শরিয়াহ ৫ ব্যাংকের ঋণের তথ্য জানাতে হবে প্রতিদিন

0

বিডি২৪ভিউজ ডেস্ক : ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি বাড়ানো হয়েছে। এখন থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এসআইবিএল, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ১০ কোটি বা তার বেশি টাকার ঋণ বিতরণ ও আদায়ের তথ্য দৈনিক ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে। আর ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি অঙ্কের ঋণ অনুমোদনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক দুটির ৫ কোটি টাকার বেশি অঙ্কের ঋণ বিতরণের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করতে হবে। তবে এমন এক সময়ে ব্যাংকগুলোতে তদারকি জোরদার করা হলো, যখন তাদের বড় ঋণ দেওয়ার মতো তহবিলের ঘাটতি রয়েছে।

কঠোর তদারকির আওতায় আনা ইসলামী ধারার পাঁচটি ব্যাংকেরই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের। এসব ব্যাংকের ঋণ বিতরণে বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে ঋণ অনিয়মের ঘটনা বেশি। ঋণ জালিয়াতি, নিয়োগ-পদোন্নতিতে স্বেচ্ছাচারিতাসহ বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে গত সোমবার ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ঋণ বিতরণ ও আদায়ের তথ্য চেয়ে গত বুধবার পাঁচটি ব্যাংকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চিঠির সঙ্গে ছকে দৈনিক ভিত্তিতে বিভিন্ন তথ্য দিতে বলা হয়েছে। সেখানে ইতোমধ্যে অনুমোদন করা ১০ থেকে ২০ কোটি টাকা, ২০ কোটির বেশি থেকে ৫০ কোটি, ৫০ কোটির বেশি থেকে ১০০ কোটি, ১০০ কোটির বেশি থেকে ৫০০ কোটি এবং ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণের বিতরণ ও আদায়ের তথ্য দিতে হবে। এ ছাড়া বিনিয়োগের ধরন তথা মেয়াদি, চলতি বা তলবি কিনা জানাতে হবে। আর অনুমোদিত সীমা, বিতরণ, আদায় ও স্থিতি জানাতে হবে।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার বিভিন্ন ব্যাংকে নিয়োগ করা পর্যবেক্ষক ও তদারকির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে এক বৈঠকে অনিয়মের বিষয়ে কঠোর বার্তা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এসব ব্যাংকে ঋণের নামে কী ঘটেছে, বেনামি সন্দেহ করা ঋণের আসল সুবিধাভোগী কারা, তা উদ্ঘাটন করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সাম্প্রতিক সময়ে দেওয়া বিভিন্ন নির্দেশনা যথাযথভাবে পরিপালন হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য শিগগিরই ব্যাংকগুলোতে সরেজমিন পরিদর্শনের নির্দেশনা দিয়েছেন। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বেনামি ঋণের সুবিধাভোগী খুঁজতে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিদর্শক দল। বেনামি সন্দেহ করা ঋণের টাকা হুন্ডির দায় পরিশোধে ব্যবহার হয়েছে কিনা, তারও তদন্ত চলছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সমকালকে বলেন, শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে এরই মধ্যে দুটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যাংকে তদারকি জোরদার করতে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে পাঁচটি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও আদায়ের তথ্য দৈনিক ভিত্তিতে চাওয়া হয়েছে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, ঋণ বিতরণের তদারকি জোরদার করা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব ব্যাংকের হাতে ঋণ দেওয়ার মতো তহবিলের সংকট আছে। এসব ব্যাংকের মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ একসময় অন্য শরিয়াহ ব্যাংকগুলোকে ধার দিত। এখন ব্যাংকটিই সংকটে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ধার করছে। ইসলামী ব্যাংকের আমানত কমে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকায় নেমেছে। গত অক্টোবর শেষে যেখানে ব্যাংকটির আমানত ছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষক বসানোর খবরে আমানতকারীদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। গত দু’দিন টাকা উত্তোলনের চাপ কিছুটা কমেছে। অনেকে তুলে নেওয়া আমানত জমা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা সমকালকে বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির আওতায় তাঁরা প্রতিনিয়তই আছেন। সব সময়ই ডিসেম্বর মাসে ব্যাংকের নতুন ঋণ বিতরণের চেয়ে আদায়ে বেশি জোর দেওয়া হয়। নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইসলামী ব্যাংক কাজ করছে।

মতামত জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, এসব ব্যাংকে কী ঘটছিল, তা অনেক আগ থেকেই সবাই জানে। বাংলাদেশে একটি প্রবাদ আছে, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এসব ব্যাংকে যদি ঋণযোগ্য তহবিল থাকে তাহলে ঠিক আছে। তবে যদি ঋণ দেওয়ার মতো তহবিলই না থাকে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনার কোনো কার্যকারিতা নেই। এ ধরনের নির্দেশনা আগে দেওয়া উচিত ছিল।

সংশ্নিষ্টরা জানান, বেশ আগ থেকে ইসলামী ধারার এই পাঁচ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বেনামি ঋণের অভিযোগ উঠলেও অজ্ঞাত কারণে এতদিন চুপ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে নাবিল গ্রুপের বিভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে বড় অঙ্কের টাকা বের করে নেওয়ার অভিযোগ পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নাবিল গ্রুপের নামে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্তও ঋণ ছিল ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আসার সময় এ গ্রুপের ঋণ ছিল সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ৩ অক্টোবর ‘বেনামি সন্দেহে তিন ব্যাংকের ৩২৭০ কোটি টাকার ঋণ’ শিরোনামে সমকালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই সময় গ্রুপটির মোট ঋণ ছিল সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার কম। তবে এরই মধ্যে তিন ব্যাংকে এই গ্রুপের নামে ১২ হাজার কোটি টাকার ঋণ সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক একাই দিয়েছে ৯ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। এই ঋণের বড় অংশের সুবিধাভোগী ব্যাংকটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত কোনো পক্ষ বলে ধারণা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদে ২০১০ সাল থেকে পর্যবেক্ষক ছিলেন। ২০১৭ সালে ব্যাংকটির মালিকানা বদলের পর এই ব্যাংকে দ্রুত ঋণ বাড়তে থাকে। তবে ব্যাংকটিতে তদারকি জোরদার না করে অজ্ঞাত কারণে ২০২০ সালের মার্চে হঠাৎ পর্যবেক্ষক প্রত্যাহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পর আরও দ্রুত ঋণ বাড়লেও কখনও কোনো প্রশ্নের মুখে পড়েনি ব্যাংকটি। চলতি বছরের শুরু থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম ৯ মাসেই ব্যাংকটিতে ২৫ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা ঋণ বেড়ে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা হয়েছে। নতুনভাবে সৃষ্ট ঋণের বড় অংশই একটি শিল্প গ্রুপ নিয়ে গেছে বলে বিভিন্ন পর্যায় থেকে অভিযোগ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করা হবে না.