আগুন বরফ – ফয়সাল বিন আশিক
আগুন বরফ
——————–
ফয়সাল বিন আশিক
______________
রিলিফের কম্বলখানা পুড়িয়ে দিল বুড়ো হাকিম।
ছাত্রদের দেয়া শীতের জামাটিও পুড়িয়ে ফেলল ছোট্ট আকবর আর আসগর।
পরন ঢাকতে যততুকু শাড়ি লাগে ততটুকু রেখে বাকিটা আগুনে পোড়াল নসিমন।
শীত যতটা পড়ে রিফিলের কম্বল ততটা মোটা হয় না কখনই।
যার পিঠের নিচে তোষাক নেই , তার পেটের উপর কম্বল রেখে লাভ কী?
যার পিঠের নিচে থাকে ফুটপাতের হেরিনবোম রাস্তার সুসজ্জিত ইট ,
তার পেটের উপর কম্বল রেখে লাভ কী হয়?
যার পিঠের নিচে সিড়ির নিচের মেঝে , তার বুকের উপর কম্বল রেখে লাভ কী হয়?
যার হাত পা গড়াগড়ি খায় হিমরাত্রির হিম-শীতল মাটিতে ,
কম্বল দিয়ে কান-মাথা ঢেকে তার লাভ কী হয়?
বিশ্ববিদ্যালয় না কী যেন বলে?
সেখান থেকে কিছু ছেলে মেয়েরা এসে দিয়ে গেছে কিছু পুরনো শীতের জামা।
অবশ্য ওরা বিলাসিতা করেই হয়ত সেগুলোকে পুরনো বলে;
ওরা জানে না , ওর চেয়ে নতুনজামা এদের জীবনে আসে না কখনও ।
ছোট্ট আসগর সেই জামা পেয়ে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আজ কি ঈদ?
সেই জামাটিকেই আজ পুড়িয়ে দিল।
৬ বছর আগে বিয়ের সময় যে শাড়িটা পেয়েছিল নসিমন তাতে সেলাই পড়েছিল বহুবার।
তার পঙ্গু সোয়ামী বুকে কাঠ-চেরা দুঃখ নিয়ে,
মুখে অপারগতার হাসি হেসে তাকে বলেছিল,
শাড়িতে তালি মেরে মেরে যতটা সুতো খরচ হলো তোমার তা দিয়ে একটা শাড়িই বোনা যেত!
এক কলেজ ছাত্রী গত বছর ভালবাসা দিবসে কেনা হলুদ শাড়িটা দান করলে
নসিমনের মনে হয়েছিল, আজ পরী হয়ে আসমানে উড়বে সে।
আজ সেই শাড়ির বাসন্তী রঙের আচল ছিড়ে পুড়িয়ে দিল সে।
একটা বরফের টুকরোকে,
হ্যা, হ্যা, মনোযগ দিয়ে শোন, আর উত্তর দাও,
একটা বরফের বিশাল টুকরোর উপরে একটা পাতলা কম্বল কিংবা ছেড়া জামা কিংবা বাহির থেকে শরীর দেখা যায় এমন একটা শাড়ি ফেলে দিলে
বরফটা কী সাথে সাথে গলে যায়?
যতটুকু উষ্ণতা সে পায় , তার চেয়ে তার নিজের শীতলতা কি বেশি নয়?
মধ্যরাতের কুয়াশায় ভিজে ঊঠেছে গাছের পাতা;
টিপটিপ করে বৃষ্টির ফোটা হয়ে নামছে পাতার চিকন কোনা বেয়ে।
মা পাখিটা নিজের পালক ফুলিয়ে আগলে রেখেছে দুটি বাচ্চাকে।
নসিমনের তো পালক নেই , তার বাচ্চাদের সে রাখবে কোথায়?
কুয়াশার অকাল বর্ষায় অনেকটাই ভিজে ঊঠেছে হাকিমের রিলিফের কম্বল।
রিলিফের কম্বলগুলো সরকার ব্যাচেলরদের জন্য তৈরি করে কিনা
মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে হাকিমের মনে। এত ছোট কেন?
কম্বল থাকলেও তার নিচে থাকার সৌভাগ্য হাকিমের কোনদিনই হয় না।
মাঝখানে আসগর আর আকবর ঘুমায়,
ওপাশ থেকে নসিমন আর এইপাশ থেকে হাকিম তা দিয়ে যায় পাখিদের মত।
ছেলেদের জড়িয়ে ধরে পড়ে থেকে কনকনে শীতের রাতে শিশিরের সৌন্দর্য গায়ে মেখে মেখে।
গেল রাতে একটু বেশিই ঠাণ্ডা পড়েছিল,
কোন সাংবাদিক সংবাদ বানাতে পাখির বাসার খোঁজ কোনদিন নেয় না বলেই
তারা জানল না,
মা পাখিটা বাচ্চা দুটোকে ফুলানো পালকের নিচে জাপটে ধরে আছে মরে যাবার পরেও।
সাংবাদিক শুধু রিপোর্ট করার তাগিদে দেখে গেল,
বাঁচার তাগিদে কম্বল পুড়িয়ে আগুন জ্বেলেছে হাকিম।
শাড়ির আচল ছিড়ে সে আগুনে ইন্ধন দিয়েছে নসিমন।
কাঁপতে কাঁপতে জামা খুলে দিয়েছে বড় ভাই আকবর,
তার দেখাদেখি আসগর।
তারপর প্যান্টও।
তারপর হাকিমও।
সকাল হলে তাদের নগ্ন দেখে হাসবে অনেকেই।
কিন্তু সকাল পর্যন্ত আয়ু বাড়াতে হলে আগুন দরকার ছিল।
শিশির ভেজা কুড়োনো পাতায় আগুন জ্বলছিল না কোনমতেই।
মা পাখিটার মৃত্যু টের পেয়ে তাদেরকে ঠোটে করে হাকিমের আগুনের কাছে নিয়ে এল বাবা পাখিটা।
আসগর আর আকবর পাখির মাংস খায় নি কোনদিন।
অনেক ইচ্ছা ছিল।
আজ এসেছে সুযোগ।
শুধু ধরে পাখি তিনটাকে আগুনে ফেললেই হতে পারে ইচ্ছাপূরণ।
কিন্তু তা হলো না।
মানুষের ছেলেদুটো ভাবতে থাকল,
একটা পাখি আসগর, একটা আকবর, পাখির বাবাটা পঙ্গু হাকিম,
আর মরে যাওয়া মা পাখিটা কিছুক্ষন আগেই রক্তবমি করে বরফ হয়ে জমে যাওয়া নসিমনের।