বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততায় বদলে গেছে চট্টগ্রাম বন্দর
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : গত কয়েক বছরে দেশের অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। চিরাচরিত সেই শ্রমিক ধর্মঘট নেই। বিদেশি জাহাজের গড় অবস্থান সময় কমে এসেছে। বন্দরের খরচ কমে আয় বেড়েছে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কনটেইনার শনাক্ত করাসহ কনটেইনার আনলোডের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সন্নিবেশ করায় বন্দরের সক্ষমতা আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), পানগাঁ কনটেইনার টার্মিনাল এবং জেনারেল কার্গো বার্থে (জিসিবি) কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কাজ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. শাহজাহানও স্বীকার করেছেন, পরিস্থিতির উন্নয়নে নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করায় এবং বেসরকারি খাতকে কনটেইনার হ্যান্ডলিং কাজে নিযুক্ত করায় চট্টগ্রাম বন্দরে এখন ঝামেলা নেই। তিনি বলেন, দ্রুত কনটেইনার ডেলিভারি নেওয়ার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের অনেক ইয়ার্ড এখন খালি থাকছে। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, সিসিটি, এনসিটি, পানগাঁ কনটেইনার টার্মিনাল এবং জিসিবি মিলে গত বছর মোট কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ৬০ শতাংশই করেছে বেসরকারি খাতের সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। বাকি ছয়টি প্রতিষ্ঠান করেছে ৪০ শতাংশ। ২০২১ সালে ২৮ লাখ ৮৩ হাজার ১৫৪ টিইইউজ (টুয়েন্টি ইক্যুয়েভেলেন্ট ইউনিট) হ্যান্ডলিংয়ের মধ্যে সাইফ পাওয়ারটেক একাই করেছে ১৭ লাখ ৪০ হাজার ৯৬৪ টিইইউজ। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো করেছে ১১ লাখ ৪২ হাজার ১৯০ টিইইউজ।
সূত্রগুলো জানায়, বেসরকারি অপারেটর দিয়ে টার্মিনাল পরিচালনা করলেও উত্পাদনশীলতা বাড়ার পাশাপাশি বন্দরের সাশ্রয় হয়েছে কয়েক শ কোটি টাকা। এ বিষয়ে টার্মিনাল অপারেশনের সঙ্গে জড়িত বেসরকারি খাতের শীর্ষ উদ্যোক্তা ইত্তেফাককে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের মাইলফলক সৃষ্টি শুরুতে খুব সহজ ছিল না। উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি ও আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়ানোর পেছনে নৌমন্ত্রণালয়, বন্দরের কর্মকর্তা, শ্রমিক-কর্মচারী এবং বন্দর ব্যবহারকারীদের কঠোর পরিশ্রম রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষ বন্দরে পরিণত হয়েছে কর্তৃপক্ষের কিছু ইতিবাচক ও সাহসী সিদ্ধান্তের ফলে।’ বন্দর চেয়ারম্যান এ বিষয়ে বলেন, বন্দরের দখলকৃত জায়গা উদ্ধার করে সেখানে ইয়ার্ড বানানো হয়েছে। একসময় বন্দরে মোট ৪৯ হাজার ১৮ টিইইউ কনটেইনার রাখা যেত। এখন সেটির সক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫১৮টিইইউজ কনটেইনার রাখা যায়। তিনি জানান, বর্তমানে বন্দরে ৩৪ হাজার ২২৬ টিইইউজ কনটেইনার রয়েছে। শ্রমিকরা এখন বেসরকারি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকায় কথায় কথায় ধর্মঘট নেই বলে জানান তিনি।
ব্যবসায়ীরা জানান, ২০০৭ সালের আগে ম্যানুয়েল পদ্ধতি, একাধিক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা, ঘুষ-দুর্নীতি, শ্রমিক সংগঠনগুলোর যখন-তখন ধর্মঘট, অদক্ষ অপারেটরসহ বিভিন্ন কারণে ক্রমাগত অকার্যকর হয়ে পড়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর। যন্ত্র পরিচালক ও সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতেন। ফলে আমদানিকারকরা নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য খালাস নিতে পারতেন না। এর প্রভাব পড়ত বাজারে। অন্যদিকে শিল্প সময়মতো কাঁচামাল পেত না, ব্যাহত হতো রপ্তানি। ব্যবসায়ীরা আরো জানান, ২০০৭ সালের আগে জাহাজের গড় অবস্থান ছিল ১০ থেকে ১২ দিন। জাহাজ মালিকদের অতিরিক্ত মাসুুলের পাশাপাশি বহির্বিশ্বে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ অবস্থায় সিসিটি ও এনসিটি বেসরকারি পরিচালনায় দেওয়ার পর থেকে জাহাজের গড় অবস্থান তিন দিনে নামে। এতে জাহাজ মালিকপক্ষের খরচ কমে যাওয়ায় বন্দরে জাহাজ আসার সংখ্যাও বেড়েছে। বন্দরের খরচও কমেছে। ২০০৭ সালের আগে প্রতি কনটেইনারে বন্দরের ব্যয় হতো আড়াই হাজার; একই কাজ ২০০৭ সালের পরে ১ হাজার ২০০ টাকায় হচ্ছে। চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম ইত্তেফাককে বলেন, বন্দরের পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো। শ্রমিক ধর্মঘট না থাকার কারণে এখানে কনটেইনার জট নেই। তবে সুষ্ঠুভাবে বন্দর পরিচালনার জন্য এখানে জেটির সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। বে-টার্মিনাল যত তাড়াতাড়ি অপারেশনে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি জানান, কনটেইনার হ্যান্ডলিং-এর কাজ বেসরকারি খাতে যাওয়ায় পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।
ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, এক যুগ আগেও বন্দরে জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানোর পর সেটি খুঁজে পেতে আমদানিকারকরা সময়, অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় ও হয়রানির শিকার হতেন। এ কারণে সৃষ্টি হতো কনটেইনার জট। তখন কনটেইনারের গড় অবস্থান ছিল ২৫ থেকে ২৬ দিন। প্রতিটি কনটেইনার ইয়ার্ড থেকে ডেলিভারি পয়েন্টে বসাতে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিত একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এছাড়া, ২০০৭ সালের আগে কনটেইনার খালাসে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। ফলে আমদানিকারককে প্রতি কনটেইনারে ১৫০ থেকে ২০০ ডলার অতিরিক্ত মাসুল দিতে হতো। ২০০৭ সালের পরে সেই চিত্র পালটে যায়। শুরুতে মোবাইল এসএমএসের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে কনটেইনারের অবস্থান শনাক্ত হতো কয়েক মিনিটে। পরে সিটিএমএস আনা হয়। ডেলিভারির ক্ষেত্রে নতুন ও আধুনিক পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফেরানো হয়।
এর আগে বন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ইয়ার্ড এবং অপারেটর দিয়ে সিসিটির গ্যান্ট্রি ক্রেন (কিউজিসি) পরিচালনা হতো। জাহাজের ওপর ও নিচের অপারেশনাল কাজ হতো স্টিভিডোর শ্রমিক ও ডক শ্রমিকের মাধ্যমে। জাহাজের হুক পয়েন্ট থেকে কনটেইনার ইয়ার্ড পর্যন্ত পরিবহন হতো বেসরকারি ট্রেইলর কন্ট্রাক্টর দিয়ে। তখন একটি কনটেইনার খালাস নিতে অথবা জাহাজে তুলতে ২ হাজার ৫০০ টাকা খরচ পড়ত। ২০০৭ সালের পরে বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততা ছাড়াই খরচ নেমে আসে ১ হাজার ২০০ টাকায়। বেড়ে যায় উত্পাদনশীলতা। আগে যেখানে গ্যান্ট্রি ক্রেনের মাধ্যমে ঘণ্টায় ১০ থেকে ১২টি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হতো সেখানে বেসরকারি কোম্পানি দায়িত্ব নেওয়ার পর ২৫ থেকে ৩০ কনটেইনারে উন্নীত হয়।
এদিকে, ২০১৫ সালে এনসিটির পাঁচটি জেটি চালুর উদ্যোগ নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ২ ও ৩ নম্বর টার্মিনালের কাজ পায় সাইফ পাওয়ারটেক। ৪ ও ৫ নম্বর টার্মিনাল যৌথ প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়। ২০০৭ সালের ৮ মাসে (মে-ডিসেম্বর) এখানে ৯৭টি জাহাজে ৯২ হাজার ৬৮৭ টিইইউস হ্যান্ডলিং হয়। সেখানে ২০২১ সালে হ্যান্ডলিং হয়েছে ১১ লাখ ৪৯ হাজার ৬৭৫ টিইইউস।
জানা গেছে, এনসিটিতে উত্পাদনশীলতা বাড়ার কারণে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক শিপিং জার্নাল লয়েডস জরিপে ১০০টি কনটেইনার পোর্টের তালিকায় ২০২০ সালে ৫৮তম অবস্থানে এসেছিল চট্টগ্রাম বন্দর। এ বিষয়ে সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমীন ইত্তেফাককে বলেন, শুরুতে উন্নত বিশ্বের আধুনিক বন্দর থেকে বিশেষজ্ঞ এনে টার্মিনাল পরিচালনা করি। আমরা একমাত্র আইএসও সার্টিফায়েড প্রতিষ্ঠান। ১৫ বছরে ধাপে ধাপে সক্ষমতা বেড়েছে। নানামুখী উদ্যোগের ফলে বিশ্বের ১০০টি ব্যস্ত বন্দরের তালিকায় ৬৪তম স্থানে উঠে এসেছে। এর আগে এ অবস্থান ছিলো ৬৭তম।