কামাল লোহানী ছিলেন প্রত্যেকটি কাজের অনুপ্রেরণা
মহাপ্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস কেড়ে নিল দেশবিদেশে পরিচিত প্রখ্যাত সাংবাদিক কলামিষ্ট কামাল লোহানীর প্রাণ।
পাবনা প্রতিনিধি : মহাপ্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস কেড়ে নিল দেশবিদেশে পরিচিত প্রখ্যাত সাংবাদিক কলামিষ্ট কামাল লোহানীর প্রাণ। তিনি কেবল একজন সাংবাদিক-ই ছিলেন না। তিনি একাধারে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ভাষা সৈনিক ও দক্ষ সংগঠক। তাঁর চলে যাওয়ায় নিজ জেলা পাবনাতেও শোকের বাতাস এসে ভারি করে দিয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকসহ নানা অঙ্গনকে।
তাঁকে অনুসরণ করে অনুপ্রেরণা নিয়েই দীর্ঘ জীবন পাড়ি দিয়ে এসেছেন পাবনার আরেক শিক্ষাবীদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, দক্ষ সংগঠক ও ঐতিহ্যবাহী পাবনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি প্রফেসর শিবজিত নাগ। তিনি পাবনা সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, বর্তমানে পাবনা কালেক্টরেক্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলাম লেখক কামাল লোহানীর মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েছেন পাবনার এই বিশিষ্টজন। তাঁর অনুভূতির কথাই জানাচ্ছেন সাংবাদিক আরিফ আহমেদ সিদ্দিকীকে।
প্রফেসর শিবজিত নাগ বলেন, পাবনার শতবর্ষী ঐতিহ্যম-িত প্রতিষ্ঠান পাবনা জিলা স্কুল, পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা প্রেসক্লাব, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ও আড়েপিষ্টে জড়িত ছিলেন কামাল লোহানী। তিনি বলেন, আমার এই জীবনদ্দশায় প্রত্যেকটি কর্মে প্রেরণা, অনুপ্রেরণা, পুরোধার উৎস কামাল লোহানী। তাঁর আদর্শ, তাঁর সংগ্রামী জীবন, তাঁর আলোকিত পথ দেখেই আমি যুতটুকু করেছি সেই স্মৃতিতেই তাঁকে আজ আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
শিবজিন নাগ বলেন, তাঁকে হারিয়ে আমার যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছেন, সৃষ্টি হয়েছে শূন্যতার। এই শুন্যতা আমার আর কখনো পূরণ হবে না। তিনি বলেন, কামাল লোহানী অসুস্থতার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ, কথাবার্তা হয়েছে। গত ১৯ জানুয়ারি তার সাথে আমার শেষ দেখা। এছাড়া প্রতিনিয়ত ফোনে কথা হতো। তিনি ফোন করলে বা আমি করলে আসলে ফোন ছাড়ার বিষয়টি কখনো আমাদের দুজনের মাথায় আসেনি।
শিবজিত নাগ বলেন, কামাল লোহানী, এদেশের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার যুদ্ধসহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তিনি জড়িয়ে ছিলেন আপন মহিমায়। তার প্রতিটি কর্মকান্ডের যেটাই স্মরণ করি, সেখানেই চলে আসে চোখের পাতায় কামাল লোহানী।
তিনি বলেন, সমস্ত আন্দোলন, সংগ্রামের জীবন্ত একটি ইতিহাস ছিলেন কামাল লোহানী। এই ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে আমার প্রিয় জন্মভূমি, প্রাচীন জনপদ, ঐতিহ্যবাহী জেলা পাবনা। জড়িয়ে আছে পাবনার কিছু প্রতিষ্ঠান, যেখানে আমি স্বাধীনতার পরের থেকেই অত্যন্ত ঘনিষ্ট ভাবে জড়িত দেখেছি। বিশেষ করে, পাবনা প্রেসক্লাব, অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি, বনমালী ইন্সটিটিউট, পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, জিলা স্কুল, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে যে সামান্য টুকু কাজ করেছি। তাঁর অনুপ্রেরণার জায়গা ছিল কামাল লোহানী।
প্রফেসর শিবজিত নাগ বলেন, আমি তাঁর কাছে এতোটা স্নেহের ছিলাম যে, আমার প্রত্যেকটি কাজে তাঁর উপদেশ, পরামর্শ, তার অনুপ্রেরণা আমাকে সবসময় তাড়িত করতো। যে কোন ধরণের কাজে যেন আমি তার উৎসাহ পেতাম। কোন আলোচনায় বসলে অন্তত তাঁর নাম বাদ দিয়ে আমার আলোচনার শুরুটাই হতো না।
তার মতো বলিষ্ট সংগঠকের অনুরোধেই আমি উদীচী ছেড়ে গণশিল্পীতে এসে পাবনায় নেতৃত্ব দেই। তার কাছ থেকে পেয়েছি সার্বক্ষণিক পরামর্শ। আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে স্যালুট জানাই।
প্রয়াত কামাল লোহানীর পরিবারের সমস্ত সদস্য যেন তাঁর পথ ধরে চলতে পারেন, তাঁর কর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন এই কামণা করি। তারা যেন তাঁর আদর্শকে বুকে ধারণ করে সামনে সংগ্রাম করে সেই আদর্শ সমুন্নত রাখতে পারেন এই প্রত্যাশা করি প্রয়াত কামাল লোহানীর পরিবারের শোকার্ত সদস্যদের প্রতি।
করোনাকালীন সময়ে জাতির এই দূর্দিনের মধ্যেও কামাল লোহানী যে ভাবে কাজ করেছেন। করোনা নিয়ে তিনি বসেছেন, লিখেছেন, মানুষের ভালোর জন্য তিনি দিয়েছেন দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য। সবদিক বিবেচনা করেই আমরা যেন তাঁর মতোই আগামী দিনগুলোতে এগিয়ে যেতে পারি সেই প্রত্যাশার কথা জানান শিক্ষাবীদ প্রফেসর শিবজিত নাগ।
কামাল লোহানীর জীবনী : তৎকালীন বৃহত্তর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সনতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী। শুরুটা কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাবনা চলে আসেন। ভর্তি হন পাবনা জিলা স্কুলে। ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকাতে। শতবর্ষি পাবনার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক।
কর্মজীবনে কামাল লোহানী দৈনিক মিল্লাত পত্রিকা দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর আজাদ, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। সাংবাদিক ইউনিয়নে দুই দফা যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতেও দুইবার মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। ছায়ানটের সম্পাদক ছিলেন পাঁচ বছর। কামাল লোহানী গণশিল্পীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটেরও উপদেষ্টা। তিনি ২০১৫ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদক পান।
কামাল লোহানীকে গত বুধবার (১৭ জুন) সকালে রাজধানীর হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে ভর্তির পর তাঁর শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হয়। তিনি দীর্ঘদিন থেকে বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। গত মাসেও তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ফুসফুস ও কিডনির জটিলতা ছাড়াও হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের সমস্যাতেও ভুগছেন ৮৬ বছর বয়সী প্রবীণ এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।