সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে নজরদারি বাড়ান
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দলীয় নেতাকর্মীদের প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ । ফরিদপুর ও আশপাশের জেলা নিয়ে ‘পদ্মা’ এবং কুমিল্লা ও আশপাশের জেলা নিয়ে ‘মেঘনা’ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হবে । প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে দলের নেতাকর্মীদের নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দেশ। এ দেশে সব ধর্মের নাগরিকদের অন্যের ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। প্রত্যেকটি এলাকায় আমাদের নেতাকর্মীদের নজরদারি বাড়াতে হবে এবং শান্তি সম্মিলন, শান্তি মিছিল, শান্তি সভা করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে কোন রকমের সংঘাত দেখা না দেয়। কারণ এই মাটিতে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেই যেন ভালভাবে বাঁচতে পারে।
বৃহস্পতিবার কুমিল্লা আওয়ামী লীগের নবনির্মিত ‘অফিস ভবন’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, জাতির পিতা ডাকে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ কাঁধে অস্ত্র তুলে নিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছে। কাজেই এই স্বাধীনতাকে কোনভাবে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না।
কুমিল্লায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, কুমিল্লার যে ঘটনাটি ঘটে গেছে সেটা সত্যিই খুব দুঃখজনক। কারণ মানব ধর্মকে সম্মান করাই ইসলামের শিক্ষা। কিন্তু নিজের ধর্ম পালনের অধিকার যেমন সকলের রয়েছে, তেমনি অন্যের ধর্মকেও কেউ হেয় করতে পারে না। এটা ইসলাম শিক্ষা দেয় না। আর নিজের ধর্মকে সম্মান করার সঙ্গে সঙ্গে অন্যের ধর্মকেও সম্মান করতে হয়। আর অন্য ধর্মকে হেয় করা হলে নিজের ধর্মকেই অসম্মান করা হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, কুমিল্লার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে আমরা সেটাই দেখব। আমাদের পবিত্র কোরান শরিফকে অবমাননা করেছে অন্যের ধর্মকে অসম্মান করতে গিয়ে। এটাই সবচেয়ে দুঃখজনক। তিনি বলেন, যার যার নিজের ধর্মের সম্মান নিজেকেই রক্ষা করতে হবে। আর একটি কথা আইন কেউ হাতে তুলে নেবেন না। কেউ যদি অপরাধ করে, সে যেই হোক সে অপরাধীদের বিচার হবে। আমাদের সরকার সে বিচার করবে।
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এমপি অনুষ্ঠানে কুমিল্লা প্রান্ত থেকে স্বাগত বক্তৃতা করেন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি, এ্যাডভোকেট আবুল হাসেম এমপি, ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন এমপি, অধ্যাপক ডাঃ প্রাণ গোপাল দত্ত এমপি, নাসিমুল আলম চৌধুরী নজরুল এমপি, আরোমা দত্ত এমপিসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ কুমিল্লা প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে শুরু এই অনুষ্ঠানে নবনির্মিত আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) বলেছেন, ধর্ম নিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করবে না। কাজেই আমাদের সকলেরই সেই কথা মেনে চলতে হবে এবং জানতে হবে, তাহলেই সঠিক শিক্ষা আমরা পাব। প্রত্যেকটি ধর্মই শান্তির বাণীর কথা বলে, সকলেই শান্তি চায়। কাজেই এই বাংলাদেশে আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক সমাজে বসবাস করি যেখানে সকলের ধর্মের সঙ্গে আমাদের সম্প্রীতি থাকবে এবং এই সম্প্রীতি নিয়েই আমাদের চলতে হবে। কেননা যুগ যুগ ধরেই এ দেশে সকল ধর্মের মানুষ এক সঙ্গে বসবাস করে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে বলেন, সেখানে কোন ধর্ম দেখে নয়, যারা রক্ত দিয়েছেন তাঁদের রক্তের সঙ্গে সকল ধর্ম একাকার হয়ে মিশে গেছে। আর এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশ সকল ধর্মের, সকল বর্ণের সব শ্রেণী-পেশার মানুষই একটা মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে চলবে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্যই মাঝে মাঝে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর প্রচেষ্টা নেয়া হয় উল্লেখ করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, কুমিল্লার ঘটনা ঘটার পর পরই পীরগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় যে ঘটনা ঘটেছে, ঘর-বাড়ি পুড়িয়েছে- সঙ্গে সঙ্গে তাঁবু টাঙ্গিয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুকনো খাবার থেকে শুরু করে রান্না করা খাবার বিতরণ, কাপড়-চোপড় এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং যাদের এ ধরনের ক্ষতি হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকেই আমরা ঘর-বাড়ি তৈরি করে দেব। ইতোমধ্যে সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ এমন একটা সংগঠন যে সংগঠন জাতির পিতা করে দিয়ে গিয়েছেন, যে সংগঠন এ দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই দেশের উন্নতি হয়, মানুষের কল্যাণ হয়। অথচ ’৭৫ এর পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারা মানুষকে কিছু না দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছে। কাজেই আমরা চাই সারাদেশের প্রত্যেক জেলায় আওয়ামী লীগের একটা অফিস হোক।
কুমিল্লা খাদ্যে উদ্বৃত্ত অঞ্চল উল্লেখ করে সরকারপ্রধান নদী ড্রেজিং এবং জলাধার সংস্কারসহ এর অবকাঠামো উন্নয়নের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরে বলেন, আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং এটা আমাদের অব্যাহত থাকবে। আর গ্রামগুলোতে যারা বসবাস করেন তারা যেন শহরের সব ধরনের নাগরিক সুবিধা পা তার ব্যবস্থা সরকার করে দিচ্ছে।
কুমিল্লাকে বিভাগে রূপান্তরিত করার দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে ফরিদপুর ও এর আশপাশের জেলাগুলোকে নিয়ে ‘পদ্মা’ এবং কুমিল্লা ও তার আশপাশের জেলা নিয়ে ‘মেঘনা’ বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা- এ স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং বিজয় অর্জন করেছে। কাজেই কোন জেলার নামে বিভাগ হবে না। তাই আমি কুমিল্লা নয় মেঘনা নামে এবং ফরিদপুর নয় পদ্মা নামে বিভাগ করার প্রস্তাব রাখছি। আশা করি, আপনারা আমার প্রস্তাব গ্রহণ করবেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ’৭৫-এর পর সবচেয়ে বেশি নির্মম নির্যাতনের শিকার রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, যেখানেই মানুষের ওপর কোন নির্যাতন হয় আওয়ামী লীগ পাশে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও আওয়ামী লীগ মানুষের পাশে থাকে। আর বিএনপি-জামায়াতের কাজই হচ্ছে ধ্বংস করা। তাদের অগ্নিসন্ত্রাসে কত মানুষ জীবন দিয়েছে, কত নেতাকর্মীকে তারা হত্যা করেছে, অবর্ণনীয় অত্যাচার করেছে।
তাঁর সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়া আজ তৃণমূলের মানুষ পেতে শুরু করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘আমাদের মাটি আছে, মানুষ আছে তা দিয়েই আমরা দেশকে গড়ে তুলব।’ সেটাতেই আমরা বিশ^াস করি। কারো কাছে আমরা হাত পেতে চলব না। কারণ, ভিক্ষুক জাতির কোন ইজ্জত থাকে না- সে শিক্ষাও জাতির পিতাই দিয়ে গেছেন।
তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে দেশের যখন উন্নয়ন হচ্ছে একটা শ্রেণী আছে তারা কখনও এটা মানতে পারে না। বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে সম্মান নিয়ে চলবে এটা তাদের কাছে পছন্দনীয় নয়। আর বিএনপি-জামায়াতের এটা কখনই পছন্দ হবে না, কারণ খালেদা জিয়ার অন্তরে সবসময়ই ছিল ‘পেয়ারে পাকিস্তান’।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, আওয়ামী লীগ গণমানুষের সংগঠন এবং আওয়ামী লীগ এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করবে, দেশের মানুষকে উন্নত জীবন দেবে, দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করবে। আর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে আমরা মাথা উঁচু করে চলব, যেটা জাতির পিতা চেয়েছিলেন।
করোনার শিক্ষা ‘যতই সম্পদ হোক দুঃসময়ে তা কাজে লাগে না’- উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, মানুষ মরে গেলে এই সম্পদ পড়ে থাকবে তা কোন কাজেই আসবে না। কাজেই যত বেশি দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করতে পারব সেটাই জাতির পিতার এবং ইসলামের শিক্ষা। আর আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাই হয়েছে মানুষের সেবার জন্য, সে কথাও মনে রাখতে হবে। আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে জাতির পিতার আদর্শ নিয়েই চলতে হবে।
তাঁর সরকার দেশের বেদে শ্রেণী, তৃতীয় লিঙ্গ এমনকি কুষ্ঠরোগীদের জন্যও ঘর-বাড়ি করে দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি যেভাবে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে তাঁদের সেবা করতে হবে। বাংলাদেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, বাংলাদেশ আজকে স্বাধীন দেশ। কাজেই বাংলাদেশের ক্ষতি ভবিষ্যতে আর কেউ করতে পারবে না। আমরা কখনও আর কারো অধীন হবো না। স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা সারাবিশ্বে মাথা উঁচু করে চলব। সেই কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে।
কুমিল্লা থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা মীর শাহ আলম জানান, নগরীর কেন্দ্রস্থল কান্দিরপাড় এলাকায় কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের নবনির্মিত ৯তলা বিশিষ্ট বিস্তৃত পরিসরের নান্দনিক কারুকাজ ও আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ভবনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৯তলা ভবনটিতে আছে মহানগর আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অফিস, কনফারেন্স হল, মিডিয়া রুম, গেস্ট হাউস, প্রার্থনা কক্ষ, ক্যাফেটেরিয়া, ইনডোর গেম স্পট, একাধিক লিফট, সিসি ক্যামেরা, ইন্টারকম, অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ও ওয়াইফাই সুবিধাসহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সব সুযোগ। ভবনটিতে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর মিশেলে ইনডোরে আলোক চিত্রে তুলে ধরা হয়েছে দেশ ও দলের ইতিহাস। প্রতিটি ফ্লোরের নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নামে। ভবনের সম্মুখে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রতিকৃতি। দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা, গবেষণা, ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে আধুনিক কার্যালয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করেন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রবীণ নেতারা।