বাসী কথা এবং.. । মোহাম্মদ আব্দুল বাছেত

0

দিবস নিয়ে আমাদের ভীষন দূর্বলতা। কিন্তু সেই দিবসের তাৎপর্য , উপলব্ধি প্রাত্যহিক জীবনে প্রলম্বিত নয় বরং সূর্যাস্তেই তার পরিসমাপ্তি। অতঃপর নতুন দিবস নতুন আয়োজন একই অতিথি – বক্তা, আর শ্রোতা- দর্শক আগেরই। প্রায়শ মঞ্চও একই থাকে।এক্ষেত্রে দেশের প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবীরাও সেই দিবস নিয়ে বক্তব্য দেন লেখালেখি করেন ঐ একদিনই। অতঃপর নতুন দিবস। একুশের একুশ উৎসব অনুষ্ঠিত হলো। কত আয়োজন। প্রভাত ফেরি , পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনেকে অনেক আগেই কলাম লিখে রেখেছেন পত্রিকায় চাপাবেন বলে, বক্তব্য রপ্ত করেছেন আওড়াবেন বলে, রাজনীতিবিদগণ ভাষা শহীদদের শোকে ও শ্রদ্ধায় কাতর হয়েছেন, ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্বাচনেচ্ছুরা পোস্টার- ব্যানার বানিয়ে গাছে, ডালে, চালে ঝুলিয়ে দিয়েছে। অবশ্য সে সবেও প্রচুর বানান বিভ্রাট!

আমাদের জাতি সত্ত্বার উন্মেষ, বিকাশ ও বৈশ্বিক বিস্তৃতির শেকড়ে আমার বাংলা ভাষা। আমার বর্ণমালা। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকে কোল দ্রাবিড়ের অপভ্রংশ হয়ে সংস্কৃত, প্রাকৃত, মাগধি প্রাকৃত, অনার্য, শত চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ একটা পরিপুষ্টতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষা। এ ভাষার রয়েছে আড়ম্বড়পূর্ণ ইতিহাস। পৃথিবীতে একটি মাত্র ভাষা শ্রেণির মানুষ বাঙালি যারা তার মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা , প্রাণের ভাষার অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষার্থে রাষ্ট্রযন্ত্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বুকে গুলি পেতে মুখের বুলিকে সুসংহত করার প্রয়াসে আত্মাহুতি দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার অনন্য এবং অদ্বিতীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

মাতৃভাষা নিযে ১৯৬১ সনে আসামের শিলচর, ১৯৭২ সনে করিমগঞ্জসহ বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে, মানুষ মরেছে। শুধু আমরাই – বাঙালিরা ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছি। প্রাণ দিয়েছি। ভাষার প্রতি ভালবাসায় আমরা অদ্বিতীয়।
সেই ১৯৫২র মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে যদি আমরা জয়ী হতে না পারতাম তাহলে আমাদের স্বাধীকার, স্বায়ত্বশাসন, লাল সবুজ পতাকা, আমাদের সার্বভৌমত্ব সকলই অধরাই থেকে যেত। সুতরাং ১৯৭১এর জননী ১৯৫২। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি প্রীতি আমাদের সামান্যই। এখনো ষোল আনা বাঙালিয়ানা হতে পারিনি। শিক্ষা সংস্কৃতিতে নিত্য বিদেশি প্রভাব। দীর্ঘ তেইশ বছরের শিক্ষকতার নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা, পঁচাত্তর শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা বর্ণমালার সঠিক উচ্চারণ করতে পারে না এমনকি অনেক শিক্ষকও। অথচ আমার মাত্র অর্ধশত রক্তস্নাত প্রিয় দুঃখিনী বর্ণমালা!
বিদেশি ভাষা শিক্ষার জন্য কত কসরৎ। ইংলিশ গ্রামার শেখার জন্য ,ভাষা শেখার জন্য, ইংরেজিতে কথা বলতে পারার জন্য কোচিং, প্রাইভেট শিক্ষক অথচ বাংলা ব্যাকরণ জানার , শুদ্ধ বানানে লেখার ন্যূনতম আগ্রহ নেই।

আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমার বাংলা বিভাগীয় প্রধান ও তৎপরবর্তী উপাচার্য ডঃ আব্দুল খালেক স্যারের এক সেমিনারে শ্রোতা আমি। স্যার বললেন ” যদি কোন শিক্ষার্থী বাংলায় শুদ্ধ ভাবে চাকরির আবেদন করতে পারে তাহলে আমি নিশ্চিত তার চাকরি হবেই।” তাঁর কথা কতখানি সত্য এখন উপলব্ধি করা যায়। বিজ্ঞানের ছাত্র, ইতিহাসের ছাত্র বাংলা বানান ভুল তো হবেই। আহ্ কী আবদার! তুমি বাঙালি নও? এদেশে তোমার জন্য নয় ? ইংলিশ বানান মুখস্থ করো আর রক্তে কেনা ভাষা অশুদ্ধ লেখো, বলো। ধীক! কবি আবদুল কাদিরের দ্রোহের বানী ” যে জন বঙ্গে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী, সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।” ভালো ভাষাকে ভালবাসা। আমার বাংলা ভাষাও ভালো ভাষা, তাই একে সমৃদ্ধ করা আমাদের দায় এবং দায়িত্ব। বাংলা ভাষারও কৌলিন্য আছে। রস আছে। সে রসের আস্বাদ উপভোগ করতে হবে। কি নেই বাংলার ভাষা ও সাহিত্যে?

এ ভাষার প্রাচীন সাহিত্যিক নিদর্শন “চর্যাপদ”। বড়– চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, মঙ্গল কাব্য গ্রন্থ, দৌলত উজির বাহরাম খানের লাইলি মজনু, আলাওলের পদ্মাবতী, কাশীরাম দাসের মহাভারত। এগুলো বাংলা ভাষার ঐশ্বর্যের আদি রসাত্মক সাহিত্য। পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে চার হাজার রাষ্ট্রীয় ও আঞ্চলিক ভাষা ছিল। সে সব ভাষা প্রভাবশালী ভাষার চাপে অথবা আর্ন্তজাতিক মানের সাহিত্য চর্চা না করতে পারার কারণে অনেকই বিলুপ্ত প্রায়। আর বাংলা ভাষায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিশ্বমানের সনেট। আমাদের রয়েছে বিশ্বমানের মহাকাব্য। মাইকেলের মেঘনাদবধ, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যার বৃত্তসংহার, যোগীন্দ্রনাথের পৃথ্বীরাজ, শিবানী, মানকুমারীর বীর কুমার বধ, কায়কোবাদের মহাশ্মশান। মধুসূদনের প্রহসন নাটক একেই কি বলে সভ্যতা, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ। বাংলা উপন্যাসের অমিত সম্ভারকে নিয়ে গর্ব করা যায়। প্রথম উপন্যাস প্যারিচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল থেকে শুরু করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিষবৃক্ষ, আনন্দ মঠ, কৃষ্ণকান্তের উইল, শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ, বিরাজ বৌ, দেনাপাওনা, শ্রীকান্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখের বালি, ঘরে বাইরে, এবং মহাকাব্যিক উপন্যাস গোরাসহ কাব্যধর্মী শেষের কবিতা অনন্য, অসাধারণ ও সাহিত্যগুণে স্বার্থক। অনেকেরই অজানা যে বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী, তারা শংকরের কবি, বনফুলের রাত্রি, মহৎ সৃষ্টির পর্যায়ে আসীন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি আকাশচুম্বি স্বার্থক উপন্যাস। বাংলা ভাষার ছোট গল্প আমাদের অহংকার। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ছোট গল্পের পথপ্রদর্শক ও শ্রেষ্ঠ ¯্রষ্টা। প্রমথ চৌধুরীর চার ইয়ারী কথা, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার গল্প, শরবিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশের ডায়েরী, কবি গুরুর নষ্টনীড়, চতুরঙ্গ, পোস্ট মাস্টার। যাক, এ বিষয়ে বিস্তারিত না বলে আমাদের ভাষার ঐতিহ্য ও আভিজাত্য সম্পর্কে এটুকু বললেই হৃদয়ঙ্গম হয় যে, বর্তমানে বিদেশি ভাষাভাষীরাও রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের উপর পিএইচডি ডিগ্রি করছেন।

১৯১৩ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “গীতাঞ্জলি” কাব্যগ্রন্থ রচনা করে নোবেলজয়ী হন। এবং এই কাব্যগ্রন্থটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আমাদের সহজিয়া গান, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, জারি-সারি, লালন, হাছন , পালা গান, রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান যে কী অমিত সম্ভার তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারিনি বলেই এবং নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে গিয়েছি বলেই আজ একদিনের বাঙালি আমরা। যেন সেই গানের কথা ” একদিন বাঙালি ছিলাম রে ।” একদিন সকালে পান্তা ইলিশ খেয়ে বাঙালি। একদিনই স্বাধীনতা দিবস। একদিনই বিজয় দিবস। একদিনই ভালোবাসা দিবস। মা দিবস, নারী দিবস, শ্রম দিবস, কন্যা দিবস । ভাষা শহীদ দিবসও একদিন কিন্তু সেই দিবসের তাৎপর্য, মাহাত্ম্য, আদর্শ এবং আবেদন প্রাত্যহিক। নিত্য তার চর্চা, সর্বস্তরে প্রয়োগের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের রক্তের ঋণ শোধের প্রয়াস হোক আমাদের ঐকান্তিক প্রত্যয়।

বিচার প্রার্থী বা আসামি কেউ বোঝে না কি রায় হলো। উকিল, মুন্সী বুঝিয়ে দেন। অথচ রায়টি বাংলায় লিখলে ও পড়লে আইন প্রয়োগে কতটা ব্যত্যয় হতো জানিনা তবে এটা রক্তস্নাত দুঃখিনী বর্ণমালার প্রতি অবজ্ঞা, শহীদদের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অপমান এবং জাতি সত্ত্বার প্রতি ঊন্নাসিকতা। অথচ আমার ভাষায় বিশ্বে ত্রিশ কোটি মানুষ কথা বলে। নিত্য ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার অবস্থান চতুর্থতম। কত গর্ব আমাদের, ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতি সংঘের ইউনেস্কো প্যারিস অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে “আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২০২০ সাল থেকে জাতি সংঘের সদস্য দেশগুলো ” জাতি সংঘের দাপ্তরিক ভাষা” হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ দিনে সদর দপ্তরে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।

আমার বাংলা ভাষাকে ভালবাসা, আমার বাংলাদেশেকে ভালবাসা, আমাদের অস্তিত্বে আস্থারাখা এবং ন্যূনপক্ষে বারো আনা বাঙালিয়ানা- হওয়া এখন সময়ের দাবি । (চলবে)

লেখক : অধ্যক্ষ- মোহাম্মদ আব্দুল বাছেত (বাচ্চু)
সাতবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজ, সুজানগর, পাবনা।
ই-মেইল: [email protected]
ফেসবুক পেইজ: https://www.facebook.com/groups/215504006789824

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.