লাইফলাইন রক্ষায় বাংলাদেশের নৌবাহিনী
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন দক্ষিণ সুদানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একমাত্র মেরিন ইউনিট ব্যানএফএমইউ। দেশটির রাজধানী জুবা থেকে ১ হাজার কিলোমিটার দূরের মালাকাল প্রদেশে খাদ্য ও জ্বালানি পৌঁছে দিতে ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকা রাখছে নৌবাহিনীর সদস্যরা। তারা ‘অপারেশন লাইফ লাইন’ নামে এক অভিযানের মাধ্যমে দেশটিতে নিয়োজিত ৫২ দেশের প্রায় ১৪ হাজার শান্তিরক্ষীর খাবার ও জ্বালানি তেল পৌঁছে দিচ্ছে নদী পথে। মাঝখানে সরকারি ও বিরোধী পক্ষের ৪০/৪২টি সশস্ত্র তল্লাশি চৌকি পেরোতে হয় তাদের। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মালাকাল কয়েক বছর আগেও ছিল যুদ্ধের আগুনে পোড়া ‘ছাই’। গরমকালে সূর্যের তেজ আর বর্ষায় কাদা ও মানুষের বিষ্ঠায় মাখামাখি মাটিতে পা ফেলায় অভ্যস্ত সবাই। তার মাঝেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শরণার্থী ক্যাম্প, তাঁবু ও ছাউনি ঘর। ম্যালেরিয়া, ডায়েরিয়া, কালাজ্বর, রক্তশূন্যতা, পুষ্টিহীনতাসহ নানা রোগে আক্রান্ত মানুষগুলো ছুটে যায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কাছে। যুদ্ধের সময় বারবার হাত বদল হয়েছে শহরটির।
কিন্তু তেলসমৃদ্ধ শহর মালাকালের মানুষের জীবনযাত্রার মান বদলায়নি। খাবারের জন্য হাহাকার, চিকিৎসার জন্য আহাজারি লেগেই আছে! এই অসহায় মানুষগুলোর শেষ ভরসা বাংলাদেশ নৌবাহিনী। মালাকালের মানুষের কাছে তারা পরিচিত ‘বাংলাবন্ধু’ নামে। এই শহরে নৌবাহিনী তৈরি করেছে একটি লেভেল-২ হাসপাতাল। এটি এখন শুধুই হাসপাতাল নয়, সেখানকার স্থানীয় মানুষের কাছে ‘জীবন ফিরে পাওয়া’র নতুন ঠিকানা। বিভিন্ন রোগে আক্রান্তরা প্রতিনিয়ত ছুটে যায় এই হাসপাতালে। চিকিৎসার পাশাপাশি বিনামূল্যে ওষুধও দেওয়া হয় তাদের।
মালাকাল একসময় ছিল ব্যস্ত বাণিজ্যিক কেন্দ্র। সেখান থেকে অবিভক্ত সুদানে মালপত্র পাঠানো হতো। কিন্তু যুদ্ধ সেই ব্যস্ততা কেড়ে নিয়েছে। কর্মহীন মানুষগুলো এখন ঠিকমতো খেতেও পারছে না। বিধ্বস্ত নগরীর সর্বহারা মানুষকে এখন আগলে রেখেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
দক্ষিণ সুদানে নিয়োজিত বাংলাদেশ ফোর্স মেরিন ইউনিট (বিএফএমইউ)-এর কন্টিনজেন্ট কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম হাবিব উল আলম বলেন, দক্ষিণ সুদানের গুরুত্বপূর্ণ সবখানে বিভিন্ন দেশের সৈন্যরা থাকেন। তাদের খাবারের ব্যবস্থা, জ্বালানি তেলের ব্যবস্থা, এই সাপ্লাই লাইনটা নদী পথ দিয়ে করা হয়। এটা খুবই সাশ্রয়ী একটা রুট। জুবা সিটি থেকে দুটো কোম্পানি ফুড অ্যান্ড ফুয়েল ক্যারি করে। এই সরবরাহ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে এখানে একমাত্র ইউনিট হিসেবে আমাদের মেরিন ইউনিট কাজ করছে।
তিনি বলেন, এই ১০০০ কিলোমিটার সাপ্লাই লেনে ৪০/৪২টি চেকপয়েন্ট ওরা মেনটেন করে। এর মধ্যে সরকারের চেকপয়েন্ট আছে ২০টি। বাকি ২০/২২টি চেকপয়েন্ট সরকারবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর। তারা সরকারের কোনো কথা শোনে না। এই রুট দিয়ে সব ধরনের পণ্য আমরা পরিবহন করি। এই পথটা যেতে আমাদের সময় লাগে প্রায় ১০ দিন। এর আগে মালামাল লোড করতে লাগে ১০ দিন। সেখানে গিয়ে আনলোড করতেও লাগে আরও ১০ দিন। লোড-আনলোড ও পরিবহন শেষে ১০ দিনে ফিরে আসে তারা। সব মিলিয়ে ন্যূনতম ৪০ দিন লাগে আমাদের প্রতিটি ট্রিপে। এই অপারেশনে আরও ৪/৫ দিন সময় অতিরিক্ত ধরি আমরা। ফলে একটা অপারেশন সারতে আমাদের প্রায় ৪৫ দিন লেগে যায়। জাতিসংঘ আমাদের এই অপারেশনের নাম দিয়েছে, ‘অপারেশন লাইফ লাইন।’ এই কাজটা আমরা করছি গত ৭ বছর ধরে। নদীপথে চেক পয়েন্টগুলোই এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। তারা আমাদের মালামাল চেক করে ক্লিয়ারেন্স দেয়। তাদের সবার হাতেই ভারী অস্ত্র থাকে। প্রত্যেকটা জায়গাতেই নদীর পাশে তাদের টং ঘর রয়েছে।
ক্যাপ্টেন এম হাবিব উল আলম বলেন, এখানকার মানুষ অনেক গরিব। তারা অসুস্থ থাকে বেশি। আমরা তাদের প্রাথমিক চিকিৎসাসহ ফিল্ড হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা সেবা দেই। দক্ষিণ সুদানে নৌবাহিনীর ২০০ জন সদস্য মোতায়েন রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী জুবাতে আছে ৯০ জন। মালাকালে আছে বাকি ১১০ জন। প্রতি ট্রিপে তারা বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবহন করে।
দক্ষিণ সুদানে রাস্তাঘাট তেমন নেই। পণ্য পরিবহনে নৌপথই বড় ভরসা। একমাত্র নদীটিকে বলা হয়, হোয়াইট নাইল। এটি মিসরের নীল নদের একটি ধারা। কন্টিনজেন্ট কমান্ডার আরও বলেন, আমরা বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এবং যথেষ্ট দায়িত্বশীল উপায়ে এই নৌরুটটা অপারেট করি। এটা হচ্ছে অনমিসের একমাত্র লাইফ লাইন। এটা ব্যাহত হলে এখানে নিয়োজিত জাতিসংঘের সব ইউনিটের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। জ্বালানির অভাবে তাদের মুভমেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, দক্ষিণ সুদানে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর মেরিন ফোর্স আসে ২০১৫ সালের এপ্রিলে। প্রধানত ফোর্স প্রোটেকশন কাজে আমরা নিয়োজিত রয়েছি। অপারেশন লাইফ লাইন নামের এই নৌ রুটটি আনমিসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এই ইউনিটটি দক্ষিণ সুদানে শান্তিরক্ষা মিশন বাস্তবায়নে গুরুত্বপূণ ভূমিকা পালন করছে।