ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক জোরদারে ভূমিকা রাখতে পারে গণমাধ্যম
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা, বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও বিভিন্ন সম্ভাবনার ক্ষেত্রে উভয় দেশের সাংবাদিকদের এগিয়ে আসতে হবে। এখানে গণমাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উভয় দেশের সম্পর্ক জোরদারেও গণমাধ্যমের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। স্পিকার আশা প্রকাশ করেন, গণমাধ্যম সেই কাজটি করে যাবে।
স্পিকার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাব আয়োজিত ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও গণমাধ্যমের ভূমিকা : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তৃতা করছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন। সেমিনারে বক্তাদের মধ্যে ছিলেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, ইন্ডিয়ান জার্নালিস্ট ইউনিয়নের সভাপতি গীতার্থ পাঠক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন সেমিনার উপ-কমিটির আহ্বায়ক আইউব ভুইয়া। সেমিনারের দ্বিতীয় অধিবেশনে দুই দেশের সাংবাদিক প্রতিনিধিরা সম্পর্ক উন্নয়ন প্রসঙ্গে খোলামেলা অভিমত ব্যক্ত করেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সোহরাব হাসান। আলোচনায় অংশ নেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সভাপতি গৌতম লাহিড়ী, আগরতলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক প্রণব সরকার, একাত্তর টিভির সিইও মোজাম্মেল বাবু, ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, দিল্লি প্রেস ক্লাবের প্রতিনিধি মহুয়া চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের সম্পর্ক সমস্যা, সম্ভাবনা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর নির্ভরশীল।
এগুলোতে আমরা উত্তরোত্তর উন্নতির দিকে যাচ্ছি। উভয় দেশের সম্পর্ক বর্তমানে সর্বোচ্চ চূড়ায় রয়েছে। তিনি আশা করেন- সামনের দিনে এটা আরও বৃদ্ধি পাবে এবং উভয় দেশের অভিন্ন সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। স্পিকার বলেন, বাংলাদেশ ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশ ও বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হিসেবে পারস্পরিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতায় বিশ্বাসী। আমরা বিশ্বাস করি যে কোনো সমস্যার সমাধান আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, ভারতের সঙ্গে স্থল সীমানা চুক্তি ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। বিবিআইএন, বিমসটেক ইত্যাদি বিষয়ে উভয় দেশ কীভাবে আরও উপকৃত হতে পারে সে ক্ষেত্রে দুই দেশের গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক কীভাবে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সুসংহত করা যায় সে বিষয়ে দুই দেশের গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। স্পিকার বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও জোরদারকরণে, বিশেষ করে দুই দেশের গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি। দুই দেশের গণমাধ্যমের বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে জনগণের যে সম্পর্ক ও যোগাযোগ, যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সম্পর্কের জটিলতা আছে : সেমিনারে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, আমাদের ও ভারতের সম্পর্কের জটিলতা আছে। কিন্তু ইতিহাসের কথা যেন না ভুলি। নদীর পানি বণ্টনে আমাদের চুক্তিতে আসতে হবে। কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের লোকদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। ১১ বছর ধরে চুক্তিটি ঝুলে আছে। এটা নিয়ে কত দিন অপেক্ষা করব। এটার স্বাক্ষর কবে হবে তা জানি না। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে বৈসাদৃশ্য রয়েছে। ভারতের ৯ বিলিয়ন ডলারের মার্কেট, কিন্তু আমরা সেখানে ভারতের কাছে কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছি। এসব ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ভূমিকা রাখতে হবে। মাহফুজ আনাম বলেন, ভারতের মিডিয়া দেখলে বাংলাদেশ যে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যায় না।
‘দুই দেশের অভিন্ন ঐতিহ্য’ : ইন্ডিয়ান জার্নালিস্ট ইউনিয়নের সভাপতি গীতার্থ পাঠক বলেন, ভারত- বাংলাদেশ দুই দেশের অভিন্ন ঐতিহ্য রয়েছে। তিন বিঘা করিডোর, ফারাক্কা-তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের অধিকার আছে। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে মূল বিষয়গুলো কম্প্রোমাইজ করা উচিত নয়। ধর্মান্ধতা দূরীকরণে বিষয়গুলো তুলে ধরা উচিত। ইন্দো-বাংলা ফোরামের দুই দেশের সাংবাদিকদের আদান-প্রদান হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে ভিসা জটিলতা যেন না থাকে।
‘ভারতের সংবিধানও চোরাকারবারিদের হত্যার পারমিশন দেয় না’ : সেমিনারের দ্বিতীয় অধিবেশনে অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ভারতের সংবিধানও চোরাকারবারিদের হত্যা অনুমোদন করে না। এটা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড। তারা মেরে ফেলতে পারে না, আটক করতে পারে। তবে তিনি বলেন, সীমান্ত হত্যা কমেছে। কিন্তু একটা হত্যাকান্ডও যেন না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হবে। ড. ইমতিয়াজ বলেন, চীন-ভারত সীমান্তের ২ কিলোমিটারের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ- এমন একটা চুক্তি আছে দেশ দুটির মধ্যে। বাংলাদেশ-ভারতও এমন একটা চুক্তি হতে পারে।
তিস্তা চুক্তি প্রসঙ্গ : ড. ইমতিয়াজ আরও বলেন, তিস্তা চুক্তি কোনোভাবে হওয়ার কথা না। সিকিমে ছোট-বড় ৩০টি হাইড্রোড্যাম হয়ে গেছে। প্রতিটি হাইড্রোড্যাম ৫ শতাংশ পানি নিয়ে নেয়। তাহলে আর পানিই বা কতটুকু অবশিষ্ট থাকল? আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিই বা কী দোষ করলেন? আমি মনে করি তাঁর অবস্থান ঠিক আছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দিল্লি কেন মধ্যস্থতা করল না? তাদের সঙ্গেও তো মিয়ানমারের খুব ভালো সম্পর্ক। বাংলাদেশকে সেটা কাজে লাগাতে হবে।
‘তিস্তায় পানি নাই তো কী হয়েছে?’ : প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সাবেক সভাপতি গৌতম লাহিড়ী বলেন, তিস্তা নদীর পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার আছে। অবশ্যই তিস্তার পানি বাংলাদেশকে পেতে হবে। তিস্তায় পানি নাই তো কী হয়েছে? যা আছে তা-ই ভাগ করে নিতে হবে দুই দেশকে। তিনি সীমান্ত হত্যার পেছনের কারণ অনুসন্ধানে একটি যৌথ তদন্তের দাবি জানিয়ে বলেন, এখানকার মিডিয়ায় লেখা হয় ‘বাংলাদেশি’ আর ভারতীয় মিডিয়ায় লেখা হয় ‘চোরাকারবারি’। এমনটা কেন হয় সেটা জানা দরকার। কেনইবা প্রতিটি ঘটনা রাতে ঘটে। প্রতিটি মৃত্যুই মর্মান্তিক।
‘ওটা ছিল ভারতের ভুল’ : আগরতলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক প্রণব সরকার ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণ না পাওয়াকে ভারতের ভুল বলে অভিহিত করে বলেন, তবে একটা ভুল দিয়ে পুরো বিষয়কে বিচার করলে হবে না। তিনি আরও বলেন, আপনারা অনেকেই চীন-পাকিস্তানের কথা বলছিলেন। কিন্তু আমরা যারা বাংলায় সাংবাদিকতা করি তারা সবাই কিন্তু এক কথায় বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিই। এ জায়গায় ভুল বোঝাবুঝি যেন না হয়। তিনি বলেন, দুই দেশের সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ কম, প্রত্যাশা বেশি। আমি বলব হতাশ হওয়ার জায়গা নাই। আমরা যাতে একসঙ্গে থাকতে পারি সেটি মাথায় নিতে হবে। সভাপতির ভাষণে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যেমন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ। একইভাবে দুই দেশের জনগণের মধ্যে রয়েছে আত্মীয়তা ও ভালোবাসার সম্পর্ক। তবে সব সম্পর্কই ধরে রাখতে হয়। টিকিয়ে রাখতে পরিচর্যা করতে হয়। তিনি এ বিষয়ে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের অগ্রণী ভূমিকা পালনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
আজ নৈশভোজ : জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের জন্য ১২ দিনের অনুষ্ঠানমালার সমাপনী আজ। আজ ক্লাবের নবীন-প্রবীণ বার্ষিক মিলনমেলা। সন্ধ্যায় কেক কাটার মধ্য দিয়ে শুরু হবে আনন্দঘন আয়োজন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গাইবেন প্রখ্যাত শিল্পীরা, থাকবে নান্দনিক নৃত্যানুষ্ঠান। আজ ক্লাবের বার্ষিক নৈশভোজ ও র্যাফেল ড্র। সকালে হবে ক্লাব সদস্যদের মিনি ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা।