বেসরকারি খাতে ঋণের জোয়ার
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতিতেও বেসরকারি ঋণে প্রবৃদ্ধি বেড়েই চলেছে। সাড়ে তিন বছর পর গত মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি বেড়ে ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠেছে। এর অর্থ হলো—২০২১ সালের মে মাসের চেয়ে চলতি বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেশি ঋণ পেয়েছেন। বৃহস্পতিবার (২৩ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
এক মাস আগে এপ্রিলে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়ার অর্থ দাঁড়ায়—দেশে বিনিয়োগ চাহিদা তৈরি হচ্ছে। উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। অর্থাৎ অর্থনীতি গতিশীল হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, টানা ১২ মাস ধরে (ব্যতিক্রম গত ফেব্রুয়ারি) বাড়ছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করায় প্রতি মাসেই বাড়ছে অর্থনীতির এই সূচক। গত মার্চে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ।
গত মে মাসের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ২৩ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ছিল ১১ লাখ ৭১ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। অবশ্য চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। চলতি অর্থবছর শেষ হতে আরও এক মাস বাকি আছে। ঋণ প্রবৃদ্ধির হার যেভাবে বাড়ছে, তাতে এই সময়ের মধ্যেই সূচকটি ঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাবে বলে ধারণা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য আগামী ৩০ জুন নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সরকার বেশি মাত্রায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে বলে জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ জুন পর্যন্ত ব্যাংক থেকে সরকার নিট ৪১ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। গত মে পর্যন্ত যা ছিল ৩২ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। এর মানে শেষ সময়ে এসে ঋণ দ্রুত হারে বাড়ছে।
এছাড়া আগামী অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেটের ঘাটতি পূরণে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করছে সরকার। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা আছে। সাধারণত দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে মনে করা হয় বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহকে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত কয়েক মাস ধরে ঋণ বিতরণ বেড়েছে। এর ফলে ব্যাংকে এখন তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিনই ব্যাংকগুলোকে তারল্য সরবরাহ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২২ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে সূচকটি ১১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে ওঠে। ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন ধরে দেশে বিনিয়োগের মন্দায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের চিত্রও ছিল হতাশাজনক। ২০২০ সালে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর থেকেই প্রতি মাসেই কমতে থাকে প্রবৃদ্ধি। গত বছরের মে মাসে তা ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে আসে, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। অবশ্য এরপর থেকে বাড়ছে ঋণের প্রবৃদ্ধি। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ, অক্টোবরে ছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ২৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ২৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০১১ সালে মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ২৯ দশমিক ১৩ শতাংশে ওঠে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তা দুই অঙ্কের নিচে (ডাবল ডিজিট)—৯ দশমিক ৮৩ শতাংশে নেমে আসে। এরপর গত দুই বছর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি এক অঙ্কের নিচে (সিঙ্গেল ডিজিট) অবস্থান করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ) শেষে দেশের শিল্প খাতে মোট ঋণ বিতরণ হয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা। ২০২১ সালের একই সময়ে (মার্চ প্রান্তিক) ঋণ বিতরণ হয়েছিল ৯০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় শিল্প খাতে ঋণের বিতরণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা।
২০২১ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছিল এক লাখ ২৪ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ২ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা, যা এক বছরের ব্যবধানে শতকরা হিসাবে ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।