বিশ্বে জাপানি নারীর অবস্থান / প্রবীর বিকাশ সরকার
বিশ্বে জি-সেভেন গ্রুপ দেশ গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে জাপান। বাকী ছ’টি দেশ হচ্ছে আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি এবং কানাডা। এই সাতটি রাষ্ট্রকে গ্রেট-সেভেন বলেও অভিহিত করা হয়। এশিয়া থেকে একটি মাত্র রাষ্ট্র জাপান এই দলের প্রতিনিধিত্ব করছে। আধুনিক জগতে স্বীকৃত নানাবিধ অগ্রসর নিয়ম, নীতি, প্রকল্প, নাগরিক উন্নয়ন, জীবন যাপন, প্রযুক্তি, সেবা-পরিষেবা, শিক্ষার মান, জাতিসংঘ তহবিলে অর্থনৈতিক অবদান ইত্যাদিরও পরবিচার বিবেচনার মানদন্দে এই সাতটি দেশ অগ্রসর মান বলাই বাহুল্য।
কিন্তু একটি ক্ষেত্রে সেইসব দেশে নারীদের অগ্রগতি এবং ক্ষমতায়ন খুব একটা অগ্রসর মান নয়, নয় উৎসাহ ব্যঞ্জক। জাপানেও নারী-অধিকার, ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাকি ছ’টি দেশের তুলনায় নিম্নতর হলেও, হতাশা কাটিয়ে ওঠার প্রয়াস লক্ষণীয়। জাপানি নারীরা সুদীর্ঘকাল কিছু আদর্শ গত ঐতিহ্য ও পুরুষ তান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। তবে বিশ্বব্যাপী নারীদের ব্যাপক জাগরণ ঘটেছে, সামাজিক খাত গুলোতে অগ্রগতি সাধনের ধারা অব্যাহত এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে যা অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন তেমনটি জোরালো নয় বিধায় বহু দেশ নানা ধরনের প্রকল্প ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নারী ও পুরুষের বৈষম্য গুলোকে দূর করে সমতা আনার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে একটি সম্মেলনে একটি নতুন প্রস্তাববা পদক্ষেপ গৃহীত হয়। সেটা হল : SDGs(Sustainable Development Goals)যাতে ৫টি নীতি বা পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে।
এই নিয়ে সারা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে নতুন নতুন উদ্যোগের কথা আমরা এখন জানতে পারছি। জাপান ও তার ব্যতিক্রম নয়।
জাপানে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতি তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও যতখানি হয়েছে তার নজির বিশ্ব দরবারে বিরল বলা যায়। এর জন্য মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২খ্রি:) নারী শিক্ষার ব্যাপক উদ্যোগ অনস্বীকার্য। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হচ্ছেন শিক্ষাবিদ এবং এই দেশে প্রথম মহিলা মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড.নারুসে জিনজোও।
নানা অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক নারী মুক্তি আন্দোলন চলমান বহু বছর ধরে। এই ক্ষেত্রে জাপানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই শিক্ষিত নারী সমাজ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক ভূমিকা রেখে এসেছেন। এই আন্দোলনে জাপানি নারী শিক্ষিকা, রাজনীতিবিদ, সাংসদ এবং লেখিকা ড. কোওরা তোমি এশিয়া এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছিলেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে ছ’বার সাক্ষাৎ করে কবির সার্বজনীন শান্তিবাদ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর পরে আর কোনো জাপানি নারী নেত্রীর খবর আমরা পাচ্ছিনা।
প্রাচীনকাল থেকেই নারীর অবস্থান জাপানে কখনোই সুখকর ছিলনা। বৈষম্য ছিলই। যদিও বা প্রাচীনকালে দুজননারী সম্রাজ্ঞীর নাম জানা যায়, একজন জিনগুউ তেননোও (২০১-২৬৯খ্রি:) অন্য জন হিমিকো তেননোও (২৪২-২৪৮খ্রি:অনু:)। হেইয়ান যুগে (৭৯৪-১১৮৫ খ্রি:)অভিজাত বংশীয় নারী মুরাসাকি শিকিবু বিশ্বের প্রথম উপন্যাস“ গেনজি মোনোগাতারি” তথা“ গেনজি গাথা ” লিখে আজও বিশ্বসাহিত্যে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। আধুনিক মেইজি যুগে সামুরাই বংশে জন্ম এক তরুণী হিগুচিই চিয়োও সাহিত্য চর্চায় অসামান্য সুনাম অর্জন করেছিলেন। মাত্র ২৪ বছর বয়সে অকাল প্রয়াত এই নারী সাহিত্যিক ২০ টির অধিক উপন্যাস রচনা করেছেন। যার বেশ কয়েকটি নিয়ে পরবর্তীকালে মঞ্চ ও টিভি নাটক এবং চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। আমেরিকায় ব্যাপক গবেষণা চলছে তাঁর জীবন ও সাহিত্য কর্ম নিয়ে। এইখানে উল্লেখ্য যে, প্রথম নারী সম্রাজ্ঞী জিনগুউ, প্রথম উপন্যাস রচয়িত্রী মুরাসাকি এবং প্রথম আধুনিক নারী সাহিত্যিক হিগু চিরশক্তি মত্তা এবং মেধার মূল্যায়ন স্বরূপ রাষ্ট্রীয় কাগুজে মুদ্রায় তাঁদের প্রতিকৃতি ও আলোক চিত্র ব্যবহৃত হয়েছে যা বিশ্বে এক বিরলতম ঘটনা। অবশ্য বিগত শত বছরে জাপানে অনেক নারী কবি, সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক ব্যাপক কর্মকান্ডের মাধ্যমে বিপুল সাহিত্য কর্ম দিয়ে জাপানের সাহিত্য জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন। এছাড়া শক্তিশালী সামুরাই নারী যোদ্ধার খবরও ইতিহাসে পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর মেইজি-পরবর্তী আবারও ব্যাপক এক পরিবর্তন ঘটে জাপানে সর্বক্ষেত্রে। রাজনীতি, ব্যবসা, ফ্যাশন, সংস্কৃতি ক্ষেত্রে স্বদেশে ও বিদেশে প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছেন তাঁদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক দলের তাকেদা দোই, তিনি জাপানের সংসদে স্পীকার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওগাতাসাদাকো, খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, কূটনীতিক, প্রশাসক এবং লেখিকা ১৯৯১-২০০০ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের United Nations High Commissioner for Refugees (UNHCR) এর প্রধান এবং Japan International
Cooperation Agency (JICA) প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন ২০০৩-২০১২ পর্যন্ত। এছাড়া একাধিকবার একাধিক নারী রাজনীতিবিদ ও আমলা সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন। যদিও বা সংখ্যায় অত্যন্ত নগণ্য। আজকের আন্তর্জাতিক ফ্যাশন জগতে দুই জাপানি নারী ডিজাইনার হানায়ে মোরি এবং কাৎসুরাই উমি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছেন। জাপানি কণ্ঠ শিল্পী সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী মিসোরা হিবারি যেভাবে তাঁর গান ও উপস্থাপনা দিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাপানি জাতিকে স্বনির্ভর হতে উদ্বুদ্ধ, উদ্বেলিত এবং আন্দোলিত করেছেন তার তুলনা বিশ্বে নেই বললেই চলে।
জাপানে নর-নারী শতভাগ শিক্ষিত। সাম্প্রতিককালে এমন কোনো খাত নেই যেখানে মেয়েরা বা নারীরা অংশগ্রহণ করছেনা। জাপানি নারীরা অত্যন্ত পরিশ্রমী। নার্সারির শিক্ষক থেকে মহাকাশ সংস্থা, ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ভারী শিল্প কারখানা, কম্পিউটার প্রযুক্তি থেকে কার্টুন-অ্যানিমেশন সৃজনকর্ম পর্যন্ত নারীরা পুরুষের পাশাপাশি প্রাণান্ত লড়াই করে চলেছে। বস্তুত, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের নারী জাগরণে ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় জাপানি নারীরা উদাহরণ হতে পারেন। এরজন্য প্রয়োজন জাপানি নারীদের ইতিহাস পাঠকরা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও গবেষক