দেশেই পাওয়া যাবে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : রাজধানীর শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রায় ১২ বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে ফাইভ স্টার মানের মাল্টি ডিসিপ্লিনারি এ্যান্ড সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে শতভাগ অবকাঠামোগত কাজ। তবে এখনও বসেনি ৫০ শতাংশ যন্ত্রপাতি। আগামী ২৮ আগস্ট এর উদ্বোধনের কথা বলা হলেও জানা গেছে আগামী মাসের ১ম বা ২য় সপ্তাহে উদ্বোধন হচ্ছে এটি।
বৈশ্বিক মহামারী করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে দেশের স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা। বিশ্বের বড় বড় দেশ যেখানে ভাইরাসটির সংক্রমণে কুপোকাত তখনও দোর্দা- প্রতাপে কাজ চালিয়ে গেছে দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি চিকিৎসক, কর্মী। শুধু মহামারী মোকাবেলায় নয় দেশের হাসপাতালগুলোতেও সেবার মান বেড়েছে অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। তবে এবার সব রেকর্ড ভাঙতে যাচ্ছে। একই ছাদের নিচে, একই জায়গায়, একই হাসপাতালে সব ধরনের রোগের আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা পাওয়ার ব্যবস্থা করা হলেও এর এক একটি ওয়ার্ড বা কেবিনের যে ভাড়া তা সাধারণ মানুষ বহন করতে পারবে কি না তা নিয়ে দ্বিধান্বিত খোদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও।
জানা গেছে, ৭৫০ শয্যার এই সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভিভিআইপি কেবিন থাকবে ছয়টি। ভিআইপি ২২টি এবং ডিলাক্স কেবিন থাকবে ৩০টি। প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে মাত্র আটটি করে সাধারণ শয্যা থাকবে। এছাড়াও এখানে থাকছে ১২টি অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার, যেখানে বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপনসহ উন্নত মানের সার্জারি সম্পন্ন হবে।
হাসপাতাল নির্মাণ ও উন্নত প্রশিক্ষণ-এই দুই ভিত্তিতে হাসপাতাল প্রকল্পটিকে সাজানো হয়েছে। বহু সুবিধাসম্পন্ন এসব কেবিনের দিনপ্রতি ভাড়া ধরা হয়েছে অন্তত ৬ হাজার টাকা। আরও ওয়ার্ডের কোনটিতেই ২ হাজার টাকার নিচে সিট পাওয়া যাবে না। এতে করে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর পক্ষেই পাওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ৭৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটির অর্থায়ন করছে কোরিয়া। বিশাল এ প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছিল ১৩শ কোটি টাকা। যার মধ্যে কোরিয়া সরকার দিয়েছে ১ হাজার কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ সরকারের খরচ হয়েছে ৩শ’ কোটি টাকা। সেন্টার বেইজড এই হাসপাতালটির সব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোম্পানি স্যামসাং। সেন্টার বেইজ হাসপাতালটিকে পাঁচটি সেন্টারে বিভক্ত করা হয়েছে। এই পাঁচটি সেন্টার হলো কার্ডিওভাস্কুলার সেন্টার, মাদার এ্যান্ড চাইল্ড সেন্টার, কিডনি, হেপাটোবিলিয়ারি ও গেস্ট্রোএন্ট্রোলজি এবং এক্সিডেন্টাল ইমার্জেন্সি।
এর মধ্যে কার্ডিওভাস্কুলার সেন্টারে হৃদরোগ সম্পর্কিত সব ধরনের সেবা পাবেন রোগীরা। এনজিওগ্রাম থেকে শুরু করে সামান্য হৃদরোগে আক্রান্তরাও এখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা পাবেন। একইভাবে মাদার এ্যান্ড চাইল্ড সেন্টারে মা ও শিশু সম্পর্কিত সব ধরনের রোগ এবং সেবা পাওয়া যাবে। হেপাটাইটিস, গ্যাস্ট্রোলজি সম্পর্কি সব রোগেরই চিকিৎসা পাওয়া যাবে হেপাটোবিলিয়ারি এবং গেস্ট্রোএন্ট্রোলজি সেন্টারে। আর এক্সিডেন্টাল ইমার্জেন্সি থাকবে সবার জন্য। যে কোন দুর্ঘটনাজনিত রোগীদের সেবা দেয়া হবে এখানে। এখানে থাকবে ১০০টি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ। এই ১০০টি আইসিইউকেও বিভক্ত করা হবে পাঁচটি ভাগে। এর মধ্যে প্রথম ভাগটিকে বলা হচ্ছে পেডিয়াট্রিক আইসিইউ, দ্বিতীয়টি নিউনেট্রাল আইসিইউ, তৃতীয়টি মেডিক্যাল আইসিইউ, চতুর্থটি সার্জিক্যাল এবং পঞ্চমটিকে বলা হচ্ছে কার্ডিয়াক আইসিইউ। এই কার্ডিয়াক আইসিইউটিতে সার্জারি ছাড়াও যে কোন রোগী শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে সেবা পাবেন।
প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মোঃ জুলফিকার রহমান খান জনকণ্ঠকে বলেন, হাসপাতালের ভিতরেই থাকছে ব্যাংকিং সুবিধা, ফার্মেসি এবং চারটি ক্যাফেটেরিয়া। থাকছে ১৬টি এলিভেটর ও একটি এস্কেলেটর, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থাপনা, হিটিং, ভেন্টিলেশন ও এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেম। সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুম থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ। তিনি বলেন, প্রকল্পের মেয়াদকাল চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এরই মধ্যে এর শতভাগ কাজ শেষ হবে। এখনও প্রায় ৫০ শতাংশ যন্ত্রপাতি স্থাপন করা সম্ভব হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, যন্ত্রপাতির মধ্যে সিটিস্ক্যান, এমআরআইসহ ৫০ শতাংশ যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে।
বাকি ৫০ শতাংশ যন্ত্রপাতি আনার জন্য আরও অন্তত দুই মাস সময় প্রয়োজন। সব যন্ত্রপাতি না এনেই কিভাবে উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আসলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই ভাল বলতে পারবে। আমরা যতটুকু জানি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি পাওয়ার পরই উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। এক্ষেত্রে সব যন্ত্রপাতি স্থাপন করার পর উদ্বোধন করলেই মানুষজনকে সেবা দিতে সুবিধা হবে।
সুপার এই হাসপাতালে শতভাগ যন্ত্রপাতি স্থাপন হয়নি বিষয়টি স্বীকার করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদও। যেসব যন্ত্রপাতি এসেছে তা দিয়েই চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করা হবে জানিয়ে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, এই প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত বছরের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু করোনার কারণে শেষ হয়নি। তাই এখনি যদি চিকিৎসাসেবা শুরু না হয় তাহলে দেরি হয়ে যাবে। উদ্বোধনের পর আস্তে-ধীরে যন্ত্রপাতি স্থাপন হবে। অন্যদিকে চিকিৎসা কার্যক্রমও চলবে।
এখানে ঠিক কোন শ্রেণীর রোগীরা চিকিৎসা পাবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটি যেহেতু সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল এখানে কিডনি, লিভার ট্রান্সপ্লান্ট থেকে শুরু করে সব ধরনের রোগীর সেবা দেয়া হবে। কেউ যদি মনে করে একটু টাকা খরচ করে হলেও ভাল একটা কক্ষে থেকে চিকিৎসা নেবে বেসরকারী হাসপাতালগুলোর তুলনায় কম টাকা খরচ করে সেক্ষেত্রে সেই সুবিধা পাবে। যারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেন তারাও এখানে অনেক কম মূল্যে চিকিৎসা পাবেন।
এই কমমূল্য একজন রিক্সাচালক বা এক দিনমজুরের পক্ষে বহন করা সম্ভব কি না এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ অবশ্যই এখানে চিকিৎসা পাবেন। তবে কেউ যদি ব্যয়ভার বহন করতে না পারেন সেক্ষেত্রে বর্তমান হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) ট্রান্সফার করা হবে। সমস্যা তো নেই।
এর আগে গত ২৮ জুলাই এক অনুষ্ঠানে ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, আগামী ২৮ আগস্ট সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটির উদ্বোধন হবে। এই তারিখ পরিবর্তন হয়েছে জানিয়ে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাবেন। এছাড়াও আগস্ট মাসের কিছু ব্যস্ততা তার আছে। তাই ২৮ আগস্ট এই হাসপাতালটির উদ্বোধন হচ্ছে না। ঠিক কবে নাগাদ এর উদ্বোধন হবে এই তথ্য ঠিক দিতে না পারলেও তিনি বলেন, আমরা আশা করছি সেপ্টেম্বরের ১ম বা ২য় সপ্তাহেই এর উদ্বোধন হবে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি সাপেক্ষে।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর পর এই হাসপাতালটি হবে বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট অর্জন। সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উত্তর পাশে ৩ দশমিক ৮ একর (প্রায় ১২ বিঘা) জমির ওপর এই সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের কর্মযজ্ঞ চলছে। এর স্ট্রাকচারাল কাঠামো প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কোরিয়ান কোম্পানি হুন্দাই কর্পোরেশনের পরিচালনায় এখানে কাজ করছেন কোরিয়ান শ্রমিকদের পাশাপাশি বাংলাদেশী শ্রমিকরাও।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক চেষ্টায় দেশের স্বাস্থ্য খাতে একটা বিরাট ধরনের পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন প্রকল্পটির পরিচালক বিএসএমএমইউর চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ মোঃ জুলফিকার রহমান খান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করে গড়ে তোলা হচ্ছে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা। হাসপাতাল ইনফরমেশন সেন্টারের (এইচআইএস) মাধ্যমে রোগীর সব তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। এই হাসপাতালে পাঁচটি ভিন্ন সেন্টারের মাধ্যমে দেয়া হবে সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা।
হাসপাতালে সেবা ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ইতোমধ্যে ৪৩ জনকে কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আরও ১৪০ জনকে চলতি বছরেই প্রশিক্ষণ দেয়া হবে তিনি বলেন, অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস, সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের আদলে এই হাসপাতাল গড়ে তোলা হবে। হাসপাতালে সেবার মান ঠিক রাখতে জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনাল (জেসিআই) এ্যাক্রিডেশন নিশ্চিত করতে হবে। এর সঙ্গে ন্যাশনাল এ্যাক্রিডেশন বোর্ড ফর হসপিটাল এ্যান্ড হেলথ কেয়ারের (এনএবিএইচ) অনুমোদন চালু করতে হবে। হাসপাতালের কাঠামোর কাজ পুরোপুরি শেষ। ইতোমধ্যে ৭০ শতাংশ যন্ত্রপাতি চলে এসেছে। উদ্বোধনের পরপরই এখানে রোগী ভর্তি শুরু করা যাবে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ এই সার্জন বলেন, হলে বিএসএমএমইউর শিক্ষা, চিকিৎসা এবং গবেষণা কার্যক্রম আরও গতিশীল ও উন্নত হবে।
তবে অন্যান্য হাসপাতালের চাইতে এখানে হয়তো খরচ কিছুটা বেশি হবে। অন্যান্য বড় বড় বেসরকারী হাসপাতালে যে মানের সেবা দেয়া হয় এখানে সেই মানেরই সেবা দেয়া হবে। তবে তা সীমিত খরচের মধ্যেই থাকবে। সাধারণ শয্যাগুলোর মূল্য হয়তো দেড় থেকে ২ হাজার টাকা পড়বে। কিছু শয্যা হয়তো বিনামূল্যেও থাকতে পারে।
পুরো প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন করে আত্মতৃপ্তি পাওয়া ডাঃ জুলফিকার রহমান খান বলেন, এখন সরকারের কাছে আমার দাবি থাকবে এখানে যেন দক্ষ জনবল নিয়োগ করা হয়। প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর্মীদের দেশের বাইরে থেকে আরও বেশি পরিমাণে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসা হোক। তাহলেই আমাদের উদ্দেশ্য সার্থক হবে।
জানা যায়, বিশাল এই প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১২ সালে। ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ১ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের অনুমোদন মিলে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটিতে। ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ হাসপাতাল নির্মাণে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার থেকে ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা ঋণ সহযোগিতা পাওয়া গেছে। হাসপাতালটির নক্সা করেছে সানজিন ইঞ্জিনিয়ারিং কোরিয়া।