বঙ্গবন্ধু ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম । ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম ।
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম দু জনেই ছিলেন স্বাধীনতার অগ্নি পুরুষ।
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম দু জনেই ছিলেন স্বাধীনতার অগ্নি পুরুষ। বাঙালি উজ্জীবিত হয়েছিল এই দুই স্বাধীনতাকামী মহা পুরুষের দ্বারা। বাঙালির জয় হোক বলে যে মুক্তির কথা কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধু সেই সাধকেই পরিপূর্ণতা দিলেন জয়বাংলা বলে। দুজনেই আজীবন সংগ্রাম করেছেন সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে। বলা হয়ে থাকে সাহিত্যের কবি কাজী নজরুল, আর রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু। পশ্চিমবঙ্গের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ সালের বিশেষ সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী “…বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন দেশের শোষন পীড়িত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম, আন্দোলন করেছেন, কারাবরণ করেছেন, আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন ঠিক তেমনি নজরুলও শোষিত বঞ্চিত মানুষের কথা লেখনীর মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন- আর এই কারণেই কারাবরণ করতে হয়েছে। তাই একদিকে বাংলা সাহিত্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তেমনি অন্যদিকে রাজনীতির কবি শেখ মুজিবুর রহমান।” কাজী নজরুল ইসলাম কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও ব্যক্তিগত জীবনে অবিভক্ত বাংলার রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। এ সময় তিনি অবিভক্ত বাংলার কংগ্রেসের বিভিন্ন অধিবেশনে যেমন মেদিনীপুর, হুগলি, কুমিল্লা, ফরিদপুরসহ অনেক জায়গায় অংশগ্রহণ করেছেন। এমন কি ১৯২৬ সালে নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন। যদিও তিনি ওই নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। কবি কাজী নজরুল প্রত্যক্ষভাবে ১৯২৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসের প্রাদেশিক রাজনীতিতে আসেন। তিনি কৃষক- শ্রমিক শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। শ্রমিক- প্রজা- স্বরাজ দল গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৫ সালে তিনি লাঙল পত্রিকার প্রধান পরিচালক নিযুক্ত হন। লাঙল পত্রিকার সম্পাদনা থেকেই কবি নজরুলের রাজনৈতিক আর্দশ প্রকাশের উদ্যোগের প্রমাণ পাওয়া যায়।‘শ্রমিক- প্রজা- স্বরাজ- সম্প্রদায়ের মুখপত্র হিসেবে এই পত্রিকাতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহু কবিতা ( সাম্যবাদী, কৃষাণের গান, সব্যসাচী, শ্রমিকের গান, সর্ব্বহারা) রচনা করেছিলেন এবং সমাজতন্ত্রের জয়গান গেয়েছিলেন। জনৈক গবেষক কাজী নজরুলের রাজনৈতিক চেতনা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, “রাজনীতির এই ঘোরময় মুহূর্তে নজরুল দর্শনগত দিক থেকে কখনো কমিউনিজমের শরণাপন্ন, আবার কখনো ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেসের। তাঁর চেতনায় একদিকে আলোড়িত ছিল পুঁজিবাদের কশাঘাতে বঞ্চিত মানুষের মুখ- সেখানে তিনি হয়েছেন সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার দ্যোতক, সেখানে তাঁর আশ্রয় হয়েছে সমাজতন্ত্র, কর্মপদ্ধতি হয়েছে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব।” (হাসানুর রশীদ, কবি নজরুলের রাজনীতি ও দর্শন, ভোরের কাগজ, ২৮ আগস্ট ২০১৫) বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিঝরা কবিতা ও গান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জুগিয়েছে। মূলত বঙ্গবন্ধুর সাথে আমরা কাজী নজরুলের রাজনৈতিক দর্শনের বেশ মিল লক্ষ্য করি। হয়তোবা কাজী নজরুলের দর্শন বঙ্গবন্ধুকে বেশ টানতো। কবি নজরুল যেমন শ্রেণি বৈষ্যমের অবসান চেয়েছেন, বঙ্গবন্ধুও ঠিক তাই। দুজনেই চেয়েছেন সমাজ থেকে শোষণ, শাসন ও বঞ্চনার অবসান ঘটুক। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা থেকেই বঙ্গবন্ধু অনুপ্রেরণা লাভ করেন। এ কারণেই কাজী নজরুল ইসলামের ‘ বাংলার জয়’ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জয় বাংলা’ এক এবং অভিন্ন। নজরুল গবেষক মুহম্মদ নূরুল হুদা যথার্থই বলেছেন, “ আসলে বাঙালিত্বের সংজ্ঞায়নের প্রশ্নে নজরুল ও বঙ্গবন্ধু দুটি সম্পূরক সত্তা। একজন পূর্বসূরী, অন্যজন উত্তরসূরী।” (মুহম্মদ নূরুল হুদা সম্পাদিত, বিদ্রোহী কবি ও বঙ্গবন্ধু) কবিকেও অসম্ভব শ্রদ্ধা ভরে দেখতেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরই বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টাতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় আনা হয়। ১৯৭২ সালের ২০ মে তারিখে বঙ্গবন্ধু তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবে তদানীন্তন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজসেবা সম্পাদক মোস্তফা সারওয়ার এবং পূর্তমন্ত্রী মতিউর রহমানকে কোলকাতায় পাঠান। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তাঁর ৭৩ তম জন্মবার্ষিকী ঢাকায় উদযাপন করার। বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে একটি চিঠি দেন। চিঠির বিবরণে লেখা হয়: “ আমি আমার বন্ধু ও সহকর্মী জনাব মতিউর রহমান এবং আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক জনাব মোস্তফা সারওয়ারকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। অনুগ্রহপূর্বক আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন। মুক্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগণ ও আমার পক্ষে আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনার জন্মবার্ষিকীতে আপনার আদর্শে বাংলাদেশকে সিক্ত হতে দিন। আমরা বাংলাদেশে সাগ্রহে আপনার আগমনের প্রতীক্ষা করছি। আমি আশা করি, আপনি অনুগ্রহ করে আসবেন। জয় বাংলা।” বঙ্গবন্ধুর চিঠির বরাত দিয়ে ঢাকার পত্র পত্রিকাগুলো নিউজ হেড লাইন করে। ১৯৭২ সালের ২১ মে তারিখে সংবাদ লিখেছিল, ‘ বাংলাদেশ আপনার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছে, বিদ্রোহী কবির কাছে বঙ্গবন্ধুর চিঠি।’ বাংলাদেশে কবি কাজী নজরুল ইসলামের পদার্পন নিয়ে দৈনিক বাংলা ১৯৭২ সালের ২৪ মে তারিখে ‘ নজরুল প্রেরণার পথে’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেছিল: “ … বাংলাদেশ আজ মুক্ত স্বাধীন। আমরা ভাগ্যবান, আজ এই স্বাধীন স্বদেশে কবি এসেছেন আমাদের মাঝে। তাকে বরণ করছি আমরা মুক্ত হ্নদয়ে, তাঁর কবিতার শৃঙ্খল মুক্তির অপার আনন্দে। এতদিন নজরুলকে আমরা পেয়েছিলাম খন্ডিত করে। কায়েমী স্বার্থচক্র দীর্ঘ দুই যুগ ধরে তার কবিতা আর গানের পরিপূর্ণ সৌরভ থেকে বঞ্চিত রেখেছিল বাংলাদেশের মানুষকে। আজ সে তিমির হনন করে কবিকে আমরা তাঁর পরিপূর্ণ সত্তায় বাঙময় করে তোলার সুযোগ পেয়েছি।” কবির আগমনে অত্যন্ত আবেগ্লাপুত ভাষায় দৈনিক বাংলার ওই সম্পাদকীয়তে আরো বলা হয়েছিল, “ … আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগে, ১৩৩৯ সালে শেষবারের মতো বাংলাদেশে এসেছিলেন কবি। জনপ্রিয়তার শিখরে তিনি তখন। ঢাকার বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং নাগরিক সাধারণ ঐতিহাসিক সংবর্ধনায় বরণ করেছিলেন তাঁকে। তিনি ছিলেন মুক্ত বিহংগ। আবেগে, পৌরুষে, প্রাণের বিভবে, উদার সতেজ কন্ঠের বলশালিতায় ছিলেন উচ্ছ্বল দ্যুতিময়। বাংলাদেশের মানুষ এবং প্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার কৈশোর আর যৌবনের স্মৃতি। তার বহু শ্রেষ্ঠ কবিতার জন্ম এখানে। এ মাটির সঙ্গে সংযোগ তার নাড়ীর। তাকে একটিবার দেখার জন্যে, কবির নিজের গলায় তার কবিতা, গান শোনার জন্যে একদিন বন্যার স্রোতের মতো এখানকার মানুষ ভেঙ্গে পড়তো তার চারপাশে। আজো তার পাশে তেমনি জনসমুদ্র। কিন্তু তিনি এখন নীরব। গানের পাখি সাড়া জাগাবে না আর। তবুও তাকে দেখে চেতনাকে সজাগ করবো আমরা। আপ্লুত করবো তাকে অকৃত্রিম শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। হ্নদয়ের এ উষনাতায় তার চৈতন্যে কোনো আবেগ সঞ্চারিত হবে কিনা, জানি না। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড়ো সান্ত্বনা তার কবিতার অগ্নিবীণায়, গানের স্নিগ্ধ সরোবরে বেঁচে আছেন তিনি। শুধু বেঁচে নয়, অমৃতের পুত্র হয়ে আছেন।” পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়, “ … তিনি মানুষের সংগ্রামের নিত্যসহচর। উৎপীড়িত জনের চিরসাথী তিনি। বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম শেষ হয়নি এখনো। দু:খ- দারিদ্র্য আর হতাশার বিরুদ্ধে এখনো সংগ্রামে ব্রতী তারা। প্রকৃত সোনার বাংলা গড়ার পরই শেষ হবে এ সংগ্রামের। সেদিনই কেবল আকাশে বাতাসে আর ধ্বনিত হবে না উৎপীড়িতদের ক্রন্দন রোল। বিদ্রোহী রক্তাক্ত কবি সেদিন থামবেন। তার এ সংকল্পে এবং প্রেরণায়ই উজ্জীবিত আমরা। তাঁর এ আলোর পথ ধরেই আজ যাত্রা করছি আমরা। তিনি আছেন আমাদের সঙ্গে, চিরকাল থাকবেন।”
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঢাকায় আগমন উপলক্ষে ১৯৭২ সালের ২৫ মে তারিখের দৈনিক বাংলা পত্রিকাটি বঙ্গবন্ধুর উক্তি দিয়ে সংবাদ শিরোনাম করেছিল। উক্তিটি ছিল ‘ বাংলাদেশের বিদগ্ধ সমাজকে কবির সৃষ্টির পূর্ণ মূল্যায়নের দায়িত্ব নিতে হবে।’ঢাকায় কবি নজরুলের আগমনের দিনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সহধর্মিনী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এবং তদানীন্তন তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীকে নিয়ে কবিকে দেখতে যান। এ সময় কবির পাশে ছিলেন তাঁর পূত্রবধু। বঙ্গবন্ধু কবিকে দেখতে গেলে সেখানে এক হ্নদয়স্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হয়।‘কবি ও বঙ্গবন্ধু : এক হ্নদয়স্পর্শী দৃশ্য’ শীর্ষক শিরোনামে দৈনিক বাংলা পত্রিকা মন্তব্য করেছিল: “বঙ্গবন্ধু গভীর শ্রদ্ধা ভরে পুষ্প মাল্য পরিয়ে দিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। পরম স্নেহে বার বার হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন কবির মাথায়। পিঠে। সর্বাঙ্গে। নির্বাক কবি অপলক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলেন বঙ্গবন্ধুর দিকে। হাত বাড়িয়ে বিড় বিড় করে কী যেন বললেন বঙ্গবন্ধুকে। বাকশক্তিহীন সে মুখের ভাষা বোঝা গেল না। দুর্বোধ্য সেকটি কথা।” ( দৈনিক বাংলা, ২৫ মে ১৯৭২)
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে ঘনিষ্টতার স্মৃতি বঙ্গবন্ধুর বহু পূর্বেই। কবির কন্ঠে গান শুনেছিলেন ১৯৪১ সালের দিকে ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্সে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখছেন, “… ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন।” ( অসমাপ্ত আত্মজীবনী ) সেই কবিকেই ঢাকায় বঙ্গবন্ধু নিয়ে এসেছেন একান্ত আপনার করে। গবেষক পিয়াস মজিদ যথার্থই মন্তব্য করেছেন, “ ইতিহাসের আশ্চয কাকতাল, ১৯৪১-এ যে তরুণ শেখ মুজিব নজরুলকে কাছ থেকে দেখলেন, তাঁর গান শুনলেন; ঠিক ৩০ বছর পর ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে বাঙালি জাতির স্বাধীন ভূখন্ড অর্জনের পর স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই নজরুলকে নিয়ে এলেন রাষ্ট্রীয় মযার্দায়।” (পিয়াস মজিদ, বঙ্গবন্ধুর বয়ানে সাহিত্য ও সাহিত্যিক, দৈনিক প্রথম আলো, ১০ আগস্ট ২০১৮)
বঙ্গবন্ধু কবি নজরুল ইসলামকে ঢাকায় এনেই ক্ষান্ত ছিলেন না। কবির সুযোগ সুবিধার বিষয়টিও চিন্তা ভাবনার ভেতর রেখেছিলেন। কবিকে ঢাকায় ধানমন্ডিতে রাখার ব্যবস্থা এবং আর্থিক বরাদ্দের বিষয়েও বিবেচনাও করেন। বাংলাদেশ কবিকে মাসে এক হাজার টাকা ভাতা দেবে শিরোনামে দৈনিক বাংলা লিখেছিল:“ গতকাল বুধবার ( মে ১৯৭২) বাংলাদেশ সরকার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে মাসে এক হাজার টাকা ভাতা মঞ্জুর করেছেন। এখন থেকে তা কাযর্করী হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল বিকেলে কবি নজরুলকে তার ধানমন্ডী বাসভবনে দেখে আসার পর এই সরকারী সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন।” ( দৈনিক বাংলা, ২৫ মে ১৯৭২)
কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। ঢাকায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ কবি নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালীর স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার।’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম জয়ন্তীতে বঙ্গবন্ধু শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার সেই চির চেনা উপমা “আয় চলে আয় রে ধূমকেতু, আধারে বাঁধ অগ্নি সেতু, দুর্দিনের এই দুর্গ শিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!” ব্যবহার করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু আরো বলেছিলেন, “ সাহিত্যে সম্মানের সুউচ্চ শিখরে নজরুলকে পথ করে উঠতে হয়নি, পথ তাকে হাত ধরে উর্ধ্বে তুলেছে। মহা অভ্যাগতের মত তাঁর আগমন নন্দিত হয়েছে। সে এসেছে ঝড়ের মাতম তুলে, বিজয়ীর বেশে।”
কবি কাজী নজরুল ইসলামের মূল্যায়ন না হওয়ায় প্রায় প্রতিটি বাঙালির মতো বঙ্গবন্ধুরও আক্ষেপ ছিল। নজরুল জয়ন্তীতে দেয়া বঙ্গবন্ধুর বাণীতে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন সাহিত্য প্রেমিক। কারাগারে তাঁর প্রিয় সঙ্গী ছিল সুন্দর সুন্দর বই। তাঁর বক্তৃতা বিবৃতিতে উপমা হিসেবে ব্যবহার করতেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার বিভিন্ন চরণ। বঙ্গবন্ধু তিনি তাঁর প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ কবিতাটিকে যেমন জাতীয় সংগীতে রূপ দিলেন ঠিক তেমনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ কবিতাটিকেও রণ সঙ্গীতের মযার্দা দেন।
এটা যেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি শুধু বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার বহি:প্রকাশ নয়। সমস্ত বাঙালির ভালোবাসার বহি:প্রকাশ। গবেষক মুহম্মদ জাহাঙ্গীর মন্তব্য করেছেন, “ … বাংলাদেশ সরকার তার গানকে (চল চল চল) জাতীয় রণসঙ্গীতে গ্রহণ করতে পেরে অতিশয় ধন্য হয়েছে নি:সন্দেহে। নজরুল আমাদের বীর সেনাদের চলার ছন্দে বেজে উঠবে প্রতিদিন। অনুপ্রেরণা দেবে তার সুর রণকৌশলে।” ( মুহম্মদ জাহাঙ্গীর, নজরুলের বাংলাদেশ, দৈনিক বাংলা, ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) এভাবে কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের সত্ত্বায় মিশে যান, হয়ে উঠলেন আমাদের জাতীয় কবি। চলার পথ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও আমাদের অস্তিত্বে সর্বক্ষণ অনবরত দোলা দিচ্ছেন ।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাতনী খিলখিল কাজী বঙ্গবন্ধু ও কবি নজরুল ইসলামের তুলনা করতে গিয়ে একজনকে বলেছেন মহাকবি এবং অন্যজনকে মহানেতা। খিলখিল কাজীর ভাষায়, “ এই মহাকবি ও মহানেতা দেশের জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- এক এবং স্বতন্ত্র ও এককভাবে বাঙালির প্রাণে আজীবন স্পন্দিত হতে থাকবেন- যার ক্ষয় নেই।
লেখক : ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম – প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর : পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ।