আইএমএফ ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : অর্থনীতির চলমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় দীর্ঘ দশ বছর পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ধরে হিসাব করলে বাংলাদেশী মুদ্রায় এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ৪২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ঋণ সহায়তা প্রদানে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। এ সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত করতে আইএমএফের আর্টিকেল ফোর মিশনের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সিঙ্গাপুর অবস্থান করায় নতুন অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। তবে প্রতিনিধিদলটির সঙ্গে বৈঠক করতে শীঘ্রই দেশে ফিরবেন অর্থমন্ত্রী। অর্থবিভাগের পক্ষ থেকে ঋণের পরিমাণ, সহজ শর্ত এবং নমনীয় সুদহার ধার্যের ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে আইএমএফ চায় আর্থিক খাতের সংস্কার। আইএমএফ ঋণের শর্তগুলোর বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে সংস্থাটিকে ঋণ প্রদানে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়। এসব আনুষ্ঠানিকতা শেষে চুক্তি স্বাক্ষর হতে কমপক্ষে ৬ মাস লাগতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো এবং ডলারের সঙ্কট মেটাতে আইএমএফের কাছে বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ চায় বাংলাদেশ। একইসঙ্গে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টে সহায়তা হিসেবেও এ ঋণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ কারণে গত অর্থ বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে এ ব্যাপারে প্রস্তুতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় আইএমএফের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সঙ্গে ইতোমধ্যে একাধিক বৈঠক হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বাজেট ঘোষণার আগে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গবর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বৈঠক করেন আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে। এসব বৈঠকেই বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণ সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেয় সংস্থাটি। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যেসব আলোচনা বৈঠক করেছে তা ফলপ্রসূ হয়েছে।
জানা গেছে, প্রতিবছর ১৫০ কোটি ডলার করে তিন বছরে এই ঋণ চাওয়া হবে। এক দশক পর এই প্রথম আইএমএফের কাছ থেকে পঞ্চমবারের মতো ঋণ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে তারা ঋণ দেবে বাজেট সহায়তা হিসেবে এবং তা হবে দরকষাকষি ও শর্ত সাপেক্ষ। বাংলাদেশ সহজ শর্ত এবং সুদহারের বিষয়ে নমনীয় হওয়ার ব্যাপারে আইএমএফকে অনুরোধ করেছে। আইএমএফের এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি দল ৯ দিনের সফরে বৃহস্পতিবার ঢাকায় এসেছে। এটি মূলত আইএমএফের আর্টিকেল ফোর মিশনের দল। সফররত প্রতিনিধিদলটি পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, ইআরডি ইত্যাদি সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। এ প্রসঙ্গে অর্থবিভাগের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, আইএমএফ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। সংস্থাটির কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত। ইতোপূর্বে অর্থবিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারের বৈঠকে চূড়ান্ত আলোচনা করা হবে। এরপরই ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করবে আইএমএফ। আশা করা হচ্ছে, সংস্থাটির কাছ থেকে বাংলাদেশ ঋণ সহায়তা পেতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় অর্থসচিবের সঙ্গে তাঁদের প্রথম বৈঠকটি হতে পারে। তবে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধিদল বৈঠক করবে।
জানা গেছে, এবারের বৈঠকে দরকষাকষি চূড়ান্ত হওয়ার পর ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি ওয়াশিংটনে আইএমএফের প্রধান কার্যালয়ে উপস্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ এর আগে আইএমএফ থেকে চারবার ঋণ নেয়। প্রথমবার ঋণ নেয়া হয় ১৯৯০-৯১ সময়ে। এর পর ২০০৩-২০০৪, ২০১১-১২ এবং সর্বশেষ ২০২০-২১ সালে সংস্থাটি থেকে ঋণ নেয় বাংলাদেশ। তবে কোনবারই ঋণের পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার ছাড়ায়নি। সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ বছরে ১০০-১৫০ কোটি ডলার পর্যন্ত ঋণ পাওয়ার যোগ্য। ফলে বর্ধিত ঋণ সহায়তা (ইসিএফ), বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলার জন্য গঠিত সহনশীলতা ও টেকসই তহবিল (আরএসএফ)-আইএমএফের এই তিন কর্মসূচী থেকে আলাদা করে ঋণ চাওয়া হবে। ইসিএফ থেকে নেয়া ঋণে সুদ ও মাশুল দিতে হয় না। ১০ বছর মেয়াদী এ ঋণ পরিশোধে সাড়ে ৫ বছর গ্রেস পিরিয়ডও রয়েছে। বাকি দুটি তহবিল থেকে দেয়া ঋণের সুদহার ১ দশমিক ৫৪ থেকে ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল, বিদ্যুত-গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে চাপে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। এর পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন।
এছাড়া বিশ্বজুড়ে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়া এবং রফতানির তুলনায় আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’ এবং ‘কারেন্ট এ্যাকাউন্ট’ ভারসাম্যে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে, ডলারের বিপরীতে টাকার মান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতিও গত আট বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা পরিস্থিতি নেমে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, এতে রফতানি আয় কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে দেশের সামনে। এ অবস্থায় আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়া গেলে দেশের অর্থনীতির গতিশীলতা বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখবে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় আইএমএফের ঋণ প্রয়োজন, তবে তা হতে হবে শর্তহীন ও নমনীয় সুদের। সংস্থাটির সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতে হবে। তিনি বলেন, ঋণ পাওয়া গেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে এবং ডলারের যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা দূর হবে। এ কারণে দ্রুত ঋণপ্রাপ্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। এদিকে সরকার চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুত ও সারের ভর্তুকি বাবদ ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা রেখেছে। এত বেশি ভর্তুকির যৌক্তিকতা আছে কি না, তা বিবেচনা করতে পারে আইএমএফ। পাশাপাশি সরকারী ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণ ও সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে পারে আইএমএফ। উল্লেখ্য, আইএমএফের কাছ থেকে সর্বশেষ ২০১১-১২ অর্থবছরে ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের বাজেট সহায়তা বাংলাদেশ নিয়েছিল। ‘এক্সটেনডেট ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ)’ শিরোনামে ওই ঋণ সহায়তা আইএমএফ দিয়েছিল সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য। তবে গত এক দশকে এ ধরনের ঋণ নেয়ার প্রয়োজন না হলেও এবার মহামারীর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব, ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ব বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সঙ্কটে পড়ার শঙ্কায় সরকারকে প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আবারও বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ নিতে হচ্ছে। একইসঙ্গে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টে সহায়তা হিসেবেও এ ঋণ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। অতীতে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক এ সংস্থার ঋণ সহায়তা নিতে বাংলাদেশকে আর্থিক খাতে সংস্কারের শর্ত মানতে হয়েছে। এবারও সেরকম সংস্কারের বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সহজশর্তের ঋণপ্রাপ্তির বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের সহায়তার শর্তাবলি সম্পর্কে জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ইআরডির এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, এগুলো এখনও নির্ধারিত হয়নি। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে সংস্কার বাস্তবায়ন, নন-পারফর্মিং ঋণ কমানো, স্থানীয় ঋণ বাজারের জন্য পুঁজি বাজারের উন্নয়ন এবং আর্থিক, অর্থ-বাৎসরিক ও অর্থায়নে গবর্ন্যান্সের উন্নতি এসব ঋণ প্রস্তাবের সঙ্গে যুক্ত করা হতে পারে। এছাড়া আর্থিক নীতিমালার কাঠামো আধুনিকীকরণ, অর্থ-বার্ষিক কাঠামো উন্নতিকরণ ও আর্থিক ঝুঁকি কমানো, আর্থ-বার্ষিক নীতিতে প্রবৃদ্ধি সহায়ক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যয়ের সুযোগ রাখা, সমস্যা চিহ্নিতের মাধ্যমে আর্থিক দুর্বলতাগুলো কমানো, নজরদারি শক্তিশালীকরণ, তথ্য-উপাত্তের মান উন্নয়ন এবং জলবায়ু সংক্রান্ত দুর্বলতাগুলো কমাতে সংস্কার বাস্তবায়নের মতো বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেয়া হতে পারে।