মনের জানালা ও বিশ্বচিত্র । ময়েন চৌধুরী
মনের জানালা ও বিশ্বচিত্র
প্রতিটি মানুষের একটি নিজস্ব মনের জানালা আছে। এই জানালা দিয়ে সে নিজেকে দেখে, প্রকৃতি দেখে, পরিবেশ দেখে, আকাশ, পাতাল, পৃথিবী আর বিশ্বব্রহ্মান্ড দেখে৷ এই জানালা, যাকে আমরা চেতনা-কাঠামো বা প্যারাডাইম বলতে পারি, তার বিস্তার আর অবস্থান সম্পর্কে খুব সহজেই আমরা কোনো নির্দিষ্ট সত্যকে তুলে ধরতে পারি না। জাগতিক বাচাল ভাষায় যুক্তি দিয়ে যখনি আমরা একজন মানুষের জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে বিশ্লেষণ করতে যাই, ঠিক তখনি আমাদের ব্যক্তিগত অহং নিজস্ব সত্তার আবরণ মাখিয়ে দেয় যে-কোনো প্যারাডাইমিক বিশ্লেষণে, আর তার ফলে সমগ্রের মাঝেই বারবার ঘুরে ফিরে আসে অহং-এর উপস্থিতি। একজন নিঃসঙ্গ মানুষ তাই শুধুমাত্র তার নিজস্ব জানালা নিয়েই বিবর্তিত হতে থাকে দেশ-কাল-মাত্রার এই পৃথিবীতে।
একজন ব্যক্তিমানুষের ব্যক্তিগত জানালার ছবি সমগ্রের সম্পদ নয়, এই সত্য-মূল্যই আমাদের প্যারাডাইমে অবস্থান করছে। তবু, এ কথাও সত্য যে, আমরা আমাদের নিজস্ব ভাষা ও চিন্তায় জানালা খুলে বারবার দেখতে চেয়েছি ব্যক্তি ও সমগ্রের বিশ্বকে। দেকার্তের কাজিটো বা ‘আমি’, আমার নিজস্ব জানালা নিয়েই হয়ে উঠছে অস্তিত্বশীল। ‘আমি’র জানালা খুলে বিচিত্র চিত্র দেখার জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতির, আর লাকাঁ উন্মোচন করতে চেয়েছেন মানবিক চৈতন্যের অস্তিত্ববাদী সমস্যা ও চরিত্রকে। মানবিক চেতনা-কাঠামো যে বিশ্বচিত্র ধারণ করে তার মূলে অবস্থান করছে ভাষা, আর তাই মার্টিন হাইডেগারকে বলতে হয়েছে, ভাষাই সত্তার নিবাস৷ মনের জানালা দিয়ে অহং ও সমগ্রের বিশ্বচিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যখন ভাষাই হয়ে উঠল মুখ্য, তখন এডওয়ার্ড সপির ও ফ্যার্দিনান্দ সস্যুরের বৈপ্লবিক ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমাদের উপহার দিল এক নতুন চিন্তা-কাঠামো, আমাদের মনের জানালার বিস্তার বাড়ানোর এক নতুন অস্ত্র। পরবর্তীকালে জাক দেরিদা ভাষার তুলতুলে, নরম পিচ্ছিল চরিত্রকে বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করেন বিনির্মাণবাদ, যেখানে ভাষাকেন্দ্রিক বিশ্বচিত্র কিংবা চেতনা-কাঠামো দেশ ও কালকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মাত্রায় বিশ্লেষিত হয়ে সৃষ্টি করতে পারে অসীম অর্থ কিংবা দ্যোতনা। দরিদা কথিত ‘যতিভেদ’ বা Defferance ভাষার স্থানিক এবং কালকেন্দ্রিক অবস্থানকে গ্রাহ্য করে। এর ফলে দ্যোতকের অর্থ, অস্তিত্বকে উহ্য রেখে ও পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে, বিভিন্ন মাত্রায় বিশ্লেষিত হয়ে তৈরি করে নিত্যনতুন অর্থের কিংবা দ্যোতনার জগৎ। ভাষার এই কেন্দ্রবিচ্যুতি ঘটে অহং-উপস্থিতির কারণে এবং এর ফলে লিখিত ভাষার কোনো স্বনকেন্দ্রিক বা Logocentric অস্তিত্ব নেই। মানুষের ব্যক্তিগত মনের জানালা দিয়ে দেখা বিশ্বচিত্র তাই প্রতিদিন ভাষার সাথে নেচে নেচে গড়ে তুলেছে নতুন নতুন চেতনাজগত৷ একজন ‘আমি’ যখন নিজেই দ্যোতক/দ্যোতনাকেন্দ্রিক বিবর্তনের নাগরদোলায় দুলছে তখন কোনো এক ‘তুমি’-র ভাষাকেন্দ্রিক বিশ্বচিত্রকে সে কোনো একক চিন্তায় তুলে আনতে পারবে, ব্যাখ্যা করবে, এ রকম ভাবা যুক্তিসঙ্গত নয়।
যে মনের জানালার কথা বলা হয় তার মেটাফিজিক্যাল অবস্থান হলো প্রচলিত ভাষার গ্রাহ্য ‘মন’ নামক এক অদৃশ্য জগৎ কিংবা বিন্দুতে। যদি বাস্তব গাণিতিক সত্যকে গ্রাহ্য করি, মেটোফিজিক্স বাদ দিতে চাই, তবে এই জানালার ঠিকানা হবে মানব-মস্তিষ্কের অসংখ্য নিউরনে। এই নিউরন-জালেই আটকে থাকে একজন মানুষের আমি এবং সমগ্রসহ বিশ্বব্রহ্মান্ড এবং এখানেই বিবর্তন ঘটে ভাষাকেন্দ্রিক অহং ও সমগ্রের সার্বিক অস্তিত্বের।
দেশ-কাল-কেন্দ্রিক মনের জানালার প্রথম কপাট খুলে যায় জন্মের সাথে সাথে এক অসহায় বাক্যহীন অক্ষম অবস্থায়। ফ্রয়েডের চিন্তাবাহিত জাক লাকাঁর বক্তব্য অনুসারে একটি মানবশিশুর জন্ম-উত্তর এই সৌরজ সময়কে বলা হয় ‘আয়না পর্ব’। এই পর্বে একটি ‘আমি’ শুধুমাত্র ‘আমি’কেই দেখতে পায় প্রতিবিম্বের মতো, আর এই অহং-প্রতিবিম্বের নাম হলো ‘ইমাগো’। এই ইমাগো-ই প্রথম গ্রাহ্য করে আত্মপ্রেম এবং পরবর্তীতে অস্তিত্বের সাথে যুক্ত করে নেয় আক্রমণ ও মরণ প্রবৃত্তিকে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই মরণ প্রবৃত্তির সাথে যুক্ত থাকে সুখনীতি, যার উপাদান হলো সব ধরনের কাম এবং জরায়ুতে ফিরে যাওয়ার অসম্ভব কিন্তু বাস্তব স্বপ্ন। জন্মের পর বেড়ে ওঠার সাথে সাথে একটি মানুষ তার জানালার প্রসার বাড়াতে থাকে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতীকী-শৃঙ্খলা বজায় রেখে, একটি নির্দিষ্ট ভাষাকাঠামোর সচল সূত্রসমূহকে আত্মস্থ করে। ভাষাকেন্দ্রিক প্রতীকি-শৃঙ্খলার জগতে একটি মানুষ নিজকে কখনোই মুক্ত ভাবে না, কারণ বিভিন্ন নিয়ম, ট্যাবো ইত্যাদি অহংকে যুক্ত করে রাখে সমগ্রের সাথে। এখানেই সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্বের, আশা/নিরাশার যুগ্ম বৈপরীত্যের। মার্টিন হাইডেগার এ অবস্থাকেই হয়তো-বা বর্ণনা করেছেন পতিত সত্তার উপস্থিতি হিসেবে, যেখানে মনুষের মৌলসত্তা ভীষণভাবে পরাজিত। ভাষাকেন্দ্রিক প্রতীকী-শৃঙ্খলা জগতের অধিবাসী একজন মানুষ রাশি রাশি প্রতীক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েও তার প্যারাডাইম বা চেতনা-কাঠামোকে প্রতিদিন নতুন করে সাজিয়ে নিচ্ছে। ধর্ম, রূপকথা, মহাকাব্য, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদির মতো প্রতীক বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলেছে মনের জানালায়, তবু মানুষ সত্যকে খুঁজছে অহং-মুক্তির সাধনায়। যে মানুষ প্রতীকী-শৃঙ্খলার এই বিশ্বকে গ্রহণ করতে পারেনি সে আজ হয়তো বা রোগী কিংবা আত্মহত্যায় ফিরে গেছে শান্তির কবরে।