শেষ হচ্ছে ভোগান্তি ॥ আগামী বছরেই চালু হবে স্বপ্নের বিআরটি

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিশ কিলোমিটার সড়কে ভোগান্তি অবসানের সংবাদ মিলেছে। গত কয়েক বছর ধরে এই গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় চলাচলকারী হাজার হাজার যানবাহন চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছে। এখনও চলছে সেই ভোগান্তি। আগামী বছর জুন মাসের মধ্যে এই রাস্তা এবং বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) চালু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রকল্প পরিচালক ইলিয়াস শাহ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, অনেক বাধা পেরিয়ে এখন এমন এক স্থানে পৌঁছেছি যেখান থেকে সুখবর দেয়া যায়। আগামী বছরের জুনের মধ্যে টার্গেট বেঁধে দেয়া হয়েছে প্রকল্পটি শেষ করার। যদি কোন কারণে সেটা নাও হয়- তাহলেও বড় জোর ডিসেম্বর পর্যন্ত গড়াতে পারে। এটুকুই নিশ্চয়তা দিতে পারি আগামী বছরের ডিসেম্বরের পর আর অভিযোগ থাকবে না। এই রাস্তার সুফল পাবেন দেশবাসী।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের মহাসড়কের গোলচত্বরে চার বছর ধরে সাজিয়ে রাখা আছে গার্ডার। দাঁড়িয়ে আছে পিলার। নিচে বালুর স্ত‚প, কংক্রিট ও পাথর। ধীর লয়ে একটা দুটি গাড়ি সিঙ্গেল লেনে চলছে। সারাক্ষণই লেগে থাকছে যানজট। ঘটছে দুর্ঘটনা। ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের এমন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে যানবাহনের জন্য দুর্ভোগ হয়ে আছে। শুধু বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট নির্মাণের জন্য এমন সঙ্কট নয়। বিমানবন্দর এলাকা আরও কয়েকটি প্রকল্পের সংযোগস্থল। প্রথম দফায় প্রকল্প নির্মাণের সময়সীমা ধরা হয়েছিল তিন বছর। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হওয়াই দেখা দিয়েছে বিপত্তি। এর পর উত্তরা এলাকায় সড়কে কয়েকটি ইউলুফ থাকার কারণে যানজটের তেমন ভোগান্তি নেই। উত্তরা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত আবার ভোগান্তি। চল্লিশ মিনিটের রাস্তায় এখন লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। বছরের পর বছর ধরে এই এলাকার যাত্রী ও পথচারীদের কপালে এমন দুর্দশা লেগেই আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছর দুয়েক আগেই শেষ হওয়ার কথা ছিল প্রকল্পটি। নানা জটিলতায় শুরু থেকে এ পর্যন্ত তিন বার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। গাজীপুর থেকে ২০ মিনিটে এয়ারপোর্ট আসার স্বপ্নের এই প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হয় ২০১৩ সালে। তখন থেকেই শুরু হয় রাস্তা কাটাকাটি ও খুঁড়াখুঁড়ি। শুরু হয় ভোগান্তি। প্রথম দিকে বৃহত্তর স্বার্থে সাময়িক ভোগান্তি যাত্রীরা মেনে নিলেও এক পর্যায়ে শুরু হয় ক্ষোভের বহির্প্রকাশ। গাজীপুর থেকে সায়েদাবাদ চলাচলকারী বলাকা পরিবহনের চালক আবদুল মজিদ বলেন, কয়েক বছর ধরেই ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে গেছি। কবে এই কষ্টের শেষ হবে আল্লাহই জানেন। প্রকল্প এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, মাস চারেক ধরে কাজ বন্ধ রয়েছে এয়ারপোর্ট পয়েন্টে। একটি ক্রেন ভেঙ্গে পড়ায় তা ঠিক করতে সময় লেগেছে। চীন থেকে স্পেয়ার পার্টস এনে এখন ক্রেনটি মেরামত করা হয়েছে। এখন আবার কাজ শুরু হবে।

জানা গেছে, প্রকল্পটি মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত। গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত অংশের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ইলিয়াস শাহ। মাঝখানে আব্দুল্লাহপুর থেকে চেরাগআলী পর্যন্ত চার কিলোমিটার ব্রিজের অংশটুকুর প্রকল্প পরিচালক হচ্ছেন প্রকৌশলী লিয়াকত আলী। মাঝখানের প্রকল্প পরিচালক লিয়াকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, নানা কারণে জটিলতা ছিল। এখন সব জটিলতা কেটে গেছে। আগামী এক বছরের মধ্যেই শেষ করা যাবে। তবে কিছু অংশ যেমন আমার অধীনস্ত হাউসবিল্ডিং থেকে চেরাগআলী চার কিলোমিটার আগামী এপ্রিলের মধ্যেই শেষ করে যাতায়াতযোগ্য করা যাবে। এ ছাড়া গড়পড়তা সব অংশেরই প্রায় ৬০ ভাগেরও বেশি পাইলিং শেষ হয়ে গেছে। কঠিন জটিল ও সময় সাপেক্ষের কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন শুধু স্প্যান ও গার্ডার বসানোর কাজ চলছে দ্রæত গতিতে।

বাকি অংশের পরিচালক ইলিয়াস শাহ জানান, গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত সবটাই হবে চার লেনের রাস্তা। পাশে থাকবে পৃৃথক পৃথক আরও দুটি সার্ভিস লেন। এর মাঝখানে শুধু আব্দুল্লাহপুর থেকে চেরাগআলী পর্যন্ত থাকবে চার কিলোমিটার ফ্লাইওভার। যা অনেকটাই এগিয়ে আছে। এ ছাড়া গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ছোট ছোট ৭টি ফ্লাইওভার থাকবে। এগুলো হচ্ছে গাজীপুর চৌরাস্তা, ভোগড়া, টঙ্গী, বাইপাস, জসীমউদ্দীন ও এযারপোর্ট। বর্তমানে এই ফ্লাইওভারগুলোর কাজই চলছে। রাস্তার কাজ প্রায় শেষের পর্যায়ে। বলতে পারেন গোটা প্রকল্পের ৬০ শতাংশেরও বেশি কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে।

প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, সর্বশেষ চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৫৩ শতাংশ। প্রকল্পের মোট ১ হাজার ৯০৬টি সার্ভিস পাইলের মধ্যে ১ হাজার ৩৩৩টির নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। ২৮৯টির মধ্যে ১৭২টি পাইল ক্যাপ, ২৮৯টির মধ্যে ১৭০টি পিয়ার স্টিম এবং ১২৮৭টির মধ্যে ৪৮৩টি আই গার্ডার নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। টঙ্গী সেতুর পর থেকে চেরাগআলী পর্যন্ত মূল সড়কের দুই পাশে ড্রেনেজ কাজের ৬ হাজার ৩২৭ মিটারের ৬ হাজার ১৭০ মিটার অংশে আরসিসি পাইপ স্থাপন করা হয়েছে এবং অন্য কাজ চলমান আছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২০১৭ সালের এপ্রিলে চীনের ঠিকাদারি কোম্পানি জেটিইজি সঠিক সময়ে কাজই শুরু করতে পারেনি। প্রকল্প এলাকায় বিশালাকৃতি ক্রেন, ড্রেজার, ডিগারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি আনতেই দীর্ঘ সময় লেগেছে। তারপর পাইলিং করতে গিয়ে ভ‚গর্ভস্থ গ্যাস লাইন কেটে যাওয়া সংক্রান্ত একাধিক দুর্ঘটনা এবং অন্যান্য জটিলতায় বার বার সময় পেছানো হয়েছে। সর্বশেষ বিমানবন্দর পয়েন্টে প্রধান ক্রেনটি ভেঙ্গে পড়ায় আরও বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। এছাড়াও ঠিকাদারি কোম্পানির অর্থছাড়ের দীর্ঘসূত্রতাও অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা যায়, গোলচক্করের ওই রাস্তাটুকু শুধু ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কই নয়, চারদিকে রাস্তা বহমান। পূর্ব দিকে আশকোনা, দক্ষিণপূর্ব দিকে কাওলা, উত্তরপূর্ব দিকে মোল্লারটেক প্রেমবাগান, পশ্চিম দিকে এয়ারপোর্ট ও বলাকা। এছাড়াও রয়েছে ডজনখানেক দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। রেললাইনের পূর্ব দিকে র‌্যাব সদর দফতরের নির্মাণাধীন ভবন, হজ ক্যাম্প, বঙ্গবন্ধু ইউনিভার্সিটি, বেগম ফজিলাতুন্নেছা কলেজ ও স্কুল, আনসার অফিস, থার্ড টার্মিনালের প্রজেক্ট অফিস, এপিবিনএ সদর দফতর, সিভিল এভিয়েশন ভবন, র‌্যাব-১ অফিস, বিমানবন্দর থানা, বিমানবন্দর ও বিমানের সদর দফতর বলাকা ভবন। মহাসড়কের যানবাহন ছাড়াও এসব প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে লাখ খানেক লোককে কর্মস্থলে যাতায়াতের জন্য এই গোলচক্কর ক্রস করতে হয়। ভোগান্তি যে শুধু মহাসড়ক পারাপারকারী যানবাহন ও যাত্রীদের তা নয়, এসব অফিসগামীরাই বেশি দুর্দশায় পড়েছে। বিদেশী যাত্রীরা ঢাকা নেমেই দেখতে পায় এমন দৃশ্য।

এযারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত নেয়া প্রকল্পটির নাম বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)। অফিসিয়াল নাম, ‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট’। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে গাজীপুরের জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনে পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ২০ মিনিট। যেখানে বর্তমানে যানজটে পড়লে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যায়। গাজীপুর ঢাকার মধ্যে অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করার জন্যই নেয়া হয়েছে প্রকল্পটি। যাতে রাজধানীতে মানুষের চাপ কমে।

আালোচিত প্রকল্পটি অনুমোদিত হয় ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে। এর সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদিত হয় ২০১৮ সালের নবেম্বর মাসে। সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। প্রকল্পের অধীনে মোট ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার বিআরটি লেন বাস্তবায়নে তিনটি প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত। এর মধ্যে ১৬ কিলোমিটার এ্যাট গ্রেড সড়ক নির্মাণের দায়িত্বে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, সাড়ে ৪ কিলোমিটার এলিভেটেড অংশ নির্মাণের দায়িত্বে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং বাস ডিপো। সংযোগ সডক ও হাটবাজার নির্মাণের দায়িত্বে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএমইসি ইন্টারন্যাল প্রাইভেট লিমিটেড ২০১৫ সালে এলিভেটেড অংশের ডিজাইন সম্পন্ন করার পর আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে জিংসু প্রভিনশিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রæপ লিমিটেডকে ২০১৭ সালের অক্টোবরে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার এলিভেটেড অংশে এবং ৮টি র‌্যাম্পে মোট ১৬৩টি স্প্যান রয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যে ৭৮টি স্প্যানে আই গর্ভার এবং ৮৫টি স্প্যান বক্স গার্ডার নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে।

জানা গেছে, প্রকল্পের নক্সা ছিল বক্স গার্ডারের মাধ্যমে উড়াল সেতু নির্মাণ। এখন নক্সা পরিবর্তন করা হয়েছে। এলিভেটেড অংশের নির্মাণ কার্যক্রমে বক্স গার্ডারের পরিবর্তে আই গার্ডার পদ্ধতি অনুসরণের প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে। এতে ৪২ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ অংশের মধ্যে উত্তরা হাউসবিল্ডিং থেকে টঙ্গী চেরাগআলী মার্কেট পর্যন্ত ৬ লেন বিশিষ্ট এলিভেটেড সেতু নির্মাণ করা হবে। এই অংশে ছয়টি এলিভেটেড স্টেশন, ১০ লেন বিশিষ্ট টঙ্গী সেতুও নির্মাণ করা হবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ অংশের প্রকল্প পরিচালক লিয়াকত আলী বলেন, প্রকল্পের মূল নক্সা পরিবর্তন করা হয়েছে। নক্সা পরিবর্তন করে বক্স গার্ডারের পরিবর্তে এখন আই গার্ডারে হবে উড়াল সেতু। এর ফলে ৪১ কোটি টাকা সাশ্রয়ও হবে। আমরা ইতোমধ্যেই আই গার্ডারের কাজ শুরু করে দিয়েছি। বক্স গার্ডার ঝুলিয়ে রাখতে হবে। ন্যারো রোডে এটা কঠিন। এটা ঝুলিয়ে রাখা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা কোন ঝুঁকি নিতে চায় না। এজন্য নতুন করে নক্সা পরিবর্তন করা হয়েছে। বক্স গার্ডার দিলে সড়কের নিচের অংশ বন্ধও হবে। একইসঙ্গে এর আওতায় বিমানবন্দরের সামনে নির্মাণ করা হচ্ছে আধুনিক আন্ডারপাস। আশকোনা ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে এই আন্ডারপাস নির্মাণ হবে।

টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কটি অত্যন্ত ব্যস্ত করিডোর। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে এই করিডোরের মাধ্যমে ২১টি জেলা শহর যুক্ত রয়েছে। ২০১৪ সালের সার্ভে অনুযায়ী প্রতিদিন উভয় দিকে যানবাহন চলাচলের সংখ্যা ছিল ৩৬ হাজার থেকে ৪৪ হাজার যা ৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ হাজারে।

আপনি এগুলোও দেখতে পারেন

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.