সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা

0

হীরেন পণ্ডিত : সংস্কৃতি একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করে। গবেষকদের মতে, ভাষা, সাহিত্য, রীতিনীতি, মূল্যবোধ, জ্ঞান, শান্তি, শৌর্য, বিশ্বাস, চিরাচরিত প্রথা মনোভাব প্রস্তুতির সমাহার হচ্ছে সংস্কৃতি। জীবনের অন্তর্গত সব বিষয়, কর্ম, চর্চা ও সাধনাই সংস্কৃতি। বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার লক্ষ্যে পালিত হয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য।

সামাজিক গতিশীলতার জন্য সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ অপরিহার্য। পাশাপাশি জরুরি একটি সাধারণ নৈতিক কাঠামো। সেক্ষেত্রে নৈতিকতা ও সাংস্কৃতিক বহুত্বকে পাশাপাশি রেখে পাঠ করতে পারাটা জরুরি। স্পষ্ট হওয়া জরুরি দুইয়ের মধ্যকার সীমারেখা নির্ধারণের ব্যাপারে। সে দায়িত্বটা অবশ্যই সমাজের সর্বস্তরের ওপরেই।

সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উন্নয়নের চালিকা শক্তি। এটি শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং মানুষের আধ্যাত্মিক, আবেগ, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এমন একটি সম্পদ, যা দারিদ্র্য দূরীকরণ ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ সাধন করতে হবে। এ জন্য মিডিয়া ও তথ্যপ্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
উন্নয়ন ও শান্তির জন্য একে অন্যকে শ্রদ্ধা ও সম্মান না করে আমাদের উপায় নেই। পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্যই মানবসমাজকে এই ভিন্নতাকে স্বীকার করে নিতে হবে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সত্যকে মেনে নিতে হবে। সমাজে সহনশীলতা ও সহমর্মিতাকে এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের দেশ ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জাতিবৈচিত্র্যেও দেশ। লিঙ্গবৈচিত্র্য ও প্রতিবন্ধিতার বৈচিত্র্য নিয়েও আজকাল আলোচনা হচ্ছে। সংস্কৃতির মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য টেকসই পদ্ধতিকে সহযোগিতা করা, সাংস্কৃতিক সামগ্রী ও সেবার ভারসাম্যপূর্ণ প্রবাহ অর্জন, টেকসই উন্নয়নকাঠামোতে সংস্কৃতিকে সম্পৃক্তকরণ এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার বিকশিতকরণ।

সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উদ্‌যাপনের জন্য মানবমর্যাদার উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। সাংস্কৃতিক অধিকার অর্জন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ তৈরি করে। আবার বাক্‌স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ভাষার বহুত্ববাদ, শিল্পকলা, প্রযুক্তিজ্ঞান ও বিজ্ঞানশিক্ষায় সমান অধিকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে। সমাজে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সম্মানীয় হলে তা ফলপ্রসূ সংলাপকে সহায়তা করে ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে। শুধু তা-ই নয়, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সমাজে সামাজিক বন্ধন, পারস্পরিক সহযোগিতা, যোগাযোগ, উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

বাংলাদেশে বসবাসরত জনোগোষ্ঠীর চলমান সংস্কৃতিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে নগরসংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি ও আদিম সংস্কৃতি। নগরসংস্কৃতি আধুনিকতার আলোকপ্রাপ্ত, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি প্রভাবিত। নগরসংস্কৃতি স্বরূপে সংস্কারধর্মী এবং সঙ্করধর্মী। শিক্ষিত নাগরিকরা সহজেই সংস্কৃতির এসব উপকরণ রপ্ত করে নেয়।

বাংলাদেশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীগুলোর সংস্কৃতির হাজার হাজার উপকরণ রয়েছে। আবার সেই উপকরণগুলো নানা বৈচিত্র্যও রয়েছে। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে জীবনযাপন পদ্ধতি, জীবনের বিচিত্র অবস্থা, মানুষের মানবিক অধিকার, তাদের মূল্যবোধের ধারা, তাদের আবহমান ঐতিহ্য ও বিশ্বাস ইত্যাদি। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি বাংলাদেশের মানুষকে বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ জীবন দান করে, বিবেচনা শক্তি দেয় এবং মানুষের মাঝে নৈতিকতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। সংস্কৃতির এই বৈচিত্র্যের মাধ্যমে আমরা মূল্যবোধের শিক্ষা পাই এবং নিজেকে অন্যদের মাঝে পরিচিত করে তোলার সুযোগ পাই কিংবা নিজেদের মধ্যকার সীমাবদ্ধতাগুলোকে অতিক্রম করার সুযোগ পাই। সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্তেরই অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার গুরুত্ব আরোপ করে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর, সারা দেশের গ্রামগঞ্জ ঘুরে ঘুরে মানুষের জীবনের চাহিদাগুলো উপলব্ধি করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। পরবর্তীতে মানুষের সেসব আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে একের পর এক রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করেছেন। তেমনি ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে কয়েক দশক ধরে স্বাধীন বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো পরিদর্শন করে মানুষের দারিদ্র্যতার কারণ এবং মুক্তির উপায় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর দেশ থেকে মঙ্গা দূরীকরণ এবং মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য একাধিক উদ্যোগ নেন তিনি।
আবহমান বাংলার চিরায়ত শান্তি ও সৌহার্দ্যরে সংস্কৃতি লালন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণায় নতুন প্রজন্মকেও ডিজিটাল করে গড়ে তোলার ইশতেহার দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশি-বিদেশি নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উন্নয়ন, অগ্রগতি আর সমৃদ্ধির পথে হাঁটছেন। ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য চারটি ভিত্তি সফলভাবে বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন নিরলসভাবে। এর পাশাপাশি হাতে নেওয়া হয়েছে ২১০০ সালের বদ্বীপ কেমন হবে- সেই পরিকল্পনা। স্মার্ট বাংলাদেশে সব কাজ, সম্পাদন করা হবে প্রযুক্তির মাধ্যমে। যেখানে প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে হবে দক্ষ। ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিভিত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক এবং উদ্ভাবনী বাংলাদেশ।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শীর্ষক আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক উপ-কমিটির আলোচনায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল এর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় এ বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপের কথা জানান উপকমিটির চেয়ারম্যান মঞ্চ সারথি আতাউর রহমান। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, এমপি উল্লেখ করেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ায় বর্তমান সরকার তৎপর রয়েছে। দেশের সাংস্কৃতিক উন্নয়নকেও ত্বরান্বিত করে সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করার জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগ এর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মাধ্যমে নতুন শপথে দেশ এগিয়ে যাবে। বাঙালির হাজার বছরের অবিনাশী সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশে আওয়ামী লীগের কাছেই জনগণের সব প্রত্যাশা। সে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করছে সরকার এবং সংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠকরা।

সভায় আরো অলোচনায় অংশ নেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান, সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য নায়ক ফেরদৌস আহমেদ। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আনিসুল ইসলামসহ সংস্কৃতি বিষয়ক উপকমিটির সদস্যবৃন্দ।

সংস্কৃতিচর্চায় সমৃদ্ধির আকাক্সক্ষা থেকেই সুস্থ চর্চার মাধ্যমে সংস্কৃতির সুরক্ষা দান এবং বিকাশ সাধনের মধ্য দিয়ে সাধারণের মধ্যে নবজাগরণ সৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ নিরলসভাবে কাজ করছে। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একদিকে যেমন অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা সৃষ্টি সম্ভব, অন্যদিকে তেমনি মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার প্রণোদনা দানও সম্ভব। বর্তমান বাস্তবতায় এবং ভবিষৎমুখী সামাজিক প্রবণতা লক্ষ্য করলে অসাম্প্রদায়িক এবং মানবিক মানুষের যে কত প্রয়োজন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং স্মার্ট সরকারকেই তরুণ প্রজন্মকে রুচিশীল সংস্কৃতি শিক্ষায় গড়ে তোলার অঙ্গীকার করতে হবে। আমাদের সব উন্নয়ন ও সৃষ্টিকর্ম যুগের পর যুগ নতুন নতুন প্রজন্মের হাত ধরে সার্থকরূপে টিকে থাকবে এটাই সকলের প্রত্যাশা।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই, এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য কী অসীম শক্তির ভান্ডার হিসেবে কাজ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে। আজকের প্রেক্ষাপটে যদি চিন্তা করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আমাদের রাজনৈতিক দর্শনগত আন্দোলনের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ, তার স্বরূপ সন্ধান করা যাবে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.