ঐতিহ্য আর দৃষ্টিনন্দন পাবনার ‘জোড় বাংলা মন্দির’ -প্রবীর কুমার সাহা
পদ্মা নদী বেষ্টিত ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর জেলা পাবনা। সুপ্রাচীনকাল থেকেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে এই জেলার রয়েছে বেশ সুনাম। এই জেলায় অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। রয়েছে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও। যেসব ইতিহাস-ঐতিহ্য হাতছানি দিয়ে ডাকে এখনও। মানসিক হাসপাতালের জন্য সকলের কাছে সুপরিচিত হলেও প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের জন্যও কম পরিচিত নয় পাবনা। এই জেলায় যতগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে তার মধ্যে ‘জোড় বাংলা মন্দির’ অন্যতম।‘জোড় বাংলা মন্দির’ পাবনার অন্যতম আকর্ষণ। এটি পাবনা পৌর সদরের কালাচাঁদপাড়া মহল্লায় অবস্থিত। কালাচাঁদপাড়ার অবস্থান পাবনা শহর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্বদিকে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় স্বকীয় সত্ত্বা নিয়ে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে জোড় বাংলা মন্দির। এই মন্দিরের দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি পুকুর, যা কানা পুকুর নামে পরিচিত। কানা পুকুর ‘জোড় বাংলা মন্দির’ থেকে ৫০ মিটার দূরে অবস্থিত। কালাচাঁদপাড়া মহল্লায় এই মন্দিরটি আছে বলে এই পাড়াকে জোড় বাংলা পাড়া নামেও পরিচিত।
এই মন্দিরের অভ্যন্তরে কোনো শিলালিপি নেই; যার কারণে এর নির্মাণ সাল, নির্মাতা সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। জনশ্রুতি আছে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রজমোহন ক্রোড়ী নামক একজন ‘জোড় বাংলা মন্দির’ নির্মাণ করেন, যিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদ নবাবের তহশিলদার। জোড় বাংলা মন্দিরকে খোলা জায়গায় একটি মঞ্চের উপরে স্থাপন করা হয়েছে। মন্দিরটির আকর্ষণীয় দিক হলো এর ছাদ। মন্দিরের ছাদ দোচালা প্রকৃতির। মন্দিরের সামনে রয়েছে তিনটি প্রবেশ পথ যা দুটি স্তম্ভের সাহায্যে নির্মাণ করা হয়েছে। পূর্বে এর প্রবেশপথ কারুকার্যমন্ডিত টেরাকোটায় পরিপূর্ণ ছিল কিন্তু এখন তা আগের মতো নেই। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এই মন্দিরের বেশ ক্ষয় হয়। তাছাড়া কালের পরিক্রমায় মন্দিরটি সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। পূর্বে এর অবকাঠামো ছিল শক্তপোক্ত ও সুদৃঢ়। টেরাকোটা, কারুকার্য, অভ্যন্তরীণ নকশা দেখলে মনে হতো এই মন্দিরটি দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরের আদলে নির্মিত হয়েছে। এই ধরনের মন্দিরের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রথম চালাবিশিষ্ট ঘরে পূজা অর্চনা করা হতো এবং দ্বিতীয় চালার ঘরটি বারান্দা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের হাতে জোড় বাংলা মন্দিরের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। চালা শব্দটি শুনলেই বাংলার গ্রামে গঞ্জে অবস্থিত দোচালা, চারচালার কথা মনে পড়ে। পূর্বে এই চালা শব্দের ব্যাপক সাড়া ছিল। বিশেষ করে সপ্তদশ শতকে ইমারাতের ছাদে চালা দেওয়া হতো। বাংলার গ্রাম, গঞ্জের সাধারণ মানুষের ঘর তৈরি হয় মাটি দিয়ে, গোলপাতা ও ঘর দিয়ে। তবে সময়ের সাথে সাথে এর পরিবর্তন হয়েছে। এখন ঘরের চালে ব্যবহার করা হয় টিন কিংবা ইট নির্মিত ছাদ। দোচালা, চার চালা এই শব্দগুলোও যেন হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সপ্তদশ শতকে মন্দিরের নকশায় জোড় বাংলা নামের স্থাপত্যশৈলী লক্ষ্য করা যায়। স্থাপত্যের স্থায়িত্বের কথা চিন্তা করে ছাদে দুটি চালাকে একসাথে জোড়া দিয়ে দেয়া হতো।
তাই একে জোড় বাংলা বলা হতো এবং এখনো বলা হয়। জোড় বাংলা মন্দিরের স্থাপত্যশৈলির নমুনা পাওয়া যায় পাবনায়, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়, বাঁকুড়ায়, পুরুলিয়া ও হুগলি জেলায়। পাবনার জোড় বাংলা মন্দিরে বর্তমানে পূজা অর্চনা করা হয় না। তবে কারো কারো মতে পূর্বে এখানে নিয়মিত পূজা হতো। অভ্যন্তরে গোপীনাথের মূর্তি, রাধা- কৃষ্ণের মূর্তি ছিল। অন্যমতে এই মন্দিরের অভ্যন্তরে কখনো পূজা অর্চনা হতো না। এটি কেবল পরিত্যক্ত স্থাপনা কিংবা মঠ হিসেবেই দাঁড়িয়ে ছিল খোলা স্থানে। তবে স্বীকার করতে হবে যে, এই মন্দিরটি ভাস্কর্য শিল্পের উজ্জ্বল উদাহরণ। কারণ মন্দিরটির নির্মাণশৈলী তাই বলে। মন্দিরটি আকার আকৃতিতে ছোট হলেও পোড়া মাটির ইট দিয়ে কারুকার্য খচিত নকশা দারুণভাবে আকর্ষণ করে দর্শনার্থীদের। ইমারাতের ভেতরের রুমগুলো বেশ অপ্রশস্ত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর অনাদরে-অবহেলায় পড়ে ছিল এই মন্দির। যার ফলে মন্দিরের হাবভাব, মেজাজ, কারুকার্যের বেশ পরিবর্তন হয়ে যায়। পরবর্তীতে পাবনার জেলা প্রশাসকের প্রচেষ্টায় ১৯৬০ সালে এই মন্দিরের আমূল সংস্কার করা হয়। পাবনার ‘জোড় বাংলা মন্দির’ গোপীনাথের মন্দির বলেও পরিচিত ছিল। এখন আর এই নামে কেউ চেনে বলে মনে হয় না। কালাচাঁদপাড়া মহল্লা বেশ জনবহুল হওয়ায় অধিক লোকের বসবাস এখানে। মন্দিরের সামনে খেলাধুলা করে স্থানীয় শিশুরা। রক্ষণাবেক্ষণের তাড়া ও তাগাদা যেন কারোর নেই। মন্দিরটির বাইরের অংশ দেখলেই বোঝা যায় আর্দ্রতায় ও বৃষ্টির কারণে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে পোড়ামাটির ফলক। অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও মন্দিরের কারুকাজে যেন কিছু একটা নিহিত রয়েছে। এই মন্দিরটি ইতিহাস ও সময়ের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক একবারের জন্য হলেও এই মন্দির দেখতে আসে। কারণ এটি সপ্তদশ শতক কিংবা আঠারো শতকের স্থাপত্যশৈলী নিয়ে আজও উজ্জ্বল রয়েছে।