দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নামছে নতুন নতুন বিলাসবহুল বাস
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে নড়াইলে নির্মিত দেশের প্রথম ছয় লেন বিশিষ্ট মধুমতি সেতু। এটি চালু হওয়ার পর যশোর, বেনাপোল ও নড়াইল থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম রুটে আধুনিক সুবিধাযুক্ত নতুন নতুন বাস নামছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতায়ও বিলাসবহুল ভ্রমণের সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারাদেশের পাশাপাশি ভারত-মিয়ানমারের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ তথা এশিয়ান হাইওয়ের সড়ক যোগাযোগের হাব হতে যাচ্ছে নড়াইল।
নড়াইলের লোহাগড়ায় মধুমতি নদীর কালনা পয়েন্টে নির্মিত সেতুটি সোমবার (১০ অক্টোবর) উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্কের আওতায় তৈরি করা এই সেতু নড়াইল, গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাগুরা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও ঝিনাইদহ জেলাকে সংযুক্ত করেছে। তবে এর সরাসরি সুফল পাবে খুলনা বিভাগের ১০টিসহ আরও কয়েকটি জেলার লাখ লাখ মানুষ, বলছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
তারা জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে সড়কপথে পাটুরিয়া ঘাট হয়ে নড়াইলের দূরত্ব ছিল ২২৫ কিলোমিটার। ফেরি আর সরু রাস্তার এই পথে যাতায়াতে ৬-৭ ঘণ্টা লেগে যেতো। এখন মধুমতি সেতু হওয়ায় দূরত্ব কমেছে প্রায় ৮৬ কিলোমিটার। ফলে প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে ১৩৯ কিলোমিটার পার হতে লাগবে মাত্র আড়াই ঘণ্টা। সেতু চালুর ফলে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় যাতায়াতে একইভাবে দূরত্ব কমে এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর, বেনাপোল ও নড়াইলের গণপরিবহনগুলো মূলত দুটি রুট ব্যবহার করে থাকে। এর মধ্যে বেশিরভাগ গাড়ি আরিচা ফেরি হয়ে মাগুরা দিয়ে যায়। আর পদ্মা সেতু দিয়ে কালনা ফেরি হয়ে যাওয়া গাড়ির সংখ্যা ছিল কম। আগে মাওয়া ও কালনায় দুটি ফেরি পার হতে হতো। পোহাতে হতো ঘাটকেন্দ্রিক তীব্র যানজটের দীর্ঘ ভোগান্তি। সম্প্রতি পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়। তবে বাধা হয়ে ছিল কালনা ফেরিটি, এখন সেটিও ছয় লেন বিশিষ্ট মধুমতি সেতু।
নড়াইলের পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে কালনা ফেরি হয়ে এই রুটে মাত্র পাঁচটি কোম্পানির বাস চলাচল করতো। সেগুলো হলো- দিগন্ত পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ঈগল পরিবহন, একে ট্রাভেলস ও নড়াইল এক্সপ্রেস। এর মধ্যে নড়াইল এক্সপ্রেসের ২৫টি ট্রিপ চলতো, ঈগলের ট্রিপ ছিল ১৩টি।
জানা গেছে, ২৪ ঘণ্টায় এখন নড়াইল এক্সপ্রেসের ৮০ট্রিপ চলছে। নড়াইল থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের উদ্দেশে ৭২টা বাস ছাড়ার প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে ঈগল কর্তৃপক্ষ। সোহাগ পরিবহন, দেশ ট্রাভেল, আপন পরিবহন, শিবচর ডিল্যাক্স, একে ট্রাভেলসসহ ২৫টি কোম্পানির বাস চলছে মধুমতি সেতু দিয়ে। এই তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে লাক্সারি বাসও। এতদিন কালনা ও মাওয়া ফেরির কারণে এই রুটে এতদিন কোনও লাক্সারি বাস চলাচল করেনি।মধুমতি সেতু (ছবি: ফোকাস বাংলা)
নড়াইল এক্সপ্রেসের নড়াইলের কাউন্টারের একজন বিক্রয়কর্মী জানিয়েছেন, তারা এখন জনপ্রতি টিকিটের মূল্য রাখছেন ৪৫০ টাকা করে। অন্য বাসগুলোর টিকিটের নির্ধারিত দামও এর কাছাকাছি। তবে লাক্সারি বাসের ভাড়া কিছুটা বাড়তে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঈগল পরিবহনের নড়াইল ম্যানেজার বিলাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যশোর, বেনাপোল ও নড়াইল থেকে আগে ২৪ ঘণ্টায় আমরা ১৩টি বাস ছাড়তাম। কালনা ফেরির জন্য এতদিন নড়াইল থেকে আমাদের কোনও লাক্সারি বাস ঢাকায় যেত না। এখন মধুমতি সেতু হওয়ায় লাক্সারি বাসসহ ২৪ ঘণ্টায় ৭২টা বাস নড়াইল থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে।
নড়াইল জেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী জহির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নড়াইল থেকে আগে মাত্র তিনটি কোম্পানির বাস যেতো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে। মধুমতি সেতু হওয়ায় নতুন আরও পাঁচটি পরিবহন কোম্পানি নড়াইলে কাউন্টার নিয়েছে। শিগগিরই এই রুটে পরিবহনের সংখ্যা বাড়বে। এর ফলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে।
নড়াইল জেলার আরেকজন পরিবহন নেতা বলেছেন, আগে কালনা ফেরি হয়ে নড়াইল থেকে ঢাকায় যেতে ৪ ঘণ্টা সময় লাগতো। এখন মধুমতি সেতুর কারণে সোয়া দুই ঘণ্টা থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগছে। এছাড়া ৩ ঘণ্টা ২০ মিনিটেই যশোর পৌঁছানো যাচ্ছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, সেতুটি এই অঞ্চলের পরিবহন খাত বদলে দেবে। সেবার মানও বাড়বে বলে আমার বিশ্বাস।
এদিকে, নড়াইল-যশোরের ব্যবসায়ীরা বলেন, এই অঞ্চলে মৌসুমী শাক-সবজি, ফল-মূল, খাদ্যশষ্য, ফুল ও মাছ উৎপাদন হয় ব্যাপক পরিসরে। তা ছাড়া ভারতীয় বিভিন্ন ধরনের পণ্য দেশের বৃহত্তর বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এসব পণ্য ও জিনিসপত্র সড়কপথে সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। পণ্য সরবরাহ চেইনে এখন মধুমতি সেতু পরিবর্তন আনবে, পুরো ব্যবস্থা গতিশীল হবে। কম সময়ে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। পচনশীল পণ্য নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে।
রিয়াজুল ইসলাম নামে নড়াইল সদরের এক সবজি ব্যবসায়ী বলেন, নিজ জেলা ও পার্শ্ববর্তী যশোর থেকে আসা পণ্য ঢাকার কাওরান বাজারে পাঠিয়ে থাকেন। আগে মাগুরা হয়ে পণ্যভর্তি ট্রাক পাঠাতেন। এখন থেকে মধুমতি সেতু দিয়ে পণ্য পাঠানো হচ্ছে। সময় সাশ্রয় হচ্ছে, ট্রাক ভাড়াও কমছে।মধুমতি সেতু (ছবি: ফোকাস বাংলা)
এছাড়াও সেতুর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসায় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বেগবান হবে। ছোট-বড় উদ্যোক্তার সংখ্যাও বাড়বে। সড়কপথে যাতায়াত বাড়বে। সব মিলিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতিতে হাওয়া লাগবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
প্রসঙ্গত, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর নড়াইলে সুলতান মঞ্চের জনসভায় এখানে একটি সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি ক্ষমতায় এসে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, যা গত ১০ অক্টোবর চালু হয়।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ৬৯০ মিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯৬০ কোটি টাকা। প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেতুটির কারণে ঢাকা থেকে নড়াইলের দূরত্ব কমে আসলো ১১৫ কিলোমিটার। একই দূরত্ব কমলো কলকাতার ক্ষেত্রেও। আশপাশের অন্যান্য জেলার ক্ষেত্রে দূরত্ব কমলো ৯০-৯৮ কিলোমিটার। এই সেতু দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতে সময় ও অর্থ বাঁচাবে। এ ছাড়া দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্বও কমবে, সাশ্রয় হবে সময়। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে এবং প্রতিবেশী দেশে ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।মধুমতি সেতু (ছবি: ফোকাস বাংলা)
এ বিষয়ে নড়াইলের জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, মধুমতি সেতু এই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সকল অংশীজন, মধুমতি নদীর দুই পাড়ের ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জীবনমান বদলে দেবে। ঢাকাসহ সারাদেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে নড়াইল ‘হাব’ হিসেবে পরিচিতি পাবে। দেশের ইতিহাসে সার্ভিস লেনসহ ছয় লেনের সেতু এটিই প্রথম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষকে উপহার দিয়েছেন এটি।
প্রকল্পটির পরিচালক শ্যামল ভট্টাচার্য বলেছেন, পদ্মা সেতুর সুফল পুরোপুরি পেতেও এই সেতুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই অঞ্চলের স্থলবন্দরসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্যও সেতুর কানেকশন জরুরি ছিল। এই অঞ্চলের সাব-রিজিওনাল কানেক্টিভিটি মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করবে মধুমতি সেতু। ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্কের আওতায় ১৭টি সেতুর কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে এটি প্রথম চালু হলো।
এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়া— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, রাস্তাঘাট নির্মিত হবে অন্য প্রকল্পের মাধ্যমে। এটা একটা সাপ্লিমেন্টারি প্রজেক্ট। অন্যান্য যে প্রকল্প তৈরি হবে, তা এটার কমপ্লিমেন্টারি। ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প সাবমিট করা হয়েছে। সেটি হলে এই অংশের সুফলটা পুরোপুরি পাবো।