সংলাপ করবেন রাষ্ট্রপতি
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মেয়াদ আছে আর মাত্র চার মাস। এ সময়ের মধ্যেই নতুন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের কথা থাকলেও গত পাঁচ দশকে কোনো সরকারই সে পথে হাঁটেনি। সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপতি অতীতের মতো এবারও সংলাপের উদ্যোগ নিতে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। রাষ্ট্রপতি নির্দেশিত সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বিগত দুই কমিশন গঠন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় এবারও রাষ্ট্রপতি উদ্যোগ নেবেন বলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর আগে নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন দলের অংশগ্রহণে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
গতকাল রবিবার দুপুরে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, রাষ্ট্রপতি আগের মতো সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। কমিশন নিরপেক্ষ থাকলে নির্বাচনও নিরপেক্ষ হবে। তিনি আরও বলেন, আদালতের আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ২০১১ সালেই বিদায় নিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি এখন মিউজিয়ামে। এটা মীমাংসিত বিষয়। মীমাংসিত বিষয়ে নতুন করে বিতর্কের সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে একটি স্থায়ী সমাধান চাই। সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে
কমিশন গঠন প্রক্রিয়া ঠিক করতে হবে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে নিজের মতো করে কমিশন গঠন করলে একপক্ষীয় কমিশন হবে। জাতি হুদামার্কা কমিশন দেখতে চায় না। তিনি বলেন, নির্দলীয় সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের সব চিন্তাভাবনা। বাংলাদেশের মতো দেশে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিরপেক্ষ না হলে কোনো লাভ হবে না। সরকার তার আশীর্বাদপুষ্ট কমিশন গঠন করে জালিয়াতির নির্বাচনই করবে।
গয়েশ্বর আরও বলেন, রাষ্ট্রপতি সংলাপের উদ্যোগ নিলে দেখা যাবে তাতে যাব কিনা। যিনি নির্বাচন কমিশন গঠনের দায়িত্বে তিনি (রাষ্ট্রপতি) এখনো কোনো উদ্যোগ নেননি। অথচ যার দায়িত্ব নেই তিনি কথা বলছেন; এ বিষয়টি তো অ™ভুত।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদের উপনেতা জিএম কাদের বলেন, নির্বাচন কমিশন যতই ভালো লোক বা নিরপেক্ষ লোক দিয়ে গঠন হোক না কেন, নির্বাচন করতে গিয়ে সরকারের পরিপূর্ণ সহযোগিতা না পেলে তাদের করার তেমন কিছু থাকে না। সে ক্ষেত্রে তাদের অপশন থাকে দুটি। একটি হলো সরকার সহযোগিতা করছে না বলে পদত্যাগ করে চলে যেতে হয়। অথবা সরকার যেমন করে চাচ্ছে সেভাবে চালাতে হয়। এ দুধরনের বাইরে কেউ সুষ্ঠু নির্বাচন করে ফেলবে- বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটা খুব একটা আশা করা যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি কী সিদ্ধান্ত নেবেন এটা তার এখতিয়ার। এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। এতটুকু বলতে পারি সংবিধান সামনে রেখে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে; এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক আমাদের সময়কে বলেন, অতীতের মতো সরকারের নির্ধারিত সার্চ কমিটি সরকারের ইচ্ছে অনুযায়ী নাম সিলেক্ট করবে। অতএব, এ লোক দেখানো প্রক্রিয়ায় সরকারের ইচ্ছামতো লোক দিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে।
ইসি গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা তিনি (রাষ্ট্রপতি) করতে পারেন না। এটা বেআইনি কাজ হবে। আইন না করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। একটি গ্রহণযোগ্য ইসি গঠনে আইন করার পরমর্শ দেন তিনি।
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়ে নির্বাচন কমিশন হবে। এ বিষয়ে প্রণীত আইনের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কমিশন নিয়োগ দেবেন। কিন্তু সংবিধানের আলোকে ওই আইন ৫ দশকেও না হওয়ায় প্রতিবারই নির্বাচন কমিশন গঠনে জটিলতা দেখা দেয়।
২০১২ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সার্চ কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান করে গঠিত চার সদস্যের ওই সার্চ কমিটি সিইসি পদের জন্য দুজন এবং নির্বাচন কমিশনার পদে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করেন। তাদের মধ্য থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক সচিব কাজী রকিবউদ্দীন আহমদকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ, জাবেদ আলী ও মো. শাহনেওয়াজকে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন জিল্লুর রহমান। একজন নির্বাচন কমিশনার পরে যোগদান করায় ওই কমিশনের মেয়াদের শেষ হয় ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। তার আগে ২০১৬ সালে একইভাবে সংলাপের আয়োজন করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। বিএনপির সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর সংলাপ শুরু হয়। এক মাসে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ মোট ৩১টি দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সংলাপ করেছেন রাষ্ট্রপতি। দলগুলোর পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়ন, ইসি গঠনে সার্চ কমিটি এবং দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে ইসি গঠনসহ বিভিন্ন পরামর্শ আসে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের শেষ দিনে (১৮ জানুয়ারি) বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) ও জাকের পার্টির সঙ্গে আলোচনা করেন মো. আবদুল হামিদ। বৈঠক শেষে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আলোচনায় রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সার্চ কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠনে অনেক সুচিন্তিত প্রস্তাব এবং মতামত দিয়েছেন। তিনি (রাষ্ট্রপতি) আশা প্রকাশ করেন, এসব প্রস্তাব ও মতামত বিবেচনা করে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব হবে।
সংলাপ শেষে ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি নতুন নির্বাচন কমিশনের সদস্য কারা হবেন তা খুঁজে বের করার জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছেন দেশটির রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। কমিটির সদস্যরা ছিলেন- তৎকালীন হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক, মহাহিসাব নিরীক্ষক মাসুদ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিরিন আখতার। এ কমিটিকে দশ কার্যদিবসের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের নাম সুপারিশ করতে বলা হয়।
বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি নিজেদের মধ্যে চার দফা বৈঠক ছাড়াও প্রথমে ১২ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং পরে আরও চারজনের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া ৩১টি দলের মধ্যে ২৬টি দলের কাছ থেকে পাঁচটি করে নাম জমা নেন তারা। বাকি দলগুলোর চারটি সার্চ কমিটিতে নাম দেয়নি আর একটি দল নির্ধারিত সময়ের পর নাম জমা দেওয়ায় তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পাওয়া ১৩০টি নামের মধ্য থেকে ২০টি নাম নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করে সার্চ কমিটি নিজেদের মধ্যে সর্বশেষ বৈঠকে বসে। ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সার্চ কমিটি তাদের প্রস্তাবিত ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে দেন। সেখান থেকেই রাষ্ট্রপতি সিইসি ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেন। ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কে এম নুরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশরা দায়িত্ব নেন। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি তাদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তাদের আগেই রাষ্ট্রপতি নতুন কমিশন গঠন করবেন, যাদের অধিনে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
জানা গেছে, বিগত সার্চ কমিটি গঠনের পরপরই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার মনোনয়নের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচটি নাম পাঠানোর আহ্বান জানানো হয়েছিল। সেই সঙ্গে সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সব মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবের নামের তালিকাও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে চেয়েছিল গতবারের সার্চ কমিটি। একইভাবে সুপ্রিমকোর্টের নিবন্ধককে অবসরপ্রাপ্ত জেলা বিচারকদের নামের তালিকা কমিটিতে পাঠানোর জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। এ ছাড়া সার্চ কমিটির সদস্যরা নিজ বিবেচনায় যোগ্য ব্যক্তিদের নাম সংগ্রহ করেন। সব নাম নিয়ে বৈঠকে বসে সার্চ কমিটি। তার পর তারা সুপারিশের তালিকা চূড়ান্ত করে। এবারও সে রকমই হবে বলে মনে করা হচ্ছে।