জনপ্রিয় হচ্ছে সুখি পরিবার কল সেন্টার ১৬৭৬৭
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : পরিবার পরিকল্পনা মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা করোনার মধ্যে বলতে না পারাদের সহজ সমাধান, অপরিকল্পিত জন্ম নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক পরিবার পরিকল্পনার তথ্য ও স
জনসংখ্যা ও দারিদ্র্য। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময় দেশের প্রধান সমস্যা ছিল এই দুটি। গত ৫০ বছরে এ দুটি ক্ষেত্রেই সাফল্য দেখিয়েছে। আর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সাফল্যে বিশ্বের রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। বর্তমানে একজন মা গড়ে দুটি সন্তানের জন্ম দেন। অথচ ৫০ বছর আগে মায়েরা গড়ে ছয়টি সন্তানের জন্ম দিতেন। সন্তান জন্ম দেয়ার হার কমে যাওয়ায় আগের মত নারীরা পরিবার ও সমাজে অবহেলতি নয়; নারীরা শিক্ষার সুযোগ বেশি পাচ্ছে, উপার্জনে বেশি সময় দিতে পারছে।
অথচ ১৯৭০ এবং ৮০ এর দশকে দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বিবাহিত নারীদের সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলা খুবই দুরুহ কাজ ছিল। ওই সময়ে সরকার মুসলিম-হিন্দুসহ অন্য ধর্মের নেতাদেরও পরিবার পরিকল্পনার শিক্ষা দেয়া শুরু করে। এক পর্যায়ে সবাই ছোট পরিবারের ভালো দিকগুলো বুঝতে শুরু করে। পাশাপাশি দেশে শিক্ষার প্রসারও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
তবে এখন এ অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। আর গত কয়েক বছর থেকে পরিবার পরিকল্পনা সেবাকে আরও সহজ করে দিয়েছে ‘সুখি পরিবার কল সেন্টার ১৬৭৬৭’। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই কল করে সেবা নিচ্ছেন পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিতে আগ্রহীরা। যদিও মহামারি করোনার মধ্যে এই কল সেন্টার সেবা প্রতিদিনই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর কোনো দেশ এমন সাফল্য দেখাতে পারেনি। তারা বলছেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নানা পদ্ধতিতে ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ’ পদ্ধতি ব্যবহারে নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করতে বাংলাদেশ যেভাবে প্রচারণা চালিয়েছে বিশ্বের কোনো দেশই সেভাবে চালাতে পারেনি। ফলে সাফল্য এসেছে এই ধারায়। বিশ্বের অনেক দেশই এখন বাংলাদেশকে অনুসরণ করছে।
সন্ধ্যা ৬টা, সুখী পরিবার কল সেন্টারে কল করেন ফরিদা আক্তার (ছদ্মনাম), বয়স ৩২ বছর। ফরিদা বিবাহিত, ৩ সন্তানের মা। তিনি বর্তমানে নতুন করে সন্তান নিতে চাইছেন না। কিন্তু তার স্বামী তাকে বাধ্য করছেন সন্তান নিতে। আর এ অবস্থায় তিনি বিষয়টি লজ্জা মনে করে কারও কাছে বলতে পারছেন না। একইসঙ্গে কি করা উচিত তাও বুঝে উঠছেন না। এভাবে কয়েকদিন কাটার পর একদিন পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ের একজন স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে জানতে পারেন এ সমস্যার সহজ সমাধান ‘সুখী পরিবার কল সেন্টার ১৬৭৬৭’। এরপর থেকে ফরিদা প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক যে কোন সেবা নিতে সুখী পরিবার কল সেন্টারে কল করছেন। এখান থেকে সেবা পেয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ফরিদা।
কয়েক মাস হলো বিয়ে করেছেন সালমা আক্তার (ছদ্মনাম), বয়স ১৮ বছর। নববিবাহিত সালমার প্রথম সন্তান কবে নেয়া উচিত আবার প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তানের মধ্যে সময়ের পার্থক্য কত হওয়া উচিত সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা দরকার। বিষয়টি স্বামীর সঙ্গে আলাপ করলে তিনি স্ত্রীকে ‘সুখি পরিবার কল সেন্টার ১৬৭৬৭’-এ ফোন দেয়ার কথা বলেন। আর এখান থেকেই সহজ সমাধান পেয়ে যান সালমা। কল সেন্টারের মাধ্যমে জানতে পারেনÑ ২০ বছরের আগে নারীর শারীরিক বৃদ্ধি সম্পূর্ণ হয় না। এর আগে সন্তান নিলে বাচ্চার নানা ধরণের অপুষ্টিজনিত রোগ ও সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেক সময় গর্ভপাত হতে পারে। বাচ্চার শরীরের গঠন ঠিকমতো হয় না। পাশাপাশি দুই সন্তান নেয়ার ক্ষেত্রে দুই থেকে তিন বছর পার্থক্য রাখা, যা মায়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য দরকার। দ্রুত এসব সেবা পেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানান সালমা।
সূত্র মতে, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে মোট প্রজনন হার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। আর প্রজননক্ষম নারীর সারা জীবনে (সাধারণত ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়স পর্যন্ত) সন্তান জন্ম দেয়ার সংখ্যাই মোট প্রজনন হার। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৯। অর্থাৎ ওই সময় বাংলাদেশের একজন মা গড়ে প্রায় সাতটি সন্তানের জন্ম দিতেন। ১৯৮১ সালে এটি কমে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ২-এ। এরপর তা আরও কমতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে মোট প্রজনন হার ২। যদিও সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ বলছে, এ হার এখন ২ দশমিক ৩।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর জানায়, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীরা দেশের সকল ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছে। পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি পরিবারকেও আগলে রাখছে। আর্থিক মূল্যহীন শ্রমে পরিবারের মানুষকে ভালো রাখতে গিয়ে নিজেদের বেলায় নারীরা থাকছে উদাসীন। পেশাগত জীবন ও পরিবার সামলাতে গিয়ে নারীরা ভোগেন নানা রকম শারীরিক-মানসিক সমস্যায়। নারীর এ সমস্যা থেকে কাটিয়ে ওঠার পথে বাধা লোকলজ্জা, কুসংস্কার ও পরিবারের অবহেলা। আর এ থেকে উত্তরণে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিকল্পিত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে চালু করেছে ‘সুখি পরিবার কল সেন্টার ১৬৭৬৭’। এর মাধ্যমে শুধু ফরিদা বা সালমাই নয়; প্রজনন ও স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভোগা নারীদের যে কোন সমস্যার সমাধানের নাম এই কল সেন্টার। করোনার মধ্যে স্বাস্থ্যবিধির ঝামেলা এড়াতে এই সেবার প্রতি মানুষের আগ্রহ প্রতিদিনই বাড়ছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের তথ্য মতে, দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা ১৬৭৬৭ নম্বরে কল করে ঘরে বসেই যে কেউ নিতে পারবে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কিত তথ্য, মাসিক সংক্রান্ত জটিলতা ও মাসিক নিয়মিতকরণ সেবা, গর্ভকালীন ও গর্ভপরবর্তী প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা, নবজাতক-শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সকল তথ্য ও সেবা এবং রেফারেল সেবা। তথ্য মতে, প্রতিদিনই কল সেন্টারের মাধ্যমেসেবা গ্রহীতার সংখ্যা। গত ১ নভেম্বর থেকে গত ৩১ মে পর্যন্ত ৭ মাসে ১৬৭৬৭ নম্বরে কল করে ২৭ হাজার ২৬৮ জন এই সেবা গ্রহণ করেছেন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের আইইএম ইউনিটের উপ-পরিচালক (পিএম) আব্দুল লতিফ মোল্লা ইনকিলাবকে বলেন, পরিবার পরিকল্পনা মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় সুখি পরিবার কল সেন্টারের প্রতি দিন দিন আগ্রহ ও সেবা গ্রহীতাদের কলের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে নারীর এই পথ চলায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে পাশে আছে সুখি পরিবার কল সেন্টার ১৬৭৬৭।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের এমসিএইচ-সার্ভিসেস ও লাইন ডিরেক্টর এমসি-আরএএইচের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ শরীফ জানান, সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত একটি মানবাধিকার। প্রতিটি পরিবার পরিকল্পিত হোক, সব দম্পতি যেন স্বাধীনভাবে সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাদের ওপর যেন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া না হয়Ñ সেটা তথ্য ও সেবা দিয়ে নিশ্চিত করা হচ্ছে।
পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫৫ লাখ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার (১ দশমিক ৩৭ শতাংশ)। এই হারে বৃদ্ধি পেলে আগামী ৫০ বছরে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুন হবে। আর তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে দেশের সকল জনগনের জন্য পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক তথ্য ও সেবা সুনিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের জুলাই থেকে সুখি পরিবার কল সেন্টার ১৬৭৬৭ চালু করেছে। বর্তমান করোনায় গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়ের সেবা কার্যক্রমে কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে। এই সময়ে যা নারীর প্রজনন ও পরিকল্পিত স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। একইসঙ্গে এটি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আগামীতে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিবে।
সাহান আরা বানু বলেন, আগামীতে এসডিজি অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে অধিদফতর পরিবার পরিকল্পনার তথ্য ও সেবার অপূর্ণ চাহিদার হার শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় সুখি পরিবার কল সেন্টার ১৬৭৬৭ যে সেবা দিচ্ছে এটি সবাইকে জানাতে আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। সারা বাংলাদেশে আমাদের যত মাঠকর্মী রয়েছে তাদের কাছে আমরা এই তথ্যটি পৌঁছে দিচ্ছি যেন তারাও সবাইকে এ ব্যপারে জানাতে পারেন। এ ছাড়া বিভিন্নভাবে কল সেন্টারের প্রচারণা কার্যক্রম চালাচ্ছি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত একটি মানবাধিকার। প্রতিটি পরিবার পরিকল্পিত হোক, সকল দম্পতি যেন স্বাধীনভাবে সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাদের ওপর যেন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া না হয়- সেটা তথ্য ও সেবা দিয়ে নিশ্চিত করা হচ্ছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অনেক অর্জন থাকলেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যা মোকাবিলায় অপারেশনাল প্ল্যান অনুযায়ী কাজ চলছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ইনকিলাবকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ আলোকিত। সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন সংযোজন ‘সুখি পরিবার কল সেন্টার’। যা প্রজনন ও পরিকল্পিত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখছে।
তিনি বলেন, কল সেন্টার চালু পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। যা করোনায় বিপর্যস্ত জনজীবনে ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে এ সময় নারীরা ঘর থেকে বের হতে পারছে না। ঘরে বসে কল সেন্টারের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য ও পরামর্শ পাচ্ছে। এককথায় করোনার মধ্যে বলতে না পারাদের সহজ সমাধান, অপরিকল্পিত জন্ম নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছে। জাহিদ মালেক বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও মন্ত্রীরা বাংলাদেশের সাফল্যকে উপস্থাপন করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এখান থেকে শিক্ষা নেয়ার কথা বলছেন।