হোটেল ডেল করোনাডো । খায়রুল আনাম
হোটেল ডেল করোনাডো : ক্যালিফোর্নিয়ার সানডিয়েগো শহরের ঐতিহাসিক এই হোটেল – ‘হোটেল ডেল করোনাডো’, ‘ডেল করনাডো’ বা সংক্ষেপে ‘হোটেল ডেল’ কেন এত বিখ্যাত? তার অনেক কারণ। কথা হলো, আদার ব্যাপারী আমাদের জাহাজের খবর নেবার দরকার কি? থাকলে পরে না হয় দেখা যাবে। তার আগে আমাদের আদার ঝুড়িটা না হয় একটু নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখা যাক। অর্থাৎ আমাদের যাতে প্রথম ইন্টারেস্ট, সেদিকেই রওনা দিই। ধরুন, প্রেসিডেন্ট কেনেডি থেকে গবেট আমরা সবাই অল্পবিস্তর ‘মেরিলিন মনরো’র নাম শুনেছি (মনে মনে কামনা করেছেন? ছিঃ ছিঃ)।
আর মেয়েদের পাগল করা নায়ক টনি কার্টিস? আর জ্যাক লেমন? এখন বুঝতে পারছেন, কোন দিকে ধাওয়া করছি? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। জানি তো, আপনি স্মার্ট। আমরা ১৯৫৮ সালে নির্মিত সুপার হিট ছবি, “সাম লাইক ইট হট”-এর কথা বলছি। ছবিটার বেশির ভাগ অংশ এই ‘হোটেল ডেল”-এই তোলা হয়েছিল। আপনার এই বয়সে যখন ছিলাম, তখন আমরা সারা পৃথিবীর স্বপ্নের নায়িকা, মেরিলিন মনরোর জন্য পাগল। সেই বয়সে, কলেজ পালিয়ে, কোলকাতার লাইট হাউস সিনেমা হলে ১০ আনার টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে, টিকিট কেটে ছবিটা ৩ বার দেখেছি। কি বললেন? মেরিলিন মনরো-কে চেনেন না? আহারে বেচারা! চুক চুক।
‘সাম লাইক ইট হট’-এর মতো আরো অনেক সিনেমার প্রধান দৃশ্য এই হোটেলে তোলা হয়েছে। কয়েকটির নাম করা যায়ঃ
১) দি ফ্লাইং ফ্লিট – ১৯২৭ সাল। এই ছবিতে হোটেলটিকে ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে প্রথম দেখানো হয়েছিল। তখন থেকে ‘ডেল করোনাডো’ লাইম লাইটে চলে আসে। এর পর থেকে নানা জন নানা কাজে একে ব্যবহার করে আসছে।
২) সিটিজেন কেন – ১৯৪১ সাল। ছবিটির খুব নাম হয়েছিল। এর নায়ক-পরিচালক ছিলেন প্রখ্যাত অরসন ওয়েলস।
৩) সাম লাইক ইট হট – ১৯৫৮ সাল , যেটার কথা প্রথমেই বলা হয়েছে।
৪) উইকেড, উইকেড – ১৯৭৩ সাল। এই ছবিটার পুরোপুরিই এখানে বানানো হয়েছিল।
৫) ‘ফ্রিকি ফ্রাইডে’ – ১৯৭৬ সাল। এটি একটি খুব ইন্টারেস্টিং মুভি, ওয়াল্ট ডিজনি ক্লাসিক। এতে জোডি ফস্টার একই সঙ্গে মা ও মেয়ের রোল করেছিলেন। একটা মিরাকেল হয়ে, মা হয়ে যায় মেয়ে আর মেয়ে মায়ের জায়গায় চলে আসে। তাদের ভাবনা চিন্তা ও কার্য্যকলাপ কেমন ভাবে পালটে গেল ও কে কিভাবে সেটা ডিল করলো এই নিয়ে মজার একটি গল্প। ছবির শেষের দিকে মা মেয়ে আবার তাদের নিজস্ব জায়গায় ফিরে আসে।
৬) দি স্টান্ট ম্যান- ১৯৮০ সাল। পিটার ও’টুল এ ছবির হিরো ছিলেন।
৭) ‘টপ গান’ – ১৯৮৬ সালের ছবি। এতে পার্ট নিয়েছিলেন টম ক্রুজ ও ভ্যাল কিলমার।
৮) ‘হান্ট ফর রেড অক্টোবর – ১৯৯০ সাল। ব্যতিক্রমধর্মী একটি ছবি।
৯) ‘অলমোস্ট ফেমাস’ – ২০০০ সাল। একটা টিন-এজ সাংবাদিকের গল্প।
১০) ‘মাই ব্লু হেভেন’ – ২০০০ সাল। এতে স্টিভ মার্টিন ও জোন কিউস্যাক প্রধান চরিত্রে ছিলেন।
১১) ‘ট্র্যাফিক’- ২০০০ সাল। এতে ক্যাথরিন যিটা-জোন্স, মাইকেল ডগলাস ও বেনেচিও ডেল টরো অভিনয় করেছিলেন।
১২) ‘ব্রুস অলমাইটি’ -২০০৩ সাল। এতে কমেডিয়ান জিম ক্যারি অভিনয় করেন।
১৩) ‘অ্যাংকরম্যান’ – ২০০৪ সাল। এতে অভিনয় করেছিলেন উইল ফ্যারেল ও ক্রিশ্চিনা অ্যাপেলগেট।
এছাড়া, সাহিত্য , সঙ্গীত, স্টেজ প্রোডাকশান, টেলিভিশন – প্রায় সব বিভাগেই ‘হোটেল ডেল’-এর কিছু রোল লক্ষ্য করা গেছে। এই হোটেল ও তার সঙ্গে মেরিলিন মনরোর ছবিওয়ালা ইউ এস পোস্টেজ স্ট্যাম্পও বেরিয়েছে।
এই ‘হোটেল ডেল’-এ যুগের পর যুগ ধরে এসেছেন অনেক প্রেসিডেন্ট, রাজা বাদশা, সেলেব্রিটিসহ আরো অনেকে। সিনেমা ছাড়াও অনেক বইতে এই হোটেলের উপর ফিচার লেখা হয়েছে। যাঁরা এখানে এসেছেন, তাদের মধ্যে কিছু নাম হলো, টমাস এডিসন, ফ্রাঙ্ক ব্রাউন, চার্লি চ্যাপলিন, হাওয়াই দ্বীপের রাজা মালাকাউয়া, ভিনসেন্ট প্রাইস, বেবিরুথ, জেমস স্টুয়ার্ট, বেটি ডেভিস এবং ক্যাথরিন হেপবার্ন। ইদানিং কালের অতিথিদের মধ্যে আছেন কেভিন কস্টনার, হুপি গোল্ডবার্গ, জিন হ্যাকম্যান, জর্জ হ্যারিসন, কিয়ানু রিভস, ব্র্যাড পিট, ম্যাডোনা, বারব্রা স্ট্রাইস্যান্ড, এবং ওপরা উইনফ্রে।
প্রেসিডেন্টদের মধ্যে যাঁরা এখানে রাত কাটিয়েছেন, তাঁরা হলেন বেঞ্জামিন হ্যারিসন, উইলিয়াম ম্যাকিনলি, উইলিয়াম হাওয়ার্ড ট্যাফট, উড্রো উইলসন, ফ্র্যাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট, ডোয়াইট ডি আইসেনহাওয়ার, জন এফ কেনেডি, লিন্ডন বি জনসন, রিচার্ড নিক্সন, জেরাল্ড ফোর্ড, জিমি কার্টার, রোনাল্ড রিগ্যান, জর্জ হারবার্ট ওয়াকার বুশ, বিল ক্লিন্টন, জর্জ ডবলিউ বুশ এবং বারাক ওবামা।
বিশাল অট্টালিকা থাকলে তার সঙ্গে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর মতো ভুতুড়ে গল্পও থাকে। এই হোটেলে ‘কেট মর্গ্যান’ নামে এক ভদ্রমহিলার ভুত আছে। ১৮৯২ সালের ২৪ শে নভেম্বর তিনি ৩০২ নং রুমের জন্য ‘চেক ইন’ করেন। হোটেল স্টাফদের কাছে তিনি বলেন, তিনি অসুস্থ, তাঁর পেটে ক্যান্সার। তিনি তাঁর ডাক্তার ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন, ভাই এসে তাঁর চিকিৎসা করবে। কিন্তু সেই ভাই আর শেষ পর্য্যন্ত এসে পৌঁছায় নি। তিনদিন পরে হোটেলের যে সিড়ি বীচ-এর দিকে নেমে গেছে, সেই সিড়ির উপর তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়। নিজ পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেছিলেন। তার বেশ কিছুদিন পরে তিনি নাকি অন্য নাম নিয়ে আবার ঐ হোটেলে ‘চেক ইন’ করতে আসেন। এই রহস্য এখনো রহস্যই থেকে গেছে। ১৯০৪ সালে এখানে আর একটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। অভিনেত্রী ইসাডোর রাশ এই হোটেলের বীচ-এ ডুবে মারা যান।
সে যাই হোক ‘হোটেল ডেল’ ঐতিহাসিক ভাবে বিখ্যাত হবার অনেক কারণ আছে। প্রথমত ১৮৮৮ সালে নির্মিত হবার পর, এর বয়স এখন ১৩০ বছর হলো। ১৯৭৭ সাল থেকে এটিকে জাতীয় ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। নির্মাণের পর হোটেলটি যখন ব্যবসার জন্য অফিসিয়্যালি খোলা হয়, তখন এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রিসর্ট হোটেল ছিল। এই বিল্ডিং-এর জাত আলাদা। সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি এই বিশাল বিল্ডিংটি, এ জাতীয় স্ট্রাকচারে এখন পৃথিবার মধ্যে দ্বিতীয়। এর মাথা ডিঙ্গিয়ে সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি অন্য যে স্ট্রাকচারটি এক নম্বরে বহাল আছে, সেটিও আমেরিকায় অবস্থিত। বিল্ডিংটি হলো অরিগন স্টেট-এর টিলামুক এয়ার মিউজিয়াম।
চলুন না, একবার হোটেল করোনাডোতে দু’একরাত থেকে আসি। কেট মর্গানের ভুতটা দেখার খুব লোভ হচ্ছে। ‘ছবি বিশ্বাস’- এর মনে রাখার মতো সেই রোলটাকে টেক্কা দেবার একটা অদম্য ইচ্ছা কি আপনার হয় না?
(শিকাগো)