জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে ঈশ্বরদীর
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশদ্বার পদ্মা বিধৌত জনপথ ঈশ্বরদী ব্রিটিশ আমল থেকেই অনেক জেলার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। আগে বর্তমান সরকারের উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডে উন্নত ঈশ্বরদী হয়েছে আরও উন্নত। উন্নয়নের ছোঁয়ায় গ্রাম আর শহর একাকার হয়ে উঠেছে। তাই ঈশ্বরদীকে জেলা করনের পাশাপাশি পাকশীতে সিটি কর্পোরেশন করার দাবি ঘরে ঘরে জোরালো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের ক্ষমতাকালীন পাঁচ বছরের মধ্যে ঈশ্বরদীতে নির্মাণাধীন দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক প্রকল্প ঈশ্বরদীর রূপপুরে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি পরমাণু বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র্র, ঈশ্বরদী-ঢালারচর ৭৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন ও ঈশ্বরদী-রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ, ঈশ্বরদী উপজেলা প্রকৌশলী দফতরের মাধ্যমে এলজিইডির কার্পেটিং রাস্তা নির্মাণ, ব্রিজ নির্মাণ ও বিভিন্ন স্কুল ভবন নির্মাণে ব্যয় ১শ’ ১৬ কোটি টাকা ও পৌরসভার মাধ্যমে ঈশ্বরদী পৌর এলাকাতে রাস্তা, ড্রেন, পানির লাইনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে ১শ’ ২ কোটি টাকা মিলে ঈশ্বরদীতে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার ৩৪৫ কোটি ৯৯ দশমিক ২৭ লাখ টাকার উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের আনুমানিক শতকরা ৪৫ ভাগ ফিজিক্যাল অগ্রগতি হয়েছে।
সারা পৃথিবী এখন তাকিয়ে আছে ঈশ্বরদীর রূপপুরের দিকে। এখনও রূপপুর পরমাণু প্রকল্পের কাজ চলমান থাকা এবং অন্যান্য বিভাগের উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্ন হওয়ায় ঈশ^রদীসহ নিকটস্থ এলাকার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এমনকি অনেক মানুষের জীবনযাত্রার মানেরও পরিবর্তন হয়েছে। এ কারণে দেশ ও মানুষের উন্নয়নে বিশ্বাসী এসব এলাকার কিছু সচেতন মানুষ বর্তমান সরকারের দীর্ঘস্থায়ী শাসন ও প্রয়োজনীয় সকল অসমাপ্ত কাজের বাস্তবায়নেরও আশা করছেন। বিভিন্ন দায়িত্বশীল সূত্রের দেয়া তথ্যসূত্রে এসব জানা গেছে।
সূত্র মতে, ১৯৬১ থেকে ২০১৭ সালের ৩০ নবেম্বর। মাঝখানের সময়টি লম্বা ৫৬ বছরের। দীর্ঘ সময় একবার গ্রহণ একবার বাতিলের মধ্যে আটকে ছিল রূপপুর পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রের ভাগ্য। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৭৩-এ একবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর সেই স্বপ্ন হারিয়ে গিয়েছিল। ২০০৯ এ সরকার গঠনের পর আবার সেই স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে ২০১১ সালে চুক্তি করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে সই হলো ঋণ চুক্তি। গত ২০১৭ সালের ৩০ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরমাণু চুল্লির সিমেন্টিং কাজের উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ কাজের। দেশের ইতিহাসে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। বাংলাদেশ প্রবেশ করে পরমাণু বিদ্যুত উৎপাদনের যুগে। পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^ ৩২তম দেশ হিসেবে নিউক্লিয়ার ক্লাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদনে আসবে আগামী ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। আর দ্বিতীয় ইউনিট আসবে পরের বছর। এর আগে রূপপুরে আবাসন ছাড়াও অন্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রের অর্থায়নে, নির্মাণ এবং পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় রাশিয়া থাকবে বাংলাদেশের পাশেই। শুরুর দিকে পরমাণু বর্জ্য ফেরত নেয়া নিয়ে সংসয় থাকলেও পরবর্তীতে আরও একটি চুক্তি করা হয়। এই চুক্তিতে রাশিয়ায় বর্জ্য ফেরত এবং পরিশোধন করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এজন্য তাদের আলাদাভাবে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক প্রকল্প ঈশ^রদীর রূপপুরে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার নিকট থেকে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে।
রূপপুর পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রকে ঘিরে ঈশ্বরদীসহ নিকটস্থ এলাকায় ব্যবসাবাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। এমনকি মানুষের জীবন যাত্রার মানও বৃদ্ধি পেয়েছে। একই কারণে ঈশ্বরদী অনেক উন্নত শহরে পরিণত হয়েছে। গত পাঁচ বছরে বড় বড় বিল্ডিং বাড়ি ও বেসরকারী পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকার ইন্ডাস্ট্রি হয়েছে। হাজার হাজার বেকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ এখানে কাজ করছে। এই প্রকল্পের কারণে ঈশ্বরদীতে অনেক উন্নতমানের খাবার, উন্নত মানের রিসোর্ট ও হোটেল তৈরি হয়েছে। দেশী-বিদেশী পোশাকের শপিংমল চালু হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের কারণে বিদ্যুত উৎপাদন হবে সহজতর। এক সময় বাংলাদেশ হবে লোডশেডিংমুক্ত। শুধু বাংলাদেশ না, বাংলাদেশের বাইরেও এই বিদ্যুত রফতানি করে কোটি কোটি টাকা দেশের পক্ষে আয় করা সম্ভব হবে। এছাড়াও বিদেশীদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ২২ তলা বিশিষ্ট ২০টি অত্যাধুনিক গ্রীন সিটি নামক আবাসিক ভবন। গ্রীন সিটি এলাকায় গেলে রাশিয়ানদের পদচারণায় মনে হয় বিদেশের কোন শহর। তাদের জন্য হোটেল, বার ও আলাদা একাধিক শপিংমল চালু হয়েছে। এছাড়াও রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে ভাড়া দেয়া প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচলের কারণে ঈশ^রদীকে যানবাহনের শহর বলে মনে হয়।
ঈশ্বরদী উপজেলা প্রকৌশলী বিভাগের মাধ্যমে গত পাঁচ বছরে ঈশ^রদীর বকুলের মোড় থেকে মুলাডুলিসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিটুমিনাস কার্পেটিং রাস্তাসহ ৫০টি বিভিন্ন প্রকার রাস্তা ও ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এসব রাস্তা নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১শ’ কোটি টাকা। লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের শান্তিনগরে ঈশ^রদীর সবচেয়ে বড় ৯০ মিটার দীর্ঘ শান্তিনগর ঘাট ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে যার ব্যয় হয়েছে ৬ কোটি টাকা। আবার দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত ফাউন্ডেশন বিশিষ্ট ১৫টি নতুন স্কুল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি টাকা।
ব্রিটিশ আমলের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত এবং তৎকালীন ভারত বর্ষের একমাত্র ট্রেননিয়ন্ত্রণ অফিস বর্তমানে রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় অফিস ও ঈশ্বরদী জংসন স্টেশন। পাকশী বিভাগীয় অফিস ও ঈশ্বরদী জংসন স্টেশনের অবস্থান অনেকটা পাশাপাশি হওযায় ঈশ্বরদী ও পাকশীকে রেলওয়ে শহর বলা হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার আমলে এই ঈশ্বরদী রেলওয়ে শহর এলাকা থেকে তৎকালীন মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ঈশ্বরদী থেকে নগরবাড়ী পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেন। সে সময় বিশাল এলাকাজুড়ে জমি অধিগ্রহণ করে অনেকাংশ এলাকায় মাটি ভরাটও করা হয়। কিন্তু পাবনা জেলার কতিপয় নেতাদের স্বার্থ রক্ষায় সে প্রকল্প পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
নতুন এই প্রকল্পের নাম দেয়া হয় ঈশ্বরদী-ঢালারচর রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প। ১৭শ’ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণপূর্বক ২০১২ সালের ৫ ডিসেম্বর তারিখে ৭৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়। ১১টি স্টেশন ছোটবড় ব্রিজ ১২৬টি ও ১০৫টি লেভেল ক্রসিং গেট নির্মাণ করা হয়। দীর্ঘদিন কাজ শেষে গত ২০১৯ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয়। এই প্রকল্প শেষ করতে সময় লাগে প্রায় ছয় বছরের অধিক সময়। প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার পর থেকেই রেলপথমন্ত্রী, রেলপথ সচিব, ডিজিসহ পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সে মোতাবেক ৭৮ কিলোমিটার নতুন রেললাইন দিয়ে ঢালারচর থেকে ঈশ^রদী বাইপাস হয়ে রাজশাহীর মধ্যে ঢালারচর এক্সপ্রেস নামক একজোড়া যাত্রীবাহী ট্রেন সুনামের সঙ্গে চলাচল করছে। এতে ঈশ^রদীসহ পাবনা ও নাটোর জেলার হাজার হাজার যাত্রী সুবিধা ভোগ করছেন।
অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক প্রকল্প ঈশ্বরদীর রূপপুর পরমাণু বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্প। এই প্রকল্পের ভারি মালামাল ও যানবাহন আনা-নেয়ার জন্য রেলকর্তৃপক্ষ লুপলাইনসহ ঈশ্বরদী থেকে ২৬ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। দুটি স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণসহ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৩শ’ ৩৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের জুলাইয়ের শেষে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু করে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করা হয়। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সবচেয়ে বড় ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংসন স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম উঁচু করে যাত্রীদের সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আধুনিক মানের টয়লেট ও ওয়াশ রুম করা হয়েছে। স্টেশন থেকে লোকোসেড পর্যন্ত কম্পিটারাইজ বেজ আধুনিক সিগন্যালিং সিস্টেম করা হয়েছে। এতে স্টেশন মাস্টার একস্থান থেকে সকল রেল লাইনকে অপারেট করতে পারবে। একটি রেললাইনের স্থলে দুটি রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে এতে রেললাইন কখনও ব্লক হবে না। ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে না।
এই প্রকল্পে ব্যবহৃত ৬০ কেজি রেলপাতসহ সকল প্রকার ফিটিংস উন্নত বিশ^মানের ব্যবহার করা হয়েছে। খুব কম সময়ের মধ্যেই রূপপুর পরমাণু প্রকল্পের জন্য চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে সরাসরি ভারি মালামাল আনা নেয়া যাবে পাকশী পদ্মা পাড়ের নতুন রেল স্টেশনে। ট্রেন চলাচল শুরু হলে পর্যটন এলাকা খ্যাত এই পদ্মাপাড় এলাকায় দর্শনার্থীদের বেশি সমাগম হবে। ট্রেন চলাচলের সঙ্গে পর্যটকদের উপস্থিতি এলাকার গুরুত্ব বাড়িয়ে দেবে। এমনকি প্রেসিডেন্টবাহীসেল্যুন সাইডিং ৫৩০ এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট স্পেশাল ট্রেনও এখানে আসতে পারে সে সুবিধাও তৈরি করা হবে। নতুন স্টেশন প্ল্যাটফর্মে ১২টি কোচ বিশিষ্ট ট্রেন আসবে। ট্রেন চলাচলের সঙ্গে এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের ব্যাপক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। এক কথায় ঈশ^রদী-পাকশী এলাকার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য আবার ফিরে আসবে। এছাড়াও বিগত পাঁচ বছরে উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন অফিস, বিএসআরআই, ডাল গবেষণা কেন্দ্র, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন দফতরের মাধ্যমে আরও অন্তত ৭-৮’শ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে বলে জানা গেছে।