রেমিট্যান্স বাড়াতে নতুন কৌশল
বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : বর্তমানে দেশে ডলার সঙ্কটের মধ্যে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে হুন্ডি বাণিজ্য বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো প্রতিমাসেই কমছে। এজন্য হুন্ডি বাণিজ্য রোধে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি ট্যাক্সফোর্স গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এ ট্যাক্সফোর্স গঠন করা হবে। এতে পরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), সিআইডি, দুনীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থা সংযুক্ত থাকবেন। এছাড়া এ ট্যাক্সফোর্স দুনীতি, অনিয়ম, অর্থ পাচার নিয়েও কাজ করবে। এরই মধ্যে প্রায় ১৭টি দেশে বাংলাদেশি বসবাসকারী প্রবাসীদের আস্থা অর্জনের জন্য বেশ কয়েকটি দূতাবাসে সাথে আলোচনাও করেছে সরকার। অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
অর্থমন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বাংলাদেশে দুই সপ্তাহ সফর শেষে ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়। সে প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৭ হাজার ৩৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭ লাখ ৩৬ হাজার ৫শ কোটি টাকার মতো। এসব অনিয়ম ও অর্থপাচার ঠেকাতে সব ধরনের লেনদেনের ওপর নিবিড় তদারকি জোরদার করার কথা জানিয়েছে। অর্থপাচার রোধে কাজ করা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সক্ষমতা বাড়ানো, সংস্থাটিকেও ওপরের চাপ আর নির্দেশের অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে বসে না থেকে দেশের উপকারে আসে, এমন পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, অর্থ পাচার ঠেকানোর মূল দায়িত্ব তাদের। এছাড়া বর্তমান ডলার-সঙ্কটের পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট আয়ের সব খাতের মানুষ চাপে পড়েছে। তাই সক্রিয় হতে হবে দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থাগুলোকে। দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে। তাহলেই হুন্ডি কার্যক্রম ও অর্থ পাচার প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসেছে ১৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি কমেছে সউদী আরব থেকে, যেখানে রয়েছে ২২ লাখ বাংলাদেশি।
এদিকে চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ১৮ দিনে ১০৫ কোটি ৯৯ লাখ (১ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০৮ টাকা ধরে) যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ১৭৬ কোটি ডলার ছাড়াবে। গতকাল রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের এক প্রতিবেদনে এ চিত্র পাওয়া গেছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈধপথে প্রবাসী আয় ধারাবাহিক কমছে। অর্থনীতির অন্যতম এ সূচকটির নেতিবাচক গতি দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। এমন পরিস্থিতিতে বৈধপথে রেমিট্যান্স আনতে বিভিন্ন শর্ত শিথিল, চার্জ ফি মওকুফসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তারপরও ইতিবাচক সাড়া মিলছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সউদী আরব থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। অথচ এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
রেমিট্যান্স কম আসার তালিকায় দ্বিতীয়তে রয়েছে মালয়েশিয়া। ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৮৪৯ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সম্প্রতি বলেছে, বিকাশ-নগদ ও রকেটের মতো মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত পাঁচ হাজার এজেন্ট অবৈধ উপায়ে বিদেশ থেকে অর্থ আনা ও বিদেশে অর্থ পাঠানোয় জড়িত। তাদের মাধ্যমে চার মাসে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) বিতরণ হয়েছে। এভাবে দেশ বছরে প্রায় ৭৮০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৭৫ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
অর্থপাচার রোধে কাজ করা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিলেট ছিল প্রবাসী আয়ের বড় উৎস। ফলে অর্থ পাচারকারীদের বড় অংশ হলেন ওই অঞ্চলের নাগরিকেরা। কারণ, ওখানকার নতুন প্রজন্মও বিদেশে আবাস গড়ছে। তারা দেশের সম্পদ বিক্রি করে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। আবার ধানমন্ডি ও গুলশানের মতো এলাকার অনেক বাসিন্দাও বাড়ি ও সম্পদ বিক্রি করে স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। বিদেশে বৈধভাবে টাকা নেওয়ার সুযোগ না থাকায় অবৈধভাবেই তা বাইরে নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুল রউফ তালুকদার বলেছেন, হুন্ডি প্রতিরোধে করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর নজরদারি করছে। তিনি বলেন, আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (কম মূল্য দেখানো) মাধ্যমে অর্থ পাচার ঠেকাতে আমরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছি। এতে সঙ্কট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আগামী জানুয়ারি মাস থেকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট আর থাকবে না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই উদ্যোগ প্রবাসীকর্মীদের বৈধ চ্যানেল থেকে অবৈধ চ্যানেলে স্থানাস্তরিত হওয়ার প্রবণতাকে হ্রাস করবে। যারা দেশে রেমিট্যান্স পাঠায়, তাদেরকে বৈধ চ্যানেল ব্যবহারে উৎসাহিত করতে বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, অবৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর ঝুঁকি তুলে ধরে এক্ষেত্রে নজরদারি বাড়ানো ও জোরালো প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। নতুন অভিবাসীদের লক্ষ্য করে একটি শক্তিশালী প্রচার কার্যক্রমের মাধ্যমে আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স ২০২০-২০২১ সালে প্রাপ্ত ২৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারও স্পর্শ করতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সাহেল উদ্দিন আহমেদ বলেন, রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে শিল্পখাতের উন্নয়ন ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। সেই সঙ্গে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স দেশে বৈধ পথে বেশি বিশে আশে সরকারকে আগে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তার আগে বতর্মানে সরকারকে প্রবাসীদের আস্থা অর্জন করতে হবে। যে আস্থা সরকার ব্যাংকিং সেক্টরের কারনে হারিয়ে ফেলেছে।
ট্যাক্সফোর্স গঠনের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোন কমিটি গঠন করার উদ্যোগ সঠিক হলে ভালো। তবে গঠন প্রক্রিয়ায় যদি কোন ত্রুটি থাকলে সেই উদ্যোগ ব্যহত হয়। প্রবাসীদের টাকা উত্তোলনে ব্যাংকগুলো হয়রানি করে। সরকার ব্যাংক ডলারের বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বৈধ ও অবৈধ চ্যানেলের মধ্যে ৬-৭ টাকার মতো পার্থক্য রয়েছে। এছাড়াও, ডলারের বিপরীতে টাকার দর বাড়াও এর অন্যতম একটি কারণ। বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় টাকা পাঠানোর অবৈধ চ্যানেল হুন্ডি কার্যক্রম আবারও স্বাভাবিক হওয়ায় প্রবাসীকর্মীরা এর মাধ্যমেই টাকা পাঠাচ্ছেন।