মায়াজালে এখনো আমি । আনান্নিয়া আন্নি
পর্বঃ ০৫
আজ ঝিলপার থেকে ঘুরে এসে অনেক বছর পর নিজেকে আয়নার সামনে দাড়িয়ে আরেকবার নতুন করে দেখেছি, সত্যি কি আমাকে শাড়ি তে সুন্দর লাগছিলো নাকি ছেলেটা আমাকে মিথ্যে কথা বলেছে? এরকম করে আমাকে বোধহয় কেউ কখনও দেখেনি, দেখলেও এতোটা সুন্দর করে বর্ণনা করেনি কখনোই…
(৫ই অক্টোবর)
ভর দুপুরে খেয়েদেয়ে জব্বর এক ভাতঘুমে আচ্ছন্ন আমি; ফোন এলো ইমাদের।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইমাদ বলে উঠলো;
তোমার গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হতে আর কত সময় লাগবে?
বললাম লাগবে আর মাস ছয়েক মতো।
বললো আগে গ্র্যাজুয়েশান কমপ্লিট করবে নাকি আগে বিয়ে করবে?
বললাম আমি আগে পড়াশোনা টা শেষ করতে চাই ইমাদ, তারপর একটা চাকরির জন্য চেষ্টা করবো, বিয়েটা তার ও পরে ভেবে রেখেছি।
মানে?
তুমি পড়াশোনা করেছো এটাই ঠিক আছে, বিয়ের পর বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে কাজে দেবে তা বলে তোমাকে চাকরি করতে হবে কেনো? আমি তো চাকরি করছিই।
তোমাকে আর কতবার বলবো ইমাদ, ভাইয়া আমাকে পড়াশোনা করাচ্ছে চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য, আমি চাকরি করতে চাই।
এই একদম চুপ… পড়াশোনা শেষ করবে সে পর্যন্তই ঠিক আছে, চাকরি করার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হতে চলেছে আমাদের তাই মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকো এখন থেকেই।
ইমাদ এর কথাগুলো বড্ড বেশি কঠিন ছিলো; একগুয়ে স্বভাবের মানুষ টার কাছে তার নিজের সিদ্ধান্তের ওপরে আমার ইচ্ছের যেনো কোনো মুল্যই নেই;
শুনেছিলাম বিয়ে নাকি মেয়েদের জীবনে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ, বিয়ে নিয়ে নাকি একটা মেয়ের ভিন্নধর্মী অনুভূতি কাজ করে, কই আমার তো কোনো অনুভূতিই কাজ করছেনা, বরং ইমাদ এর মুখে বিয়ে কথা টা শুনে বড্ড বেশি অনিরাপত্তায় ভুগছি আমি !
মনের মধ্যে কিসের এক দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে কাটলো সারা দুপুর। আজ যেনো মনের ভেতর টায় কেমন শ্রাবণের কালো মেঘের মতো করে বর্ষনের সৃষ্টি হচ্ছে, একদিকে ভাইয়ার স্বপ্ন আর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা অন্যদিকে ইমাদ এর কথা,দুই-ই যেনো মাথার ভেতরে ঘুর্ণিঝড় এর মতো ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
সন্ধে হয়ে গিয়েছে, এখনো ঘরে সন্ধে বাতি জ্বলেনি,চারদিকে মাগরিবের আজান হচ্ছে আর আমি ঘরখানা অন্ধকার করে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছি;
মিনিট পাঁচেক পরই কলিং বেল বেজে উঠলো;বড় ভাবি বোধহয় নামাজে বসেছে, বাড়িতে আর কেউ নেই, কুমু টা মনেহয় পড়তে বসেছে। বাধ্য হয়ে উঠলাম, একরকম বিরক্ত ও হয়েছি বটে, যে এসেছে তার কি নামাজের সময় জ্ঞান বলে কিছু নেই নাকি?
হতেও পারে কেউ বিপদে পরে এসেছে, যাইহোক আমি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম;
কিন্তু এ কি আশ্চর্য! দরজার বাইরে তো কেউ নেই।বাইরে একটা উঁকি মেরেই চলে আসবো তখনই চোখে পরলো দরজার সামনের ফুলদানি টার ওপরে কি একটা বক্স রাখা। দেখে তো মনে হচ্ছে কোনো উপহার, রঙিন কাগজে মোড়ানো। কে দিয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারছিনা,আমাদের বাসার সামনে যখন বক্স টা রাখা তখন নিশ্চয়ই আমাদেরই কারো জন্য হবে হয়তো। বক্সটা নিয়ে ঘরে এসে বিছানায় রেখে আবারও শুয়ে পরলাম। ওটাতে কি আছে না আছে ওসব দেখার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। হবে হয়তো ভাইয়ার দরকারী কোনো কিছু।
হ্যা রে অপ্সরা… কে এসেছিলো? বেল বাজলো শুনলাম।
জানিনা ভাবি কে এসেছিলো এই গিফট বক্স টা রেখে গিয়েছে। দেখো তো।
তুমিই দেখোনা কি আছে ওতে আবার আমি কেনো…
এই বলে ভাবি চলে গেলো।
ভাবির কথায় উঠে বসলাম।অনিচ্ছা থাকা স্বত্তেও বক্সটি হাতে নিলাম।
বক্স খুলতেই চোখদুটো আটকে গেলো!
আর বারবার মনে হচ্ছিলো সেদিন ঝিলপারে দেখা হওয়া সেই ছেলেটির কথা;
সামনে একটা জীবন্ত পরী,অতঃপর লাইট, ক্যামেরা,আ্যকশান!
সত্যি সত্যি ছেলেটা আমার ছবি তুলেছে!
এতো নিখুঁত সুন্দর করে ছবিগুলো তুলেছে সে, একদম তার সুন্দর অসাধারণ বর্ননা-র মতোন করে। আমার ছবিগুলোর সাথে একটা চিরকুট ও পাঠিয়েছে দেখছি, তাতে লেখা আছে;
“প্রেমের প্রস্তাব নয়, এটা আমার আপনার প্রতি একটা স্নিগ্ধ সুন্দর ভালোবাসা নামক অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ,যাকে প্রথম বার দেখে মনের মধ্যে অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করেছিলো,কাকতালীয় ভাবে যাকে অপ্সরা ভেবেছিলাম সত্যি সত্যি সে অপ্সরা হয়ে গিয়েছিলো।কাওকে ভালো লাগলে তাকে পেতেই হবে এমনটা নয়, তার মুখের হাসির কারন হতে পারাটাই বা কম কিসে?
আমি আপনার মলিন মুখে এক চিলতে হাসির কারন হয়ে থাকতে চাই অপ্সরা”
চিরকুট টাতে কোনো নাম ঠিকানা কিছুই লেখা নেই তারপর ও আমার বোঝার বাকি নেই যে এটা সেদিনের ওই ছেলেটারই কাজ।
(১০ অক্টোবর)
বাড়ির কাওকে জানাতে পারিনি কি ছিলো ওই গিফট বক্স টিতে। নাম না জানা অচেনা সেই ছেলেটির তোলা নিজের ওই ছবিখানা দেখে চলেছি আজ বেশ ক’দিন ধরে। তার কথাগুলোও মনে হয়েছে বেশ ক’বার।
এরিমধ্যে ইমাদ এর সাথে কথা হয়েছে মোটে দু দিন তাও খুব অল্প সময়ের জন্য।
সেটাও শুধু বিয়ে করা আর চাকরি না করা নিয়ে যেটাতে আমার মনের কোনের শঙ্কা টা আরো বেড়েছে বৈ কমেনি একটুও।
(১১অক্টবর)
খুব ভোরবেলা আজ ও কেউ কলিং বেল বাজিয়েছে,ঘুমের ভেতর শুনতে পেয়েছি। খানিকক্ষণ বাদে বড় ভাবি এসে দরজায় নক করছে আর বলছে অপ্সরা তোমার নামে একটা পার্সেল রয়েছে।
বোধহয় ইমাদ পাঠিয়েছে। কি ব্যাপার আজকাল ভালোবাসা একটু বেশিই বেড়েছে মনেহয়,সকাল সকাল তাজা ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছে দেখো…
কথাটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি, আমি জানি কাজ টা ইমাদের নয়, কাজ টা কে করেছে সেটাও জানি।
কেনো এমন করছে ছেলেটা? কি বলবো বাড়ির সবাইকে,এটা নিয়ে না আবার ইমাদের সাথে কোনো ঝামেলা হয় আমার।
দরজা খুলে দেখি ভাবি একটা লাল গোলাপের তোরা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,আমার হাতে তোরা টা ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো, লাল গোলাপ বরাবরই আমার খুব পছন্দের, ইমাদ এর গোলাপ পছন্দ নয় তাই তার তরফ থেকে গোলাপের শুভেচ্ছা পাওয়া হয়নি কখনও এমনকি আমি বেশ কয়েকবার তাকে ভালোবেসে গোলাপ দিয়েছি কিন্তু সে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে আর বলেছে ধরে নাও ওটা আমিই তোমাকে উপহার দিয়েছি; আমিও মনের মধ্যে আফসোস না রেখে সেগুলো ফিরিয়ে এনেছি।
দ্বিতীয় কারো থেকে গোলাপ এর শুভেচ্ছা আশা করিনি কখনও, যা হচ্ছে সবই অপ্রত্যাশিত ভাবে।
আজও তোরার সাথে একটা চিরকুট আছে; তাতে লেখা আছে…
“স্বর্গীয় জলপরী যার নামের অর্থ তার জীবনে-র স্বর্গীয় সুখ হতে চাই আমি তারই মুখের হাসির মধ্যে দিয়ে”
ডায়েরির এই অংশ টি পড়তে পড়তে আবারও ছোট কাকির ডাক পরলো রান্নাঘর থেকে;
কুমু… একটু এদিকে শুনে যা তো।
কি হয়েছে কাকি? কিছু করতে হবে?
তরকারি টা একটু নেড়ে দিবি আমি ডাল টা সেদ্ধ বসাবো। নাহলে আবার তরকারির পোড়া লেগে যাবে।
হ্যা কাকি নেড়ে দিচ্ছি…
হ্যা রে.. ঝিলি কি করছে? দুজনে গোসল সেরে নে রান্না তো প্রায় হয়েই এলো খাবি তো নাকি?
কুমু-র কোনোদিকে খেয়াল নেই, ওই যে খুন্তি দিয়ে তরকারি নেড়ে যাচ্ছে আর কিসব ভেবে চলেছে কে জানে..
আরে এই কুমু…
হ্যা হ্যা কাকি কিছু বলেছো আমায়?
কেনো রে তুই কিছু শুনতে পাসনি? কি ভাবছিলি?
না কিছু ভাবছিলাম না তো।
আচ্ছা কাকি ছোট ফুপু-র বিয়ের দিন আসলে কি হয়েছিল বলোতো? বাড়ির সবাইকে বলতে শুনেছিলাম ছোট ফুপু অসুস্থ হয়ে গিয়েছে বিয়ের দিন তাই হসপিটালে নেওয়া হয়েছিল কিন্তু তারপর থেকে আর ছোট ফুপু কে স্বাভাবিক হতে দেখিনি। কখনও ভালো তো কখনো এমন হয়ে যায় হঠাৎ করে। বিয়ের দিন সেই যে অসুস্থ হলো ফুপু তারপর দুমাস আর কারো সাথে কথা বলেনি।
মা বলেছিলো ফুপু-র একটা বড় অসুখ করেছে সেটা নাকি ছোটদের জানতে নেই।
কি অসুখ কাকি? ছোট ফুপু কি কাওকে খুব ভালোবেসেছিলো বিয়ের আগে?
কুমু… মা
বড়দের নিয়ে এতো প্রশ্ন করতে নেই, তা ছাড়া আমি তো অনেক পরে বিয়ে হয়ে এসেছি এ বাড়িতে আমি কি এতোসব জানি বলো? আমাকে যা বলার বলেছো তোমার মা বা মেজো কাকি কে এসব জিগ্যেস করতে যেওনা তাহলে কিন্তু খুব বকা খাবে। ছোট ফুপু কে নিয়ে এতো কৌতুহল রেখোনা মনে।
কুমু জানে ছোট কাকি তাকে মিথ্যে কথা বলেছে। পরে আসলেও ছোট কাকি সবটাই জানে কিন্তু কিছু বলছেনা।
কি হয়েছিল ছোট ফুপু-র সাথে? তাহলে কি ঝিল পারের ওই ছেলেটার সাথে একটা সম্পর্ক হয়েছিল ছোট ফুপু-র? কি লেখা আছে ডায়েরির পরের পাতায়? কখন যে বাকি টা পড়বে কুমু আর তর সইছেনা তার….
চলবে ♥️