ইউরোপ আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের পরচুলা
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : মাথায় ভরা কালো ঘন চুল থাকুক- এমন ইচ্ছা কার না থাকে। কিন্তু টাক পড়ে গেলে দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। এ সমস্যার সমাধানে মানুষ বেছে নেয় পরচুলা। বিশ্বে দিন দিন বড় হচ্ছে পরচুলার বাজার। এর ভাগ নিচ্ছে বাংলাদেশ। পরচুলা থেকে আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ছে। দেশের রপ্তানি খাতে আশা জাগাচ্ছে এ পণ্য।
রপ্তানি আয়ের তথ্য বিশ্নেষণে জানা যায়, পরচুলা ব্যবসার প্রসার হচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কৃত্রিম চুল ও মানুষের মাথার চুল দিয়ে তৈরি পণ্য রপ্তানি হয়েছে এক কোটি ৯৫ লাখ ৫৮ হাজার ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই কোটি ৩০ লাখ ডলারে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আরও বেড়ে হয় তিন কোটি ২৫ লাখ ডলার। অবশ্যই পরের অর্থবছরে রপ্তানি বাড়েনি। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ কোটি ৭১ লাখ ডলারে। এ হিসাবে গত পাঁচ বছরে রপ্তানি বেড়েছে ১৯২ শতাংশ।
আগে গ্রামগঞ্জে নারীরা মাথার চুল আবর্জনা হিসেবে ফেলে দিত। সেই চুল এখন রোজগারের উৎস হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শ্যাম্পু ও বিভিন্ন ওষুধ দিয়ে ধোয়ার পর সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এক কেজি চুল প্রক্রিয়াজাতকরণের পর ৬০০ গ্রাম হয়। প্রক্রিয়াজাতকরণের পর প্রতি কেজি চুলের দাম হয় ৭ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এরপর এসব চুল দিয়ে বিভিন্ন ক্যাপ তৈরি করা হয়। এ ছাড়া সিনথেটিকের চুল দিয়েও পরচুলা তৈরি করা হয়। মানুষের টাকমাথা, ফ্যাশন এবং অভিনয় শিল্পীদের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় পরচুলা। চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পরচুলা তৈরির জন্য শিল্পও গড়ে উঠেছে।
দেশে চারটি পরচুলা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার তিনটিই ইপিজেডে এবং এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হংকং ও চীনের উদ্যোক্তাদের। এর মধ্যে উত্তরা ইপিজেডে রয়েছে এভারগ্রিন প্রোডাক্টস, ঈশ্বরদীতে এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেড ও মোংলায় রয়েছে ওয়াইসিএল ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রি। ইপিজেডগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। এর বাইরে গাজীপুরে রয়েছে একটি কোম্পানি।
পরচুলার ক্যাপসহ নানা পণ্য উৎপাদন করা হয়। একটি ছোট পরচুলা তৈরি করতে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগলেও বড়গুলোতে লাগে তিন থেকে চার দিন। শ্রমিকরা আকারভেদে প্রতিটি পরচুলার জন্য মজুরি পান তিনশ থেকে আটশ টাকা পর্যন্ত। এসব কারখানায় দেশ থেকে মানব চুল সংগ্রহ করে এবং জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন থেকে সিনথেটিক ফাইবার এনে পরচুলার ক্যাপ তৈরি করা হয়। রপ্তানি করা হয় বিশ্বের ৩৪টি দেশে। তবে পরচুলার ক্রেতা মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। গত অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশই এসেছে এই দুই দেশ থেকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পরচুলার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গেছে তিন কোটি পাঁচ লাখ ডলার এবং চীনে গেছে দুই কোটি ১২ লাখ ডলারের পণ্য।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে পরচুলা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথম পাঁচ মাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই কোটি ৫৭ লাখ ডলার। এর বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে তিন কোটি ৬২ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪১ শতাংশ বেশি। তাছাড়া গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে এই হার বেশি ১২০ শতাংশ।
বিশ্ববাজারে এর পরিমাণ বাড়লেও বাংলাদেশের শেয়ার খুবই কম। আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনভিত্তিক বাজার বিশ্নেষণ সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটসের তথ্য মতে, ২০২০ সালে পরচুলার বিশ্ববাজার ছিল ৫৭৭ কোটি ডলার। সেই হিসাবে পরচুলা রপ্তানিতে বাংলাদেশের অংশ মাত্র এক শতাংশ। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০২৬ সালে এর রপ্তানি বাজার দাঁড়াবে এক হাজার ৩২৮ কোটি ডলারে।
সংশ্নিষ্টরা বলেন, সম্ভাবনাময় এ খাতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বাজার সৃষ্টি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে কুটির শিল্প গড়ে তোলা হলে একদিকে গরিব, অসহায় ও অসচ্ছল পরিবারগুলো স্বাবলম্বী হতে পারবে, অন্যদিকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি বাড়িয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। যথাযথ উদ্যোগ নিলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পরচুলার রপ্তানি বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে।
বেশিরভাগ পরচুলা তৈরি হয় দেশের উত্তরাঞ্চলে। নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার তরুণ উদ্যোক্তা আজাহার ইসলাম জানান, তার ছয়টি হেয়ার ক্যাপ তৈরির কারখানা রয়েছে। যেখানে কাজ করছেন দেড় শতাধিক দরিদ্র নারী ও শিক্ষার্থী। কাজের চাহিদাও রয়েছে। এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। তবে সরকারি উদ্যোগে কারখানা করা হলে ব্যাপক রপ্তানি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন তিনি।
বেপজার মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) নাজমা বিনতে আলমগীর সমকালকে বলেন, পরচুলাগুলো তৈরি হয় মূলত ইপিজেডে। বিদেশি উদ্যোক্তারাই এর মূল উৎপাদনকারী। বাংলাদেশের মানুষ পরচুলা তেমন ব্যবহার করে না। তবে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এসব দেশে হ্যালোইন, ক্লাউন, ক্যারিবিয়ান প্যারেড, সাম্বা ড্যান্সসহ বিভিন্ন উৎসব উদযাপন করা হয়। এসব উৎসবে ফ্যাশন পণ্য হিসেবে পরচুলা ব্যবহার হয়। তিনি বলেন, প্রচলিত রপ্তানি পণ্যের বাইরে ভবিষ্যতে পরচুলা বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় খাত হয়ে উঠতে পারে। রপ্তানিতে যে গতি দেখা যাচ্ছে তাতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এর রপ্তানি বাজার এক থেকে দেড় বিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারে।