কঠিন সময়েও ব্যাংকে মুনাফায় জোয়ার
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : ২০২০ সালে চাপে থাকা মার্কেন্টাইল ব্যাংক চলতি বছরের ছয় মাসে কেবল ঘুরে দাঁড়িয়েছে এমন নয়, প্রায় দেড় গুণ আয় করেছে। শতকরা হিসেবে আয়ে প্রবৃদ্ধি আরও বেশি গত কয়েক বছর ধরেই ক্রমাগত ভালো করতে থাকা প্রিমিয়ার ব্যাংক।
করোনা মহামারির দ্বিতীয় বছর চলাকালে চাপের মধ্যেও ব্যাংকগুলো এই দুটি ব্যাংকের মতোই ভালো করছে। বছরের প্রথম ছয় মাসে এখন পর্যন্ত যে হিসাব পাওয়া গেছে, তাতে বেশিরভাগ ব্যাংক গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ভালো আয় করেছে।
এই চমক অবশ্য গত বছর করোনাকালেও দেখা গেছে। ২০২০ সালের মার্চে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার পর সাধারণ ছুটিতে ৬৬ দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যাওয়ার পর ব্যাংকগুলোর আয়ে ধস নামে কি না, তা নিয়ে কথা উঠে।
তবে শেষ পর্যন্ত মহামারির বছরে আগের বছরের চেয়ে বেশি আয় করে চমক দেখায় ব্যাংকিং খাত। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো এবার বিনিয়োগকারীদেরকে লভ্যাংশ দিয়েছে অনেকটাই আশাতীত। চলতি বছর পুঁজিবাজারে প্রথম প্রান্তিকের যে ঘোষণা এসেছে, সেখানেও দেখা গেছে, বেশিরভাগ ব্যাংকের আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে।
দ্বিতীয় প্রান্তিক শেষ হয়েছে গত ৩০ জুন। এর হিসাব এখনও প্রকাশ করেনি ব্যাংকগুলো। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তগুলো এই হিসাব প্রকাশ করার জন্য ৩০ কার্যদিবস সময় নেবে। তবে ব্যাংকগুলো জুন ক্লোজিং শেষে অনিরীক্ষিত যে হিসাব বিবরণী প্রস্তুত করেছে, তা থেকে কিছু তথ্য সব সময়ই পাওয়া যায়।
নিউজবাংলা ১৯টি ব্যাংকের অর্ধবার্ষিকী মুনাফার হিসাব পেয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত, আর একটি তালিকাভুক্ত হয়নি এখনও। আর একটি বিদেশি ব্যাংক। এই ১৬টি ব্যাংকের সবগুলোই এবার গত বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি আয় করেছে।
শতকরা হিসেবে আয়ের প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে অতালিকাভুক্ত মেঘনা ব্যাংক। এই ব্যাংকটি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ছয় গুণ মুনাফা করেছে। আর মুনাফায় প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কম হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ কোটি টাকা বেশি আয় করেছে তারা। আর টাকার অংকে সবচেয়ে বেশি আয় করেছে তারাই। এক হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিচালন মুনাফা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যে মুনাফা থাকে, সেটিই কোনো ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। পরিচালন মুনাফা কোনো ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। এ মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করতে হয়।
প্রভিশন ও কর-পরবর্তী এ মুনাফাই হলো একটি ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা। বছর শেষে ব্যাংকারদের দেয়া ইনসেনটিভ বোনাসও কিছু ব্যাংক পরিচালন মুনাফার মধ্যে হিসাব করে থাকে।
কোন ব্যাংকের কত মুনাফা : মেঘনা ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৭০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল মাত্র ১২ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৮৩ শতাংশ। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ১৫০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ৯১ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ৬৪.৮৩ শতাংশ।
প্রিমিয়ার ব্যাংক জুন শেষে পরিচালন মুনাফা করেছে ৩০০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ১৮৬ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ৬১.২৯ শতাংশ। মার্কেন্টাইল ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৩৫৮ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ২৪৩ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ৪৭.৩২ শতাংশ।
সাউথইস্ট ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৪৮২ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ৩৪২ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ৪০.৯৩ শতাংশ। ব্যাংক এশিয়া গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৪৮৪ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ৩৫১ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ৩৭.৮৯ শতাংশ। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ২২৫ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ১৭৫ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ২৮.৫৭ শতাংশ।
পূবালী ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৫০৫ কোটি টাকা। গত বছর একই সময় যা ছিল ৪০০ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৬.২৫ টাকা।
ডাচ বাংলা ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৫০৪ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ৪১৭ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ২০.৮৬ শতাংশ। ঢাকা ব্যাংক বছরের ছয় মাসে মুনাফা করেছে ৩০৩ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ২৬৩ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ১৫.২০ শতাংশ। যমুনা ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৩০১ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ২৬২ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ১৪.৮৮ শতাংশ।
সাউথবাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৮০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ৭০ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ১৪.২৮ শতাংশ। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ২৮০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ২৪৭ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ১৩.৩৬ শতাংশ।
এনসিসি ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৩১৫ কোটি টাকা যা গত বছর একই সময় ছিল ২৯০ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ৮.৬২ শতাংশ। এক্সিম ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৩৪০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ৩১৭ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ৭.২৫ শতাংশ।
মধুমতি ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ১২৭ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ১২৪ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ২.৪১ শতাংশ। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৩১০ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা করেছিল ৩০৫ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ১.৬৩ শতাংশ।
বরাবরের মতো ব্যাংকগুলোর মধ্যে মুনাফার শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে ইসলামী ব্যাংক। গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ১০২০ কোটি টাকা। ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছিল ১০০৭ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ১.২৯ শতাংশ। বাংলাদেশে কার্যক্রম চালানো পাকিস্তানি ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক অফ পাকিস্তানও দেখিয়েছে চমক। তারা অর্ধবার্ষিক হিসাবে মুনাফা করেছে ২১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। গত বছর এই সময় লোকসান ছিল ২২ কোটি টাকা
ব্যাংকাররা যা বলছেন : কঠিন পরিস্থিতিতেও ব্যাংকিং খাত কীভাবে ভালো করছে তার কারণ জানিয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ নেই, ঋণ বিতরণ কমে গেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধে জুন পর্যন্ত ছাড় দেয়া হয়েছে। এর ফলে প্রভিশনিংয়ে ব্যাংকগুলো কিছুটা ছাড় পেয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের আয়ে।’
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আরফান আলী বলেন, ‘ব্যাংকের ব্যবসা যে ভালো হচ্ছে, এ রকম না। ডিপোজিট এখন পর্যাপ্ত রয়েছে। কম রেটেও পাওয়া যাচ্ছে। ফিক্সড ডিপোজিটে ইন্টারেস্ট রেট লো। করোনার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া সুবিধার কারণে ব্যাংকগুলো বাড়তি প্রভিশনিং (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) করে নাই। এ কারণে মুনাফা বাড়তি দেখাতে পেরেছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মূল কারণ হলো আমানতে সুদহার অনেক কম। ঋণ বিতরণ একদম হচ্ছে না, সেটা নয়। যাতায়াত ভাতা, আনুষঙ্গিক খরচ, বিভিন্ন অনুষ্ঠান এগুলো কমিয়েছে। তবে ব্যাংকের ব্যয় যে খুব কমেছে, সেটা নয়।’