মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মানবাধিকার লঙ্ঘন ॥ প্রধানমন্ত্রী
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে গিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো পুরো বিশ্বের মানুষকে শাস্তির মুখে ফেলে দিয়েছে মন্তব্য করে বলেছেন, একদিকে বলতে গেলে এটাও তো মানবাধিকার লঙ্ঘন করার শামিল। মানুষের যে অধিকার সে অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। আর রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানুষকেও ভুগতে হচ্ছে। কেননা, স্যাংশন দিয়ে কখনও কোন দেশ বা জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, সেটা নিশ্চয় এখন দেখতে পাচ্ছেন। তাই, যুদ্ধ যারা করার করতে থাকেন। কিন্তু পণ্য পরিবহন বা আমদানি-রফতানিটা যাতে সহজভাবে হয়, আর সাধারণ মানুষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে নজর রাখুন।
রোহিঙ্গাদের নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও সক্রিয়া ভূমিকা প্রত্যাশা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে নিজস্ব বিপুল জনসংখ্যা, সেখানে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার দায়িত্ব বহন করা বাংলাদেশের জন্য কতটা কঠিন তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপলব্ধি করা উচিত। রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য একটি বড় বোঝা। করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উন্নত দেশসহ সব দেশই হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে সকলের উপলব্ধি করা উচিত যে, সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশের জন্য এটি কতটা কঠিন।
বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নবনির্মিত ৮তলা ভবন উদ্বোধন এবং ‘বঙ্গবন্ধু কূটনৈতিক উৎকর্ষ পদক’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নবনির্মিত ভবনের হলরুমে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং এরই মধ্যে চার বছর কেটে গেছে। এছাড়া, রোহিঙ্গাদেরও আশ্রয় ক্যাম্পের পরিবর্তে একটি ভাল জায়গায় বসবাসের মানবাধিকার রয়েছে এবং তাদের সন্তানরাও তাদের জন্মভূমিতে একটি ভাল পরিবেশে যাতে বেড়ে উঠতে পারে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপলব্ধি করা উচিত।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছর থেকে ‘বঙ্গবন্ধু কূটনৈতিক উৎকর্ষ পদক’ পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। এবছর এই পদকের জন্য পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি মনোনীত হন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কয়েক হাজার বাংলাদেশী সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্র ইউক্রেন ছেড়ে পোল্যান্ড ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে আশ্রয় নেয়ার প্রেক্ষাপটে সুলতানা লায়লা হোসেন অসাধারণ অবদান রাখেন। তেমনিভাবে ইতো নাওকি’ও ঢাকা-টোকিও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বিজয়ীদের পদক প্রদান করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম এবং পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে পুরস্কার বিজয়ী কূটনীতিক সুলতানা লায়লা হোসেন এবং বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে ‘বিশ্বব্যাপী বঙ্গবন্ধু কর্নার’ নামের একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন এবং বিদেশে বাংলাদেশের সকল মিশনের জন্য অভিন্ন ওয়েবসাইট আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেন। এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নবনির্মিত ৮ তলা ভবন এবং ‘বঙ্গবন্ধু কূটনৈতিক উৎকর্ষ পদক’ এর ওপর একটি ভিডিও চিত্র অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এটিকে কেন্দ্র করে আমেরিকার স্যাংশনে (নিষেধাজ্ঞায়) সারাবিশ্বের সরবরাহ চেন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সারাবিশ্বের মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। তিনি এর থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আজকে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, সারাবিশ্ব যখন করোনা আক্রান্ত হয়ে অর্থনৈতিকভাবে বিরাট ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে; ঠিক সেই সময় রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষের অবস্থা আরও করুণ হয়ে যাচ্ছে, মানুষ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার ওপর আমেরিকা স্যাংশন দিয়েছে।
এই স্যাংশন দেয়ার ফলে পণ্য প্রাপ্তিতে বিরাট বাধার সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু তাই নয়Ñ পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে এবং প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী প্রাপ্তির ক্ষেত্রটাও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এই প্রভাবটা শুধু বাংলাদেশে নয়Ñ আমি মনে করি আমেরিকা, ইউরোপ, ইংল্যান্ড থেকে শুরু করে সারাবিশ্বই এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষ কিন্তু কষ্ট ভোগ করছে। যেটা আসলে সকলের এবং উন্নত দেশগুলোর বিশেষভাবে বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। আমেরিকা যে স্যাংশন দিচ্ছে তাতে তাদের দেশের লোকও কষ্ট পাচ্ছে। সেদিকেও তাদের দৃষ্টি দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
এই স্যাংশন যাদের বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে তারা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেই প্রশ্ন উত্থাপন করে শেখ হাসিনা বলেন, তার চাইতে সব দেশেই সাধারণ মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ, সকল দেশের মানুষই কিন্তু কষ্ট পাচ্ছে। নি¤œ আয়ের দেশ, সব দেশই কিন্তু কষ্ট পাচ্ছে। করোনা মহামারী থেকে কেবল আমরা একটু উদ্ধার হচ্ছিলাম। তখনই এই যুদ্ধ আর স্যাংশন। যেটা সত্যিই আমাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হবে।
স্যাংশন থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আশা করি এক দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে বিশ্বের মানুষকে শাস্তি দেয়া, এখান থেকে সরে আসা মনে হয় বাঞ্ছনীয়। সকলে সেটাই চাইবে বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, স্যাংশন দিয়ে কোন দেশ বা জাতিকে কখনও নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সেটা নিশ্চয়ই এখন দেখতে পাচ্ছেন। তার প্রভাব নিজের দেশের ওপরও পড়ে। কাজেই এই স্যাংশন তুলে দেয়া এবং পণ্য পরিবহন সহজ করা। যুদ্ধটা আপনারা করতে থাকেন কিন্তু পণ্য পরিবহন, আমদানি, রফতানি যাতে সহজভাবে হয় আর সাধারণ মানুষ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
সরকারপ্রধান বলেন, খাদ্যটা মানুষের সব থেকে বড় চাহিদা। সেখানে অনেক উন্নত দেশও সমস্যায় পড়ে গেছে। প্রত্যেকের জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে আমরা চেষ্টা করছি উৎপাদন বাড়াব। আমাদের খাদ্যটা যেন আমরা নিজেরা উৎপাদন করতে পারি সেই ব্যবস্থাও আমরা করব। যদি অন্য কাউকে সাহায্য করতে পারি সেটাও করব। কিন্তু উৎপাদন করতে গেলে আমাদের সার প্রয়োজন, ডিজেল প্রয়োজন, বিভিন্ন উপকরণ প্রয়োজন যেটা আমরা পাচ্ছি না। এভাবে মানুষকে কষ্ট দেয়ার কি অর্থ থাকতে পারে? আমি ঠিক জানি না। এখানেও তো আমি বলব যে, একদিকে বলতে গেলে এটাও তো মানবাধিকার লঙ্ঘন করার শামিল। মানুষের যে অধিকার সে অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে শান্তি চুক্তি, ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি চুক্তি, ভারতের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ‘স্থল সীমানা চুক্তি’র আওতায় শান্তিপূর্ণভাবে ছিটমহল বিনিময় এবং দেশের বিশাল সমুদ্রসীমায় অধিকার অর্জনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের যেসব সমস্যা ছিল আমরা কিন্তু সকলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই সেটা সমাধান করে আমাদের দেশের মানুষের অধিকারটা আমরা নিশ্চিত করেছি।
গত ২৫ জুন তাঁর সরকার বাঙালী জাতির আত্মমর্যাদা ও সক্ষমতার প্রতীক ‘স্বপ্নের পদ্মা সেতু’ উদ্বোধনের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। অর্থনৈতিক কূটনীতিকে এখন গুরুত্ব দিতে হবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, পৃথিবীটা এখন একটা গ্লোবাল ভিলেজ এবং একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। সেভাবেই আমাদের কাজ করতে হবে, সকলের সঙ্গে মিলেই আমরা কাজ করব যেন মানুষের উন্নতি হয়।