যশোর এগারো শিব মন্দির: যে মন্দিরের সাথে মিশে আছে এক দুঃখী রাজকুমারীর গল্প
যশোর প্রতিনিধি : পৌষের হালকা কুয়াশা গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃতি। শীতের রেশ তখনো মিলিয়ে যায়নি। এমন সময়ে আমরা খুলনা থেকে যশোরগামী গাড়িতে চেপে বসলাম। নামবো মাঝপথেই; বন্দর নগরী নওয়াপাড়াতে। লক্ষ্য অবশ্য আরো দূরে; যশোর জেলার এক নিভৃত গ্রাম- অভয়নগরে। আমরা যাচ্ছি এক জনমদুঃখী রাজকন্যার স্মৃতির খোঁজে।
যশোর জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ থানা অভয়নগর। বাংলাদেশের আর পাঁচটি গ্রামের মতোই সাধারণ একটি গ্রাম অভয়নগর। ভৈরব নদের পাড়ে অবস্থিত গ্রামটি। এই সাদামাটা অভয়নগর সেই ইংরেজ আমলে কীভাবে বাংলাদেশের একেবারে প্রথম দিককার একটি থানা হয়ে উঠেছিল তা জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আরো কয়েকশো বছর পূর্বে।
মুঘলদের সাথে যুদ্ধে প্রতাপশালী যশোর রাজ্যের রাজা প্রতাপাদিত্য পরাজিত ও বন্দী হন। ফলে রাজপরিবারের সদস্যরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন ভাগ্যান্বেষণে। তাদের একজন ঠাই নিয়েছিলেন যশোরের চাচড়া অঞ্চলে। এদের উত্তরপুরুষ রাজা নীলকণ্ঠ রায়। পরিশ্রম করে নিজের ভাগ্য ফিরিয়েছিলেন। ধন-দৌলত আর শক্তি-সামর্থে সবার সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি।
এই নীলকণ্ঠ রায়ের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলো এক কন্যাসন্তান। পিতা কন্যার নাম রাখলেন অভয়া। তখন বাংলায় চলছে এক ক্রান্তিকাল। এ অঞ্চলে জালের মতো বিস্তৃত শত শত নদ-নদী আর খাল-বিল। আরো দক্ষিণে এগিয়ে গেলে দুর্ভেদ্য সুন্দরবন। এই সুযোগ নিয়ে দুর্ধর্ষ হার্মাদ জলদস্যুরা এই এলাকার মানুষের উপর চালাতো পাশবিক নির্যাতন। ধনসম্পদ লুটের পাশাপাশি নারী ও শিশুদের ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিতো। তাদের দমন করার জন্য রাজা নীলকণ্ঠ রায় উদ্যোগ নিলেন। ভৈরব নদের তীরে হিন্দুদের একটি অতি প্রাচীন তীর্থস্থান ভাটপাড়া। ভাটপাড়ার পাশেই নদীর তীরে তিনি দুর্গ নির্মাণ করেন। তারপর রাজধানী চাচড়া থেকে এখানে সপরিবারে স্থানান্তরিত হলেন।
এখানেই বেড়ে উঠতে লাগলেন রাজকন্যা অভয়া। প্রাপ্তবয়স্কা হলে অভয়ার বিয়ে ঠিক করা হয় সে সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী জমিদার ‘নড়াইল জমিদার’ বংশের একজন নীলাম্বর রায়ের সাথে।অদৃষ্টের পরিহাসে বিয়ের অল্প কিছুদিন পরে নীলাম্বর রায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। কিছুদিন রোগভোগের পরে মারা যান নীলাম্বর রায়। বিধবা হন রাজকন্যা অভয়া। তিনি ছিলেন শৈব অর্থাৎ মহাদেব শিবের উপাসক। পিতার কাছে অনুরোধ করলেন, তিনি তার বাকি জীবন মহাদেবের আরাধনা করেই কাটিয়ে দিতে চান।
নীলকন্ঠ রায় মেয়ের ইচ্ছা শুনে রাজবাড়ির সন্নিকটে মেয়ের জন্য মন্দির নির্মাণ করে দেন। একটি-দুটি নয়, ৬০ একর জায়গার উপর ১১টি শিব মন্দির নির্মাণ করেন তিনি। আর মেয়ের নাম অনুসারে নগরের নাম রাখেন অভয়ানগর, যা কালক্রমে পরিচয় পেয়েছে অভয়নগর নামে। ভৈরব নদের তীরে এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেই স্থাপনা। এটি শুধুমাত্র একটি সুন্দর মন্দিরই নয়, একই স্থানে এতগুলো শিব মন্দির বাংলাদেশে আর কোথাও নেই।
আমরা ছুটে চলেছি সেই অভয়নগরে। ঘুরে দেখবো নীলকণ্ঠ রায় নির্মিত মন্দিরে। অনুভব করতে চেষ্টা করবো প্রায় হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে। নওয়াপাড়ার নুরবাগে বাস থেকে নেমে পড়লাম। তারপর খেয়া নৌকায় ভৈরব নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠলাম। এখান থেকে ইঞ্জিনচালিত ভ্যানগাড়ি, চাঁদের গাড়ি সদৃশ টেকার নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত গাড়ি, কিংবা ভাড়ায় মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। আমরা দুজন আছি একসাথে। একখানা মোটরসাইকেল ঠিক করে তাতে চড়ে বসলাম। আমাদের নিয়ে শা শা করে মোটরসাইকেল ছুটে চললো রাস্তা ধরে।
মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছাতে হলে সিংগাড়ি বাজার যেতে হবে। সেখান থেকে ভাটপাড়া বাজারে পৌছে ভৈরব নদকে অনুসরণ করতে হবে। ভৈরবের তীর দিয়ে ইটের সলিং বসানো রাস্তা নিয়ে যাবে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। কিন্তু ভাগ্য আমাদের জন্য এতটা সুপ্রসন্ন ছিল না। ভাটপাড়া বাজারে গিয়ে দেখা গেল হুলস্থূল কাণ্ড। রাস্তা পাকা করার জন্য ইট খুড়ে ফেলা হয়েছে। এ রাস্তায় মটরসাইকেল চলা অসম্ভব। আমাদের মুখ কালো হয়ে গেল। এতদূর এসেও কি এখন ফিরে যেতে হবে? উপায় মিললো একটা। ভাটপাড়া গ্রামের ভেতর দিয়ে ঘুরিয়ে-পেচিয়ে নাকি রাস্তা আছে একটা। সেই পথেই ছুটে চললাম।
বাংলাদেশের অন্যতম উঁচু জেলা যশোর। ধানক্ষেতের পাশাপাশি এই এলাকার একটি বৈশিষ্ট্য বাঁশ, বেত, নারিকেল আর পানের বাগান। সেই বাগানের ভেতরে জন্মায় আঁশশ্যাওড়া, আমজুম, দোচুন্টি, বুনো হেনার ঝোপ। সবকিছু মিলিয়ে দুর্ভেদ্য জঙ্গল যেন। তেমনই ঘন বাঁশবাগানের ভেতর মাটির রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। দু’পাশ থেকে বাঁশের ঝাড় নুয়ে এসেছে রাস্তার দিকে। প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ যেন। আর এমনই দুর্ভেদ্য ঘন সেই জঙ্গল যে পাশ থেকে এই দুপুরবেলা যদি শিয়াল ডেকে ওঠে একটুও অবাক হবো না।
সেই ক্যানোপি রাস্তায় যেন এই দিনদুপুরে আধার নেমেছে। তার ভেতর দিয়ে মাটির রাস্তা। একটু এগোতেই আবার দুই ভাগ হয়ে দুদিকে চলে গেছে রাস্তাটি। একটি ধরে এগোলে খানিক পরে দেখা গেল তার আবার তিনটি ভাগ। যেন এক গোলকধাঁধা। সেই গোলকধাঁধায় ঠোক্কর খেতে খেতে এগিয়ে চললাম। মোটরসাইকেল বার দশেক ভুল রাস্তায় গিয়ে আরো পনেরো বার থেমে শ-খানেক বার মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করে যখন পৌঁছালাম তখন ঘড়ির কাটায় দুটো বেজে গেছে।
ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে পা রাখতে না রাখতেই একরাশ মুগ্ধতা আমাদের ঘিরে ধরলো। মন্দিরের দেয়ালের রঙ খানিকটা লালচে। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। তার লালচে আলোয় আরো লাল দেখাচ্ছে মন্দিরগুলো। এক অপ্রাকৃত সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত দিগ্বিদিক।
মন্দিরের নির্মাণকাল ১৭৪৫-৬৪ সাল। মন্দির নির্মাণে ব্রিটিশ আমলে অনুসৃত চুন সুরকি এবং ইটের ব্যবহার করা হয়েছে। ইটের আকৃতি পাতলা ও বর্গাকার। চুন-সুরকির প্রলেপ ধরে রেখেছে ইটগুলোকে। পূর্ব ও পশ্চিম সারিতে চারটি করে মোট আটটি মন্দির।
দক্ষিণ দিকে প্রবেশপথের দু’দিকে রয়েছে দুটি মন্দির। মূল মন্দিরটি পশ্চিম দিকে। সব মিলিয়ে এগারোটি মন্দির। প্রত্যেকটি মন্দির মাঝখানের উঠোনের দিকে মুখ করে অবস্থিত। মূল মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ২৪ ফুট ৪ ইঞ্চি আর প্রস্থ ২২ ফুট ৩ ইঞ্চি। দেয়ালের প্রস্থ ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি।
প্রত্যেকটি মন্দিরে আগে একটি করে শিবলিঙ্গ ছিলো, পরে চুরি হয়ে যায়। এখন শুধুমাত্র মূল মন্দিরেই একটি শিবলিঙ্গ অবশিষ্ট রয়েছে। মন্দিরের বাইরে দক্ষিণ দিকে মন্দির কমপ্লেক্সে ঢোকার প্রধান প্রবেশপথ অবস্থিত। প্রতিটি মন্দিরে প্রবেশের জন্য আছে খিলানাকৃতির প্রবেশপথ ও উপপ্রবেশপথ, বাকানো ও কোণাকৃতির কার্ণিস। আর রয়েছে অনিন্দ্যসুন্দর কারুকার্য। তার মধ্যে রয়েছে পদ্মসহ আরো অনেক চিত্রের মোটিফ।
মন্দিরের বিশেষত্ব এটি স্থানীয় রীতিতে নির্মিত। সে সময়ে যে বাংলায় উন্নত মানের স্থাপত্যশিল্প বর্তমান ছিলো এটি তার প্রমাণ বহন করে চলেছে। ছাঁদগুলো নির্মিত হয়েছে উলম্ব ধরনের ডোমের সমন্বয়ে। অর্থাৎ দুই স্তরে নির্মিত ছাদের ভেতরে গোলাকার এবং বাইরে চালা রীতিতে নির্মিত। সবগুলো মন্দির নির্মাণে স্থানীয় উপকরণ, নির্মাণশৈলি এবং দক্ষতার ছাপ মেলে।
মন্দিরের চারপাশে একসময় প্রাচীর বেষ্টিত ছিলো। এখনও তার চিহ্ন রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি পুকুর ছিলো। এখন সেটি দখলদারদের কবলে। আর রাজবাড়ি? সেখানে এখন পানের বরজ!
রাজা নীলকণ্ঠ রায় প্রতিটি মন্দিরের জন্য দু’শ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। এই জমি থেকে মন্দিরের খরচ উঠে আসতো। মন্দিরের ভোগ হওয়ার পরে ভক্তদের প্রসাদ বিলি করার পর পূজারী ব্রাহ্মণদের বাড়ি বাড়ি ভোগ পাঠানো হতো। দেশভাগের পর স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই ভারতে চলে যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাকি যারা ছিলো তাদের বড় অংশ পুনরায় দেশত্যাগ করে। বড় মন্দিরে এখনো নিত্যপুজো হয়।
আমরা যখন ঘুরে ঘুরে দেখছি, তখন মধ্যাহ্নপূজো দিতে উপস্থিত হলেন একজন পূজারিণী। তিনি স্থানীয় বারুই সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। তাদের পরিবারই গত ষাট বছর ধরে এখানে পূজো করে আসছেন। তার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, মন্দিরগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিলো বহুবছর।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রথম ধাপের সংস্কার কাজ আরম্ভ করে, যা শেষ হয় ২০১৭ সালে। এই সংস্কারের ফলে দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনা ধ্বংসের হাত থেকে আপাতত রেহাই পেয়েছে। সংস্কার কাজ শেষ হলে আশা এটি তার অনন্য রুপ ফিরে পাবে বলে প্রত্যাশা সকলের। অনিন্দ্য এই স্থাপনা আর পাশের স্বচ্ছসলিলা ভৈরব নদ পর্যটনের একটি চমৎকার আকর্ষন হতে পারে। সেজন্য সরকারের পরিকল্পনার প্রয়োজন।
বেলা পড়ে এসেছে। আমরা ঘরের পানে রওনা হলাম। পেছনে পড়ে রইলো কালের বাধা পেরিয়ে টিকে থাকা বহু স্মৃতির আঁধার এক মন্দির। সবকিছু হারিয়ে এক রাজকন্যার নিজের আরাধ্য দেবতার কাছে আশ্রয়ের জন্য স্থাপিত হয়েছিলো যে মন্দির! সবাই আজ হারিয়ে গেছে! শুধু টিকে আছে মন্দির! এটাই কালের নীতি! মানুষ হারিয়ে যায়, টিকে থাকে তার কীর্তি।