দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দেশ স্বাধীনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মাত্র সাড়ে ৩ বছর পেয়েছিল বাংলাদেশ। এই কম সময়ের শাসনামলেই প্রায় শূন্য অর্থনীতির দেশকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে যান বঙ্গবন্ধু। দেশের মানুষ যাতে আর কোন দিন অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার না হয়, গ্রামপ্রধান-কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের মেহনতি মানুষ যাতে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে সেজন্য তিনি সংবিধান রচনা করান চারটি মূল নীতির ভিত্তিতে। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও তিনি প্রাধান্য দেন সুষম একটি অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। দারিদ্র্য জয় করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের রফতানি আয় গত অর্থবছর শেষে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এই মুহূর্তে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ। শুধু রফতানি কিংবা জিডিপি নয়, দেশের বাজেটের আকার, সরকারী-বেসরকারী বিনিয়োগ, রাজস্ব আয়, রেমিটেন্স আহরণ, দারিদ্র্য নিরসন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো তৈরি ও উন্নয়ন, বিদ্যুত উৎপাদন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসেছে সফলতা। বাংলাদেশের অর্থনীতির এমন অর্জনকে বিস্ময়কর বলেছেন পৃথিবী বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশের এ উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে এসেছে বিশ্বস্বীকৃতিও।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন ফিরলেন তখন বাংলাদেশের সম্পদ বলতে অবশিষ্ট কেবল তার জন্য বাঙালীর ভালবাসা। পাকিস্তানীরা বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাসহ এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কাঠামো এমনভাবে ধ্বংস করে গিয়েছিল যাতে বাঙালী আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। এমনই অবস্থায় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু। পরে ১২ জানুয়ারি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ। এর আগে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৪৬৯ জন সদস্যের মধ্যে ৪০৩ জনকে নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। ৭২ সালের ৪ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে। বৈঠকে দেশের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় করণীয় নিয়ে দিক-নির্দেশনা দেন বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রাথমিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে ভারতের কাছ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা পাওয়া যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্য বন্ধুরাষ্ট্রও বাংলাদেশের জন্য সহায়তার হাত প্রশস্ত করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত রাস্তাঘাট মেরামত শুরু হয়, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা খুলে দেয়া হয়, স্বাভাবিক হতে শুরু করে পরিস্থিতি। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বে সঙ্কট কাটিয়ে ওঠে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার চার দশক পর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অর্জনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। আর এ স্বপ্ন পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে রফতানি খাত। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের রফতানি খাত কাঁচা চামড়া ও পাটনির্ভর হলেও সময়ের আবর্তনে সে তালিকায় যুক্ত হয়েছে তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণসহ হাল্কা ও মাঝারি শিল্পের নানা পণ্য। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের রফতানি আয় গত অর্থবছর শেষে প্রায় ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, ‘মাথাপিছু কম জমি নিয়ে আর কোন দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে এমন ইতিহাস করেনি। আমাদের বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে ক্রমাগতভাবে বেশি করে সংযুক্ত হতে হবে। যে শিল্প পণ্যগুলো বহুমুখী করে রফতানি করব, সেগুলোর কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমাদের আমদানি করতে হবে, এটাই এখন চ্যালেঞ্জ।’ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার দৌড়ে নতুন বাজার বাড়ানোর পাশাপাশি আগামী দিনের রফতানি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আজকের অর্থনীতির যতটুকু উন্নয়ন, তার ভিত রচনা করে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিশেষ করে কৃষিতে ব্যাপক রূপান্তর ঘটাতে চেয়েছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পরে যখন কোষাগার ছিল শূন্য, কৃষিতে ছিল নাজুক অবস্থা; সে সময়েই কৃষকের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা থেকে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন কৃষি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি \ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুরু হয়েছিল ঋণাত্মক দিয়ে। ওই সময় দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাইনাস ১৩.৯৭ শতাংশ। মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২.১৭ ভাগ। আর ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৭৫ ভাগ। সম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশে।
মাথাপিছু আয় \ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল মাত্র ১২৯ মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার। আর সে হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ১৮ গুণ বেড়েছে।
রিজার্ভ \ ১৯৭৩ সালে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৭৩ মিলিয়ন ডলার বা ১৭ কোটি ৩ লাখ ডলার। বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার, যা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসেবে এই রিজার্ভ দিয়ে প্রায় সাড়ে ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
বাজেট \ ১৯৭১ সালে মাত্র ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। এর পরের বছর প্রথম ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমদ। পরের দুটি বাজেটও দিয়েছিলেন তিনি। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। সে হিসেবে দেশের ৫০তম বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ৭৬৮ গুণের বেশি।
রেমিটেন্স \ স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় ছিল ১৬.৩৫ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে দেশে রেমিটেন্স এসেছে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন) ডলার, টাকার অংকে যা ২ লাখ ১০ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এই রেমিটেন্স ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। এর আগে এক অর্থবছরে এত রেমিটেন্স কখনই আসেনি।
বিনিয়োগ \ স্বাধীনতার পর শুরুর দিকে বিদেশী বিনিয়োগ কেবল সরকারী খাতের জন্যই প্রযোজ্য ছিল। স্বাধীনতার পর পাট ও বস্ত্রকলের মতো বৃহৎ শিল্পগুলো ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা হয়। বিশ্বব্যাপী পাটের তৈরি দ্রব্যাদির বিকল্প সিনথেটিক ব্যবহার জনপ্রিয় হওয়ায় বড় বড় শিল্পগুলো অলাভজনক হয়ে পড়ে। এরপর বিকল্প হিসেবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। ক্রমান্বয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস তথা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদিও এসএমই’র মাধ্যমে উৎপাদিত হতে থাকে। এরপর যাত্রা শুরু করে পোশাক শিল্পের। দেশী বিনিয়োগের পাশাপাশি বাড়তে থাকে বিদেশী বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরের বিভিন্ন খাতে সব মিলিয়ে ৩৫০ কোটি ১০ লাখ ডলার বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে।