এক অপার মমত্ত উঠে আসত। হাতের লেখা একটি চিঠি হৃদয়ের শত সহস্র কথাই শুধু বলতনা, আবেগ আকুলতা ও ব্যাকুলতা সবই প্রকাশ পেত। মা-বাবা যখন সন্তনের হাতের লেখা চিঠি পড়তেন, তখন লেখার মধ্যে হৃদয় দিয়ে সন্তানের মুখ দেখতে পেতেন। অবচেতনে চিঠি বুকে জড়িয়ে আদর দিতেন। প্রণয়ের চিঠি তো ছিল একেকটি প্রেমের হতিহাস। প্রেমিক-প্রেমিকা হৃদয়ের আকুলতা-ব্যাকুলতা প্রতীক্ষার প্রহরের খুঁটিনাটি ভাষার মাধুর্যে এমনভাবে লিখত, যা পড়ে মনে হতো শত ফুল দিয়ে গাঁথা একটি গল্প বা উপন্যাস।
প্রণয়ের কাগজে চিঠি লিখতে কত পাতা যে ভরে যেত, তার কোন সীমারেখা থাকত না। বেশি পাতার চিঠি হলে খামের ওপর বাড়তি টিকিট লাগাতে হতো। বাড়তি মাশুল না দিলে প্রাপককে তা পরিশোধ করতে হতো। খামের ওপর অর্ধচন্দ্রের সিলমোহর আঁটা এই চিঠিকে বলা হতো বেয়ারিং। হাতে লেখা চিঠি পরিবারের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক ও ভালবাসায় গভীরতার সেতু গড়ে দিত। আজ কলম হারিয়েছে পকেট আর চিঠি হারিয়েছে খাম।
লেখক : সমাজকর্মী লেখক ও কলামিস্ট