আন্তর্জাতিক রূপ পাবে কক্সবাজার বিমানবন্দর
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপর থেকে সমুদ্রের নীলাভ জলরাশি ভেদ করে রানওয়ে স্পর্শ করার পরও মনে হবে এটি জলেই অবতরণ করেছে। ককপিটে বসে পাইলট আর জানালার পাশে বসা যাত্রীদের মনে এমনটিই অনুভূত হবে। বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি বিমানবন্দরের মতোই এমন এক অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন রানওয়ে তৈরি করা হচ্ছে কক্সবাজারে। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আজ প্রধানমন্ত্রী শুভ উদ্বোধন করবেন কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের। আজ রবিবার সকাল দশটায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে এ কাজের আনুষ্ঠানিক যাত্রার শুভ উদ্বোধন করবেন।
এ উপলক্ষে কক্সবাজার বিমানবন্দরে তৈরি করা হয়েছে শতাধিক অতিথির সুসজ্জিত প্যান্ডেল। এখানে উপস্থিত থাকবেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট মাহবুব আলী এমপি, সচিব মোকাম্মেল হোসেন ও বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান। আরও থাকছেন দেশী-বিদেশী বিমানবন্দর বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, নির্মাতা ও গণমাধ্যমকর্মী।
সমুদ্রের জলরাশি ভেদ করে রানওয়ে নির্মাণশৈলী এ অঞ্চলে এটিই প্রথম। গোটা বিশ্বে হাতেগোনা এ ধরনের রানওয়ে রয়েছে। মালদ্বীপ, কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুরের রানওয়ের চেয়েও দীর্ঘ হবে কক্সবাজারের এ প্রকল্প। পৃথিবীর উপকূলীয় শহরে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে এই বিমানবন্দর। সত্যিকার অর্থে কক্সবাজারকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম হাব হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই নির্মাণ করা হচ্ছে অত্যাধুনিক এই বিমানবন্দর। প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী এমপি জানিয়েছেন-এই বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে এখানে পর্যটন নগরী হিসেবে মাস্টার প্ল্যানে নেয়া হচ্ছে নৈসর্গিক সব স্থাপনা। অত্যাধুনিক স্থাপত্যরীতিতে এখানে তৈরি করা হবে ক্যাবলকার, সি মিউজিয়াম, ব্লু জোন, রেড পার্ক, প্যারাসুটিং হাইপার্ক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সব স্থাপনা।
বিনোদনের জন্য থাকবে বিশ্বমানের শীর্ষ ইভেন্টগুলো। এজন্য ইতোমধ্যে কয়েকটি বিদেশী কোম্পানি বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা সবগুলোই স্টাডি করছি। তিনি জানান, মূলত দেশী-বিদেশী পর্যটকরা যাতে সরাসরি ফ্লাইটে আসতে পরেন সেজন্যই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপ দেয়া হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই বিমানবন্দরে নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, রানওয়ে সম্প্রসারণ ও শক্তি বৃদ্ধি, এয়ারফিল্ড গ্রাউন্ড লাইটিং সিস্টেম স্থাপনসহ অন্যান্য কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বহুল প্রতীক্ষিত এ প্রকল্পের কাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণের সম্মতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ৩৩ মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার টার্গেট রয়েছে।
এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান জানিয়েছেন, মূলত প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহেই কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ করা হয়। ইতোমধ্যে রানওয়ের দৈর্ঘ্য ৬৭৭৫ ফুট থেকে ৯ হাজার ফুট এবং প্রস্থ ১২০ ফুট থেকে ২০০ ফুটে উন্নীত করা হয়েছে। ২০১৭ সালে স¤প্রসারিত রানওয়েতে বিমানের বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। সে সময়ই এই বিমানবন্দরের রানওয়ে ৯ হাজার ফুট থেকে ১২ হাজার ফুটে উন্নীতকরণের নির্দেশ দেন তিনি। সেই নির্দেশনা মোতাবেক ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ‘কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে স¤প্রসারণ’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দরের রানওয়ে ৯ হাজার ফুট থেকে ১০৭০০ ফুটে উন্নীত হবে। এ ছাড়া প্রিসিশন এপ্রোচ ক্যাট-১ লাইটিং সিস্টেম স্থাপন করা হবে। ফলে উড়োজাহাজ পূর্ণ লোডে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারবে। যার কারণে বিমানবন্দরের ফ্লাইট সংখ্যার পাশাপাশি যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
জানা গেছে, বর্তমানে কক্সবাজার বিমানবন্দরে নয় হাজার ফুট দীর্ঘ একটি রানওয়ে রয়েছে। এটি ১০ হাজার ৭০০ ফুটে উন্নীত করার কাজ চলছে। এর মধ্যে এক হাজার ৩০০ ফুট থাকবে সমুদ্রের মধ্যে। কক্সবাজার বিমানবন্দরের মহেশখালী চ্যানেলের দিকে জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে স¤প্রসারিত হচ্ছে এই রানওয়ে। প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মালেক বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ বোয়িং-৭৭৭-৩০০ ইআর, ৭৪৭-৪০০ ও এয়ারবাসের ৩৮০-এর মতো উড়োজাহাজ সহজেই ওঠানামা করতে পারবে। প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ৫৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। যার পুরোটাই অর্থায়ন করছে বেবিচক। বর্তমান করোনা মহামারীতেও চলছে এখানে কর্মযজ্ঞ। মহেশখালী ও সোনাদিয়া দ্বীপের পাশেই সমুদ্রে বালি ভরাটের কাজ চলছে। বিমানবন্দরের ভেতরে টার্মিনাল ভবনটির কাজও দ্রুতগতিতে শেষ হচ্ছে। টার্মিনাল ভবনের অবকাঠামো ও ঢালাইয়ের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। শীঘ্রই শুরু হবে ফিনিশিংয়ের কাজ। এ প্রসঙ্গে বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মালেক বলেন, এটি আমাদের স্বপ্নের প্রকল্প। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা এ নিয়ে কাজ করছি। এখনও আমরা ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যাচ্ছি। নির্মাণ কাজে প্রায় তিন শতাধিক শ্রমিক যুক্ত। তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টা কাজ চলছে। থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থাই এখানে আছে। আশা করছি শীঘ্রই কাজ শেষ করতে পারব।
বেবিচক সূত্র জানায়, এই বিমানবন্দরের উন্নয়নকাজ দুই অংশে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশে আগের টার্মিনাল ভবনসহ কিছু মেরামতের কাজ হচ্ছে। এটি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দ্বিতীয় অংশে রয়েছে রানওয়ে সম্প্রসারণ, এয়ার ফিল্ড গ্রাউন্ড লাইটিং সিস্টেম ও ইনস্ট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম স্থাপন এবং নতুন টার্মিনাল ভবনের নির্মাণকাজ। এর মধ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজটি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে নির্দেশনা দিয়েছে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম. মফিদুর রহমান বলেন, কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে স¤প্রসারণ কাজ শেষ হলেই এখানে ওঠানামা করতে পারবে ৩৮০-এর মতো সুপরিসর উড়োজাহাজ। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, নভোএয়ার এবং কয়েকটি কার্গো প্রতিষ্ঠানের ছোট এয়ারক্রাফট এই বিমানবন্দরে ওঠানামা করে। ভবিষ্যতে কক্সবাজার সংলগ্ন মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো দেশের বড় বড় এয়ারলাইন্সের এয়ারক্রাফট এখানে অবতরণ করতে পারবে।
স্বপ্নের এ রানওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় বিশ্বের নামকরা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। চলতি বছরের ৯ ফেব্রæয়ারি বেবিচক সদরদফতরে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে চীনের চাংজিয়াং ইচাং ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ারিংব্যুরো (সিওয়াইডব্লিউসিবি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন- জেভি’র মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বেবিচক অনুমিত ব্যয়ের চেয়ে অন্তত ২১ শতাংশ কম দর প্রস্তাব করে প্রতিষ্ঠান দুটি। ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হয়। নির্মাণকাজের অনুমতি পাওয়া চীনের ওই দুই প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ‘বেজিং বিমানবন্দর’ নির্মাণের মতো অত্যাধুনিক বিমানবন্দর নির্মাণের অভিজ্ঞতা। এই বিমানবন্দরেও থাকবে সব ধরনের আধুনিকতার ছোঁয়া।